১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


একুশে ফেব্রুয়ারি

-

জন্মের পর মায়ের মুখ থেকে আর নিকটজনের কাছ থেকে শুনে প্রথমে মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তাকেই আমরা মাতৃভাষা বলি। দুর্ভাগ্য আমাদের; মাতৃভাষা রক্ত দিয়ে কিনতে হয়েছে। ছাত্র- জনতার আত্মাহুতির মাধ্যমে রক্তাক্ত হয়েছে রাজপথ।
আমাদের মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার শেকড় বাকড়ের বিস্তৃত ইতিহাস জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বেশ খানিকটা পেছনের দিকে, ভাষা আন্দোলনের কাছে; ফিরে যেতে হবে ২১ শে ফেব্রুয়ারির কাছে।
কেমন ছিলো ভাষা আন্দোলনের সে দিনগুলী? কেনইবা ২১ শে ফেব্রুয়ারি? কী হয়েছিলো সে দিন?
৬৮ বছর আগের কথা।
নদীবিধৌত শ্যামল প্রকৃতির অবারিত হাতছানি, পাখ-পাখালির কল-কাকলি মুখরিত, সবুজ চাদরে মোড়া দেশটি তখন অবিভক্ত পাকিস্তান নামে পরিচিত। নানা বর্ণের, নানা ধর্মের, নানান ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস ছিল এ পাকিস্তানে। আমাদের আজকের বাংলাদেশটি ছিলো তথাকথিত পাকিস্তানের অংশ বিশেষ, যার নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান।
তদানীন্তন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ছিলো ইসলাম ধর্মাবলম্বী পাশাপাশি ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬ শতাংশ বাঙালি, ২৮.৪ শতাংশ পাঞ্জাবি, ৭.২ শতাংশ উর্দুভাষী, ৫.৮ শতাংশ সিন্ধি ভাষাভাষী, ৭.১পশতু ভাষাভাষী সেইসাথে ১.৮ শতাংশ ছিলো ইংরেজি ভাষাভাষী। বন্ধুরা, এখানে ১০৪.৯ শতাংশ দেখানো হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা যায় Ñ অনেকেই নিজেকে দোভাষী বলে জানিয়েছিলেন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসক সম্প্রদায় তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানে [ আজকের বাংলাদেশ ] বসবাসরত ৫৪.৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার করে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার পাঁয়তারা চালায়। মেতে ওঠে গভীর ষড়যন্ত্রে।
লড়াকু বাঙালি মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে গর্জে ওঠে। শাসকচক্র এর সুদূরপ্রসারী পরিণাম বুঝতে পেরে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে তড়ি-ঘড়ি করে “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” নামে প্রস্তাবটি পাশ করিয়ে নেয়। উপেক্ষিত হয় বাংলার প্রাণের দাবি।
শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাষার দাবিতে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁরা উপলব্ধি করে মাতৃভাষা তাঁদের অহঙ্কার। ভাষার দাবিতে কোনো আপষ নয়।
“আমি আগের বছর বি.এ পাস করেছ্,ি সনদ গ্রহণের জন্য কার্জন হলে সমাবর্তন সভায় যাই, যথারীতি সমাবর্তন শুরু হলো; জিন্নাহ প্রধান অতিথির ভাষণের এক পর্যায়ে তার রেসকোর্স ময়দানের বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি করে বললেন- ‘উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ।’ একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম-
‘নো নো ।’ সভায় সনদ গ্রহণের জন্য আগত অন্যান্য সদস্য আমার মতো একই ধ্বনি তুললেন ‘নো নো ।’ জিন্নাহ বিমর্ষ হয়ে গেলেন। ভাষা সম্পর্কে তিনি আর বক্তব্য বাড়ালেন না। [ একুশের পটভূমি একুশের স্মৃতি / সম্পাদক মতিউর রহমান / পার্ল পাবলিকেশন / প্রথম আলো / একুশের বইমেলা / পৃষ্ঠা ২০০৩ ,৭৩ এবং ৭৪}
শাসক চক্রের রক্তচক্ষু ভয়ভীতির পাশাপাশি জেল জুলুম এড়িয়ে বাঙালি সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তোলে ‘ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ’। ভাষার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি বুঝতে পারে ভাষার দাবিই বাঙালির প্রাণের দাবি।
শাসকচক্রের ভিত নড়ে ওঠে। আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য শাসক নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। নিষিদ্ধ করা হয় সব ধরনের সভা সমাবেশ। হুলিয়া, হামলা, মামলা আর গ্রেফতারের মাধ্যমে আন্দোলন দমাবার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় সরকার। পাকিস্তানি শাসকচক্র আর শোষিত বাঙালি জনগোষ্ঠী মুখোমুখি হয়।
২১ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল। মিটিং, মিছিল, পথসভায় রাজপথ মুখরিত। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতি বার। সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর ছাত্র-জনতা । সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রের মতানুসারে; বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে গাজিউল হকের নেতৃত্বে বেলা ১১ টায় ১০ জনের একটি দল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া মাত্র পুলিশ বাধা দেয়। শুরু হয় পুলিশ জনতা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। শাসকশ্রেণির প্রতি বাংলার জনগণের ঘৃণার বহির্প্রকাশ হিসেবে বৃষ্টির মতো নিক্ষিপ্ত হয় ইট পাটকেল; সেই সাথে পুলিশের নিক্ষিপ্ত টিয়ার গ্যাস আর রাবার বুলেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ-পাশ এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
সময় গড়িয়ে যায়, ছাত্র জনতার প্রতিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। জনজোয়ার রুখবার সাধ্য কার? বিকাল ৩.১০ মিনিটে পূর্ব পাকিস্তানের জেলা প্রশাসক এ এইচ কোরাইশি
সি এস পি’র নির্দেশে একদল সশস্ত্র পুলিশ দু’দফায় ২৭ রাউন্ড গুলি চালায়। [ একুশের দলিল/ এম এর আখতার মুকুল/ সাগর পাবলিশর্স/ পৃষ্ঠা ৫১ এবং ৬৩। ] কালো রাজপথ ছাত্র- জনতার রক্তে লাল হয়ে ওঠে। ঘাতক বুলেট কেড়ে নেয় ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম . এ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবুল বরকত, মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র রফিকউদ্দিন আহমেদ, ময়মনসিংহ নিবাসী আব্দুল জব্বার, তখনকার শিল্প ডাইরেক্টরেটে কর্মরত আব্দুস সালামসহ আরো অনেকের।
বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে লড়তে হয়েছে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলে ১৯৫৬ সালে।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হলে সংবিধানের ২১৪ (১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়Ñ 'ঞঐঊ ঝঞঅঞঊ খঅঘএটটঅএঊ ঙঋ চঅকওঝঞঅঘ ঝঐঅখখ ইঊ টজউট অঘউ ইঅঘএঅখও'.
বুলেট, বেয়োনেট ,নির্যতন আর শাসকের রক্তচক্ষু অবজ্ঞা করে যে সব অকুতোভয় ভাষাসৈনিক আত্মাহুতি দিয়েছেন; বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে তাদের তথা সকল শহীদের আত্মদানের মহিমা এবং বাঙালির শৌর্য ও বীরত্ব হৃদয়ে লালন করবে, মনে রাখবে পরম শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়।
বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করবে কানাডার ড্যাংকুভারে বসবাসরত বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ও তার বন্ধু সালামের কথা। মহান ভাষা আন্দোলনের ত্যাগ ও তিতিক্ষার কথা মাথায় রেখে মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি তাঁরা জাতিসংঙ্ঘের মহাসচিব মি: কফি আনানের কাছে চিঠি দেন তার মূল বিষয়বস্তু ছিলোÑ “বিশ্বের প্রতিটি ভাষার প্রতি সম্মান জানানোর জন্য বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস প্রতি বছর পালন করা হোক; এবং যেহেতু বাঙালিরা তাঁদের মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে সে জন্য ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হোক।”
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর সর্বসম্মতভাবে ইউনেস্কোর প্রথম ও দ্বিতীয় কমিশন বাংলাদেশের প্রস্তাব গ্রহণ করেন।। অর্থাৎ বিশ্বে ১৮৮টি দেশ কতৃক মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য এটি অভূতপূর্ব সম্মানের ঘটনা। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আজ আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার।

