বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। বহু রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে পাওয়া এ বিজয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের এই দিনটিতে ‘বাংলাদেশ’ নামে নতুন এক দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়। সেই বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় জন্মভূমি। এই দেশের বিজয়ে, লাল-সবুজের পতাকার বিজয়ে সেদিন আমরা সম্মিলিতভাবে গেয়ে উঠি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্মদিন। এবার এ বিজয়ের ৫০তম দিবস আমরা পালন করছি। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? কিছু দিন পরই ২৬ মার্চ আমরা পালন করব প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উৎসব। অভিবাদন প্রিয় বাংলাদেশ!
এবার আলো ঝলমল করে উদ্ভাসিত হবে বিজয়ের আনন্দের ১৬ ডিসেম্বরের দিনটি। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১’ কবিতায় লিখেছিলেন-
পরিষ্কার মনে আছে সেই দিনটি।
টিয়ে পাখির মতো লাল-সবুজ পতাকায় পতাকায়
ভরে গিয়েছিল আমাদের শহর।’
একাত্তরে প্রথম বিজয় দিবস থেকে এবার ৫০তম বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরে আমরা দেখতে পাবো টিয়ে পাখির মতো লাল-সবুজ পতাকায় পতাকায় ছেয়ে গেছে আমাদের দেশটা। আমরা গলা ছেড়ে গাইব শামসুর রাহমানের গান-
‘কোকিল, দোয়েল গান গেয়ে বলে,
আজ আমাদের বিজয় দিবস।
গোলাপ, বকুল বলে একসাথে
আজ আমাদের বিজয় দিবস।’
সত্যিই এই বিজয়ের কোনো তুলনা নেই। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার ভাষায়- ‘আমাদের এই বাংলাদেশ ধানের দেশ, গানের দেশ, বীরের দেশ, তেরো শত নদীর দেশ। আমাদের দেশ স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের তুলনাহীন এই বিজয় দিবস এমনি এমনি আসেনি। এই বিজয় রক্তে কেনা। ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে এই বিজয় আমরা ছিনিয়ে এনেছি। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাত থেকে জাতির ওপর শুরু হয়েছিল মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ আর আর্তনাদের নারকীয় বর্বরতা।
কিন্তু এই ঘোরতর অমানিশা ভেদ করে ৯ মাসের মাথায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার চির ভাস্বর সূর্য। পত পত করে উড়তে থাকে স্বাধীনতার পতাকা। এই পতাকা বিজয়ের পতাকা। নতুন দেশের উদয়ের সূর্য। স্বাধীন সূর্যোদয়। এই স্বাধীন দেশের নামই বাংলাদেশ।
৯ মাস যুদ্ধ করে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, স্বাধীনতা লাভ করেছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে আত্মোৎসর্গের ঘটনাও। বিজয় ছিনিয়ে আনতে গিয়ে লাখো প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। কত যে ত্যাগ, কত যে অশ্রু- তার কোনো হিসাব নেই। সাহস করে চোখের জলেই আমরা বীরগাথা রচনা করেছি। লাল-সবুজের পতাকা আমাদের সেই আত্মোৎসর্গের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ত্যাগের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল, আনন্দের ঘটনাও। মায়ের অশ্রু, বীরের রক্ত স্রোত- এ মাটির, এ জাতির গৌরব। চিরদিনের সম্পদ। আমাদের রক্তার্জিত পতাকা তাই চিরদিন বাংলার আকাশে উড়বে।
বিজয়ের মুহূর্ত
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের দিনটিতে ছিলাম ১০-১১ বছরের বালক। আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার মতোই আমার স্মৃতিতেও উজ্জ্বল হয়ে আছে বিজয়ের সেই মুহূর্ত। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের পীরের গাঁওয়ে বোনের বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান ও খবর বড়দের সাথে আমরা ছোটরাও দল বেঁধে শুনতাম। বেতারে বিজয়ের কথা অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে শুনে সেদিন আমরা বালকের দল আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এক নিভৃত পল্লীতে আমাদের কী যে আনন্দ! আপন মনেই সেদিন উল্লসিত হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের সাড়াজাগানো গানগুলো সবাই মিলে গাইতে থাকি। মনে আছে, পতাকা নিয়ে সবুজ মাঠে দৌড়েছি। মনের আনন্দে হেসে কুটি কুটি হয়েছি। আনন্দে দল বেঁধে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছি, সাঁতার কেটেছি। দুপুরের পর খবর পেলাম, পীরের গাঁওয়ের উত্তর দিকে ‘মাইঝের বাড়ি’তে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে। কী যে কৌতূহল! দৌড়ে গেলাম সেই বাড়িতে। আমাদের মতো অনেকেই এসেছে তাদের দেখতে। সম্ভবত চারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রণাঙ্গনের ক্লান্ত যোদ্ধারা তখন ‘স্টেনগান’ ও ‘রাইফেল’ পাশে রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। একপর্যায়ে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে তাদের শরীর ছুঁয়ে দেখি। তখন মনে হয়েছিল, এরা সাধারণ মানুষ নন, এর চেয়েও বড় কিছু। সেই স্মৃতি এখনো চোখে ভাসছে।
বিজয়ের মুহূর্ত নিয়ে কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন মজার স্মৃতি। ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ তিনি লিখেছেন- ‘ঝিকাতলায় থাকতাম। আমার সাথে ঝিকাতলায় সেই একতলা টিনের ছাদের বাড়িতে ছিলেন আমার অতি প্রিয় বন্ধু আনিস সাবেত। তিনি বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। ১৬ ডিসেম্বর আমরা দু’জন কী করলাম একটু বলি। হঠাৎ মনে হলো আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পৃথিবী উলট-পালট হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কানে ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ হচ্ছে। আনিস সাবেত বাড়ির সামনের মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি শব্দ করে কাঁদছেন। গড়াগড়ি করছেন। আমি তাকে টেনে তুললাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চল রাস্তায় চল।’ একটু আগেই তিনি কাঁদছিলেন। এখন আবার হাসছেন। আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম এবং ফাঁকা রাস্তায় কোনো কারণ ছাড়াই দৌড়াতে শুরু করলাম। আনিস ভাই এক হাতে শক্ত করে আমাকে ধরে আছেন, আমরা দৌড়াচ্ছি। ঢাকা শহরের সব মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে। চিৎকার, হইচই, লাফালাফি, মাঝে মধ্যেই আকাশ কাঁপিয়ে সমবেত গর্জন- ‘জয়বাংলা’। প্রতিটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। এই পতাকা সবাই এত দিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে? ঝিকাতলার মোড়ে আমরা দু’জনকে লোকজন আটকাল। তারা শঙ্কিত গলায় বলেন, রাস্তা পার হবেন না। খবরদার! কিছু আটকে পড়া বিহারি দোতলার জানালা থেকে ওই দিকে গুলি করছে। আমরা গুলির শব্দ শুনলাম। আনিস ভাই বললেন, দুত্তেরি গুলি। হুমায়ূন চল তো।’ আমরা গুলির ভেতর দিয়ে চলে এলাম। আমাদের দেখাদেখি অন্যরাও আসতে শুরু করল।
সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে এসে আনিস ভাই দুই প্যাকেট বিস্কুট কিনলেন (আমার হাত সে সময় শূন্য, কেনাকাটা যা করার আনিস ভাই করতেন)। আমরা সারা দিন কিছু খাইনি। প্রচণ্ড ক্ষিদে লেগেছে। আমি আনিস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আনিস ভাই, পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে। তিনি বললেন, অবশ্যই পোলাও খাবো; পোলাও। আমরা দু’জন অর্ধউন্মাদের মতো ‘পোলাও পোলাও’ বলে চেঁচালাম। রাস্তার লোকজন আমাদের দেখছে। কেউ কিছু মনে করছে না। একটা রিকশাকে আসতে দেখলাম। রিকশার সিটের ওপর বিপজ্জনক ভঙ্গিতে মধ্যবয়স্ক এক লোক দাঁড়িয়ে। তিনি জিগিরের ভঙ্গিতে বলেই যাচ্ছেন- ‘জয় বাংলা। জয় বাংলা। জয় বাংলা।’ আনিস ভাই তার হাতের বিস্কুটের প্যাকেট গুঁড়া করে ফেললেন। আমিও করলাম। আমরা বিস্কুটের গুঁড়া ছড়িয়ে দিতে দিতে এগোচ্ছি। কোন দিকে যাচ্ছি, তাও জানি না। আজ আমাদের কোনো গন্তব্য নেই।’