০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


করোনার অভ্যন্তরীণ প্রতি-অভিবাসন সৃষ্টি ও ক্যাশ ওয়াক্ফ

করোনার অভ্যন্তরীণ প্রতি-অভিবাসন সৃষ্টি ও ক্যাশ ওয়াক্ফ - ছবি : নয়া দিগন্ত

বিশ্ব এখন একটি মহা দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস নামে এই মহাদুর্যোগ কত দিনে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে তা কেউ জানে না। সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ এই দুর্যোগের সবচেয়ে বড় শিকার। করোনা মহামারী শুরু হওয়ার আমাদের আশপাশের চিত্রও অনেকটা পাল্টে গেছে। ঢাকা শহরে আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য নেই। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। মে মাসে ব্র্যাক পরিচালিত এক জরিপের ফল উল্লেখ করে সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোক চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ শতাংশই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ শতাংশ। করোনা শুধু আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনেনি, মানসিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেছে। করোনায় কাজ হারানো, চাকরি হারানো মানুষগুলোর যদি আবার কর্মসংস্থানের সুযোগ না হয়, তাহলে আরো বিপদ। যে লোকটা বাড়িভাড়া দিতে না পেরে গ্রামে ফিরে গেলেন, তার জীবনমান নেমে যাবে। একই সাথে বাড়িওয়ালারও জীবনমান নামবে। করোনায় জীবনের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা ভেঙে যাচ্ছে।

করোনার একটি বিপরীত চিত্রও আছে। করোনায় মৃত্যু হচ্ছে, মানুষ কর্মহীন হচ্ছে, আমরা লড়াই করছি। কিন্তু প্রত্যেক বেদনার সাথে যেমন একটি সুখানুভূতিও জড়িয়ে থাকে, প্রতিটি ব্যর্থতার মধ্যেও যেমন কিছু সুযোগ থাকে, প্রতিটি দুর্যোগের মধ্যে যেমন আশার রশ্মি থাকে তেমনি করোনা মাহমারীকেও একইভাবে আমি বিবেচনা করতে চাই। দুর্যোগকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করতে পারলে আমরা অনেক সহজে এগিয়ে যেতে পারব। করোনার সংক্রমণ হয়েছে; আমরা একে মোকাবেলা করব। এটা একটি দিক। আবার এই মহামারী দেখা দেয়ার পর বিশ্বে পরিবেশ দূষণ, নদীদূষণ অনেকটা কমেছে বলে যেটা বলা হচ্ছে, সেটা আরেকটি দিক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে সংবাদ মাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল মহানগরী ঢাকার বায়ু সহনীয় মাত্রার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দূষিত। এখন সেই অবস্থা নেই। এটা পরীক্ষণ ছাড়াই আমরা অনুভব করতে পারছি। করোনা অভ্যন্তরীণ প্রতি-অভিবাসনও সৃষ্টি করেছে। মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে। এরা কি সহজে আবার নগরমুখী হতে পারবে? বর্তমান পরিস্থিতি তা বলে না। তাহলে তাদের কী হবে? তাদের জন্য গ্রামাঞ্চলেই আমাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই আমি বলছি, আমাদের নেতাদের উচিত হবে ব্যর্থতার মধ্যে সফল হওয়ার উপাদান খুঁজতে যাওয়া। আমিও আজীবন এই চেষ্টা করেছি। এরই আলোকে আমি বর্তমান মহা দুর্যোগকালে কর্মসংস্থানের হাতিয়ার হিসেবে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক খাতের অন্যতম অনুষঙ্গ ক্যাশ ওয়াক্ফ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে চাচ্ছি। ইসলামী অর্থব্যবস্থার একটি অংশ এই ক্যাশ ওয়াক্ফ (এর ইতিহাস সম্পর্কে নয়া দিগন্তের কলামে ইতোপূর্বে লিখেছি) নিয়ে আমি যখন চিন্তাভাবনা শুরু করি তত দিনে বিশ্বের অনেক দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অটোম্যান স্কলাররা পঞ্চদশ শতকের দিকে এই ধারণা দেন। কিন্তু ইসলামী শরিয়ার যাবতীয় বিধান অক্ষুণ্ন রেখে এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে না পারায় প্রায় ৫০০ বছর ধারণাটি অগ্রসর হতে পারেনি। ওয়াক্ফ খাতে সবসময়ই ধনীদের প্রাধান্য ছিল। মূলত ওয়াক্ফ করা হতো ভূ-সম্পত্তি। আমাদের দেশেও ৯০ শতাংশ মসজিদ ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওয়াক্ফ করার মতো ভূসম্পত্তির অভাব দেখা দিলে ইসলামের এই কল্যাণময় ক্ষেত্রটির বিকাশ কি থেমে যাবে? এই প্রশ্নের সমাধান হলো ক্যাশ ওয়াক্ফ।