 


আরো সংবাদ



premium cement
পরকীয়া প্রেমিক যুগলের গলায় জুতার মালা : চেয়ারম্যান বরখাস্ত সমাবেশে যোগ দিতে নয়াপল্টনে জড়ো হচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা রংপুরে রেয়াত পদ্ধতি চালুসহ ৪ দফা দাবিতে মানববন্ধন নতুন কোচের সন্ধানে বিসিসিআই, তাহলে কি দ্রাবিড়ের বিদায়! থাইল্যান্ডে এ বছর হিটস্ট্রোকে ৬১ জন প্রাণ হারিয়েছে : সরকার নির্বাচন শেষ হলে আরো সত্য ঘটনা সামনে আসবে, ধর্ষণের অভিযোগ প্রসঙ্গে শাহজাহান রাণীনগরে সাজাপ্রাপ্ত আসামিসহ গ্রেফতার ৪ যান্ত্রিক ত্রুটি নিয়ে চট্টগ্রামে জরুরি অবতরণ, প্রাণে বাঁচলেন ৭ ক্রুসহ ১৯১ যাত্রী ভূরুঙ্গামারীতে ভটভটিতে উঠতে গিয়ে শিশু নিহত প্রতিটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল করতে সরকার কাজ করছে : প্রধানমন্ত্রী দুমকীতে হত্যা মামলার আসামি বাবা-ছেলে গ্রেফতার

সকল