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে পরাজিত পাকিস্তান সেনা বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল) একে খোন্দকার বীর উত্তম। ‘বিজয়ের দিনে’ ও ‘ভেতরে বাইরে’ বইতে তিনি লিখেন- ‘আগরতলা থেকে হেলিকপ্টারে করে জেনারেল অরোরার সাথে আমি যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করি, তখন আমার একটিমাত্র অনুভূতিই ছিল যে, আমি স্পর্শ করতে পেরেছি আমার স্বাধীন দেশের মাটি। আমরা যখন রমনা ময়দানের দিকে যেতে থাকি, তখন রাস্তার দুই পাশের বহু মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই মুক্তির আনন্দে আকুলভাবে কাঁদতে দেখেছি। তাদের মুখে যে অভিব্যক্তি ছিল, সেটি মুক্তির। রমনার রেসকোর্স ময়দানে অসংখ্য লোকের সাথে আমাকে কোলাকুলি করতে হয়েছে। এর মধ্যে ছিল মানুষের অনাবিল আনন্দ ও স্বস্তির অভিব্যক্তি। বেশ ক’জন আমাকে সেদিন বলেছেন, ‘আজ রাত থেকে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।’
‘আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষ করে হেলিকপ্টারে করে আগরতলা ও পরে বিমানে করে কলকাতায় ফিরে আসার সময়টুকুতে দীর্ঘ ৯ মাসের স্মৃতিগুলো মনের আয়নায় ভেসে উঠছিল। বিমানটি যখন কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসর মেঘরাশিকে ভেদ করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন কল্পনায় প্রভাতের হাতছানি দিতে লাগল আগামীর প্রভাতের সূর্য। সেই নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি, জনপদ ও মানুষ।’
কবি আসাদ চৌধুরী ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ বইতে লিখেছেন- ‘অবরুদ্ধ ৯ মাস পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ৪টা ২১ মিনিটে জেনারেল নিয়াজি রমনার রেসকোর্স ময়দানে জনতার ‘জয়বাংলা’ সেøাগানের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন। এরপর সামরিক কায়দায় ধীরে ধীরে কোমর থেকে বেল্ট খুললেন, অস্ত্র সমর্পণ করলেন। পৃথিবীর মানচিত্রে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্রের নাম লেখা হলো ‘বাংলাদেশ’। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, শত শত মায়ের অশ্রু দিয়ে গড়া এই দেশ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল কাদের ‘একাত্তর আমার’ বইতে লিখেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আনুমানিক সকাল ১০টা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দফতর। ফোনে কথা শেষ করে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘নুরুল কাদের, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল ৪টায় আত্মসমর্পণ। অফিসের লোকজনকে খবরটা জানিয়ে দাও।’ আমার কাছে এই নির্দেশ প্রচণ্ড ভারী মনে হলো। কারণ এত বড় সংবাদ ঘোষণার অধিকার রাখেন একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ। সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষের সামনে আসতে বললাম। কাউকেই ঘটনার কথা বলা হলো না। অফিসের ৩০-৩৫ জন এসে কক্ষের সামনে দাঁড়ালেন। তাজউদ্দীন আহমদ এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ‘আজ থেকে আমরা স্বাধীন। অপরাহ্ণে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে।’ তখন আবেগে তার কণ্ঠ কাঁপছিল। সমস্বরে সবাই উল্লাসে স্লোগান দিলেন। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য।’
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ‘স্বাধীনতা ৭১’ বইয়ে লিখেছেন- ‘১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়াজি বিষণ্ন পাংশু মুখে কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন। তার কলমের কালিও সরছিল না। তাই তাকে অন্য একটি কলম দেয়া হলো। এই প্রথম তারা পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ স্বীকার করে নিলো।’