আমি আইডিবির রিসার্চ সেন্টারের দায়িত্বে থাকাকালে ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আমাকে ইসলামী বিশ্বে ওয়াক্ফের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করতে বলেন। এ কাজ করতে গিয়ে অটোম্যান আর্কাইভে ওয়াক্ফ সম্পর্কে সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডারের সন্ধান পাই। সেখান থেকে ক্যাশ ওয়াক্ফ সম্পর্কে অটোম্যান পণ্ডিতদের ধারণা সম্পর্কে জানতে পারি। মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়েও ওয়াক্ফ বিষয়ক লিটারেচারের বিশাল ভাণ্ডার আছে। আসলে আমার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে ওয়াক্ফের অবস্থা কী নিয়ে গবেষণা করা। অটোম্যান পণ্ডিতদের ধারণা থেকে আমার মনে ক্যাশ ওয়াক্্ফকে ইসলামী অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসার ভাবনা উদয় হয়। ১৯৯৮ সালে আমার উদ্যোগে সোস্যাল ইসলামিক ব্যাংক (এসআইবিএল) প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে আমি ক্যাশ ওয়াক্্ফ প্রবর্তন করি। এর পরের বছর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়; যেন তাদের একটি সেমিনারে গিয়ে ক্যাশ ওয়াক্ফের ধারণাটি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করি। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে তৃতীয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ফোরামে (১ অক্টোবর, ১৯৯৯) ‘ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট-এন ইনোভেশন ইন ইসলামিক ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্ট’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। এতে ক্যাশ ওয়াক্ফ কিভাবে একবিংশ শতকে স্বেচ্ছাসেবক খাতের ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক পুঁজিবাজার উন্নয়নে বৈশ্বিক সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করি। হার্ভার্ডের ওই প্রেজেন্টেশনের পরই মূলত ক্যাশ ওয়াক্ফের ধারণটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আমি দেশে ফেরার পর এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে আমন্ত্রণ পাই।

সহজ কথায়, ক্যাশ ওয়াক্ফ হচ্ছে সমাজের বিত্তশালী জনগোষ্ঠীর সঞ্চয়ের একটি অংশ থেকে অর্জিত আয় বিভিন্ন ধর্মীয়, শিক্ষা ও সামাজিক সেবায় বিনিয়োগের একটি মহৎ প্রয়াস। অর্জিত আয় ওয়াক্ফ সম্পত্তির মতোই পূর্ব নির্ধারিত বিভিন্ন খাতে ব্যয় করা হবে। এই প্রয়াস বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া হলো ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট। যিনি তার অর্থ ওয়াক্ফ করছেন তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট পাবেন। তিনি যে অর্থ ওয়াক্ফ করেছেন তার একটি স্বীকৃতিপত্র এটা। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটি ওয়াক্ফকৃত অর্থ বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করবে। সেই মুনাফা ওয়াকিফক্ফ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করা হবে। কিন্তু ওয়াক্ফকৃত মূল অর্থ অক্ষুণ্ন থেকে যাবে।

যেকোনো ওয়াক্ফের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ ও মানবতার কল্যাণ। এর পেছনে আরো বড় যে উদ্দেশ্যটি বিশেষভাবে কাজ করে তা হলো ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। সমাজ ও মানবতার কল্যাণ করতে কোন ধর্মেই নিষেধ করা হয়নি। ফলে অমুসলিমরাও এ ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। একজন মানুষ নিজের, পরিবারের এবং সামাজিক কল্যাণে ক্যাশ ওয়াক্ফ করতে পারেন। মানুষ মরণশীল। ইসলাম বলে কারো মৃত্যুও পর তার সব কাজের অবসান ঘটবে শুধু তিনটি জিনিস ছাড়া। এর একটি হলো সাদকায়ে জারিয়াহ। ক্যাশ ওয়াক্ফই সাদাকায়ে জারিয়ার একটি রূপ। নিজের জন্য এটা করা যায় বা বাবা-মার পরকালীন কল্যাণের জন্য এটা করা যায়। বিত্তশালী বা প্রতিষ্ঠিত কেউ সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে চাইলে এটা করতে পারেন। তার ওয়াক্ফকৃত অর্থের লভ্যাংশ দিয়ে মসজিদ, মক্তব, মাদরাসা, স্কুল, কলেজসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপন/পরিচালনা করা যায়। কেউ নিজের বা পরিবারের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে তার ব্যয় নির্বাহে ক্যাশ ওয়াক্ফ করতে পারেন। তাছাড়া এর মাধ্যমে গরিব জনসাধারণকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যেতে পারে। ধরা যাক কেউ এলাকায় একটি মসজিদ করেছেন। তিনি হয়তো চান না যে সেই মসজিদটি দান/খয়রাতের মাধ্যমে পরিচালিত হোক। তখন তিনি এমন পরিমাণ একটি অর্থ ওয়াক্ফ করতে পারেন যার অর্জিত মুনাফা দিয়েই মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন বা খাদেমদের ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হবে। কেউ চাইলে ক্যাশ ওয়াক্ফের অর্জিত মুনাফায় দরিদ্র পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। এমন অসংখ্য খাত রয়েছে যেখানে মানব কল্যাণে ক্যাশ ওয়াক্ফ করা যায়। আপনার সাময়িক দানের অর্থ দিয়েই যুগ যুগ ধরে সমাজের মানুষ সুফল ভোগ করে চলবে।

সাধারণভাবে আমরা যে দান, সাদাকাহ করি সেটা স্বল্পস্থায়ী ও অপরিকল্পিত। কিন্তু ক্যাশ ওয়াক্ফের দান পরিকল্পিত ও শাশ্বত। যেখান থেকে মানুষ অনন্তকাল সুবিধা পেতে থাকবে। আবার ওয়াক্ফকৃত অর্থ যেহেতু কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্থায়ীভাবে গচ্ছিত রাখা হবে; সেহেতু ওই প্রতিষ্ঠানটিও এই অর্থ বিনিয়োগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। এই অর্থ শুধু শরিয়াহ মোতাবেক বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিনিয়োগ করতে পারবে, যেমন : ১. স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ: ক্ষুদ্র ঋণ, টোকাই পুনর্বাসন, ইত্যাদি; ২. মধ্য মেয়াদি বিনিয়োগ : কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প, ক্ষুদ্র বস্ত্র শিল্প, ডেইরি ফার্ম, ইত্যাদি; ৩. দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ : বিভিন্ন ভারী শিল্প কারখানায় বিনিয়োগ ইত্যাদি। ক্যাশ ওয়াক্ফকে ইসলামী শরিয়াহসম্মত দান হিসেবে গ্রহণ করা হবে। ওয়াকিফের (সার্টিফিকেট ক্রেতার) পক্ষ থেকে ব্যাংক ওয়াক্ফ এর ব্যবস্থাপনা করবে। এই হিসাব ওয়াকিফের নামে চিরকাল চালু থাকবে। এই তহবিল শাশ্বত ও চিরন্তন হিসেবে বিবেচিত। ওয়াকিফ তার ইচ্ছেমতো কোনো ব্যাংকের নির্ধারিত এক বা একাধিক খাত বা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী শরিয়াহসম্মত যেকোনো খাত বাছাই করতে পারেন। আমি এসআইবিএলের চেয়ারম্যান থাকাকালে পরিবার পুনর্বাসন, শিক্ষা সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, সামাজিক উপযোগিতা সেবার মতো ৩২টি খাত নির্ধারণ করেছিলাম।

ক্যাশ ওয়াক্ফ আসলে একটি সামাজিক বা গণআন্দোলন হতে পারে। যে আন্দোলনে ধনী ও গরিবের ব্যবধানও ঘুচে যায়। একসময় ওয়াক্ফের ক্ষেতে ধনীদের যে একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল ক্যাশ ওয়াক্ফ সেই প্রাধান্য দূর করেছে। কোনো বাড়ির মালিক যেমন ক্যাশ ওয়াক্ফ করতে পারেন, তার গৃহকর্মীর এটা করতে পারেন। ক্যাশ ওয়াক্্ফ ধারণায় বলে এখানে কেউ চাইলে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে যত খুশি ওয়াক্্ফ করতে পারেন। সোস্যাল ইসলামিক ব্যাংকে প্রথমে এক হাজার টাকা ইউনিট করা হয়। পরে সেটা করা হয় ১০০ টাকা ইউনিট। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে এই ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট চালু করা হয়েছে। ক্যাশওয়াক্ফ সার্টিফিকেটের ডিজাইন আমি নিজেই করেছিলাম। এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট মিলিয়ে দেখা যাবে একটি আরেকটির ফটোকপি। চিরন্তন এই তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো যেমন উপকৃত হচ্ছে, তেমনি জনকল্যাণেও তারা কাজ করতে পারছে। ক্যাশ ওয়াক্ফের মুনাফা বিনা লাভে, সামান্য সার্ভিস চার্জে, ক্ষুদ্রঋণ হিসেবে বিতরণ করা যেতে পারে। কারণ এর কোনো ‘কস্ট অব ফান্ড’ নেই। ক্যাশ ওয়াক্ফ করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা হলো- মানুষ এ ধরনের দানের ক্ষেত্রে সাড়া দেয়। আজ ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ১০০ কোটি টাকার এই তহবিল রয়েছে। সোস্যাল ইসলামিক ব্যাংকেরও রয়েছে প্রায় ২৫-৩০ কোটি টাকার তহবিল।

ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে যে লভ্যাংশ ঘোষণা করবে সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ হারে ওয়াক্ফকৃত অর্থেরও লভ্যাংশ প্রদান করা হবে। ওয়াক্ফকৃত মূল অর্থ অক্ষত থাকবে, কেবল লভ্যাংশ ওয়াকিফ নির্ধারিত খাতে ব্যয় করা যাবে। অব্যয়িত লভ্যাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল ওয়াক্ফের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লভ্যাংশ আহরণ ক্রমান্বয়ে বাড়াবে। ওয়াকিফ তার ওয়াক্ফের নির্ধারিত সমুদয় অর্থ এককালীন জমা করতে পারেন। অথবা নির্দিষ্ট সমুদয় অর্থের ঘোষণা দিয়ে কিস্তিতে ধারাবাহিকভাবে শোধ করতে পারেন। সমুদয় অর্থ প্রদান সম্পন্ন হওয়ার পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি তাকে একটি সার্টিফিকে/সনদ প্রদান করবে। এটাই হলো ক্যাশ ওয়াক্ফ সার্টিফিকেট। যেকোনো মুসলমান চাইলে এ ধরনের এক বা একাধিক সার্টিফিকেট কিনতে পারেন।

আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক ওয়াক্ফ সম্মত্তি রয়েছে। এ দেশের মসজিদগুলোর বেশির ভাগ ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর গড়ে উঠেছে। পরিতাপের বিষয় ওয়াক্ফের এই বিশাল খাতটি অবহেলিত। এই খাতের সম্পদের উন্নয়নে যেমন নজর দেয়া হচ্ছে না, তেমনটি এটা দুর্নীতি ও লুটাপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেই বিবেচনায় ক্যাশ ওয়াক্ফ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দক্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (যেমন : ব্যাংক) মাধ্যমে এটা পরিচালিত হওয়ায় ওয়াকিফের আমানত যেমন স্থায়িত্ব লাভ করবে তেমনি বিভিন্ন সামাজিক খাতে পরিকল্পিতভাবে ব্যয় হবে। এর ফলে সমাজে নতুন কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হবে। বিপুল সংখ্যক বেকার জীবিক অর্জনের সুযোগ পাবে, সমাজে অগ্রগতি সাধিত হবে। ফলে সমাজে স্থায়ী শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এ ধরনের কাজ করা খুব একটা সহজ নয়। কেননা প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ের প্রকৃতিই এমন যে এ অর্থ স্থায়ী ও টেকসই কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ তেমন বেশ সুযোগ থাকে না।

ক্যাশ ওয়াক্ফের আরেকটি সৌন্দর্য হলো জনকল্যাণের এই অর্থ শুধু মুসলমানই ভোগ করবে এমন কথা নেই। ধর্ম, জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে ওয়াক্ফের সুফল ভোগ করতে পারে। শুধু মুসলিম দেশেই নয়, বহু অমুসলিম দেশেও বড় বড় মুসলিম কমিউনিটি রয়েছে। তারাও ক্যাশ ওয়াক্ফ তহবিল গঠন করতে পারে। আইডিবিতে থাকাকালে আমরা মুসলিম দেশগুলোর ওয়াক্ফ সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার ওপর একটি সেমিনার করেছিলাম। তখন আমি অবাক হয়েছিলাম যে, অনেক অমুসলিম দেশেও বিশাল ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়ে গেছে।
আজ যখন একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানবসভ্যতা বিপন্ন হতে চলেছে তখন ক্যাশ ওয়াক্ফের মতো সামাজিক আন্দোলনের খুবই প্রয়োজন। এ ভাইরাস কোনো জাতি, সম্প্রদায়, দেশ, সীমানা কিছু মানছে না। সবাইকে সমানভাবে আক্রান্ত করেছে। তাই বিভেদ দূরে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবেই এর মোকাবেলা করতে হবে। সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকগুলো, ভালো মানুষগুলো যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে, তা হলে দারিদ্র্য দূরীকরণে এই ক্যাশ ওয়াক্ফের চেয়ে বড় কোনো আন্দোলন আর হতে পারে না। বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নিত করার সরকারি ঘোষণার সঙ্গেও ক্যাশ ওয়াক্ফ আন্দোলন সঙ্গতিপূর্ণ।

লেখক : ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির অধ্যাপক, কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা

 


আরো সংবাদ



premium cement