মেজর (অব:) এম এ জলিল ‘বিজয় অভিযান’ নিবন্ধে লিখেছেন- ‘১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলো। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ খুলনা সার্কিট হাউজে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াতের নেতৃত্বে দলটি আত্মসমর্পণ করল। তখন হাজার হাজার মানুষ আনন্দে আত্মহারা। পরাজিত ব্রিগেডিয়ার হায়াত মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করলেন। কোমর থেকে বেল্ট খুলে মিত্রবাহিনীর কাছে অর্পণ করলেন। উৎফুল্ল জনতার স্র্রোতে আমি হারিয়ে গেলাম। জনতার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে দিয়ে আমার স্বাধীন বাংলাকে প্রাণভরে দেখলাম।’
কবি শামসুর রাহমান ‘কালের ধূলোয় লেখা’ বইয়ে উল্লেখ করেন- ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতার অপরূপ সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হলো। বাংলাদেশ ঝলসে উঠল আনন্দধারায়। সেই মুহূর্তে স্বাধীনতার অপরূপ সূর্যোদয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে নেচে উঠেছিল হৃদয়, চোখ হয়েছিল অশ্রুভেজা। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন- ‘সে মুহূর্তে মনে হয়েছে, আমার দেশে কার্পাস ফুল ফুটেছে।’
পঞ্চাশের বাংলাদেশে
বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর এমন একসময়ে উপস্থিত, যখন পৃথিবী মোকাবেলা করছে এক মহামারী। এই করোনা মহামারীর ছোবলে বাংলাদেশে সাত হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। মহামারী সব কিছুই থমকে দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যেভাবে উদযাপন করার কথা সেভাবে করা যাচ্ছে না। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও একই সময়ে পড়েছে। বছরব্যাপী কর্মসূচি নিয়েও তা সেভাবে পালন করা যায়নি। করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের সুখবর আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই টিকা কখন পাবে, করোনা মহামারী থেকে মুক্তি কবে, সেটা কেউই জানে না।
তবে বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবসের আনন্দ মুহূর্তে দেশের মানুষের জন্য বড় সুখবর হয়ে এসেছে পদ্মা সেতুর স্বপ্নপূরণ। প্রমত্তা পদ্মার ওপর দেশের দীর্ঘতম ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের এই সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি বসেছে। জোড়া লেগেছে পদ্মার দুই পাড়- মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা। দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। আগামী দেড় বছরের মধ্যে এই সেতু চালু হবে। দক্ষিণাঞ্চলে রেল যোগাযোগ নেই। এই সেতুর ফলে যশোর পর্যন্ত রেল যোগাযোগও স্থাপিত হবে। এর আগে যমুনা নদীতে নির্মিত হয়েছে যমুনা সেতু।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচেছে। রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট সারা দেশকে সুতোর মতো গেঁথে দিয়েছে। খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কৃষি ক্ষেত্রেও উন্নতি উল্লেখযোগ্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিশ্বকাপে খেলছে। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া এখন আমাদের স্বপ্ন।
অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রত্যয়, গণতন্ত্র বাংলাদেশে বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। মাত্র ১০ বা ৫ শতাংশ ভোটেই নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়। আবার দেশে ভোটার ছাড়াও নির্বাচন হচ্ছে। দিনের ভোট রাতে হয়। অপরাজনীতি রাজনীতির পোশাক পরে আছে। লাইনচ্যুত ট্রেনের মতো রাজনীতি লক্ষ্যচ্যুত। জনগণ রাজনীতিবিমুখ হয়ে গেছে। সুশাসন অনেকটাই নির্বাসনে চলে গেছে। এখন প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক গণতন্ত্রে দেশ চলছে। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার সঙ্কুচিত। অনেকটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণই হোক ৫০তম বিজয় দিবসের ভাবনা ও অঙ্গীকার। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তাদের যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা রয়েছে, তা দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনবে, সেটিই সবার চাওয়া।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা