২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টেলিমিডিয়ায় ‘বাবা-মা’ সঙ্কট

-

আমার আব্বা আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান কম বয়সেই। মাত্র অবসর নিয়েছিলেন সরকারি চাকরি থেকে, তখনই আক্রান্ত হয়েছিলেন কর্কট রোগে, আর বছর ঘুরতেই চিরবিদায়। এই যে বছর খানেক, তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, এ সময়েও কখনো তাঁর অভাব বোধ করিনি।
তখন আমিও সবে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে চাকরি নিয়েছি, সংসারের হাল ধরে ফেলেছিÑ সংসারের সব কিছুই চলছিল নিয়ম মতোই। শুধু বাবা বিছানায়Ñ এটুকুই ব্যতিক্রম। কিন্তু যেদিন চলে গেলেনÑ সেদিনই মনে হলো মাথার ওপর থেকে ছাতাটা সরে গেল, যে বটবৃক্ষ এতদিন তার ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে আগলে ছিলেন আমাদের সেই গাছটি হঠাৎই নাই হয়ে বিরাট এক গহ্বর সৃষ্টি করল আমার জীবনে।
আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। জীবনের কঠিন পথ পরিক্রমায় আব্বাকে দেখেছি কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু সদাহাস্য মানুষটি কখনোই বুঝতে দেননি তাঁর কষ্ট বা সমস্যা। একটা অনুপ্রেরণার আধার ছিলেন তিনি।
এটাই তো বাবা। বাবারা তো এমনই হবে। বটবৃক্ষ। সংসারে বাবা থাকলে তার রূপটা যেন পূর্ণতা পায়, সেই পূর্ণতাকে শুষমামণ্ডিত করেন মা। মা-বাবা এঁরাই তো বাঙালি পরিবারের প্রাণ। এক বাড়িতে মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করাটাই তো জীবনের মাধুর্য।
তাই তো এ দেশের নাটক-সিনেমার গল্পগুলো গড়ে উঠেছিল এমনই পরিবার নিয়ে। এদের ছোট-বড় সমস্যা, আনন্দ, দুঃখ-বেদনা নিয়েই দর্শকের মন জয় করত এ দেশের নাটক-সিনেমা।
আসলে আজ আমি লিখতে বসেছি, আমাদের টেলিমিডিয়ায় ‘বাবা-মা’ সঙ্কট নিয়ে। দর্শকমাত্রেরই আজ অভিযোগ বাবা-মা হঠাৎ করে টেলিভিশন নাটক থেকে হারিয়ে গেলেন কেন!
তাই তো। কী এমন ঘটল যে, দেশের প্যাকেজ শিল্পের আওতায় নির্মিত টিভি নাটক থেকে কেন উধাও হলেন মা-বাবা?
একটু খোলসা করার চেষ্টা করা যাক তাহলে।
টেলিমিডিয়ায় কিছুকাল থেকে ‘মা-বাবা’ সঙ্কট বেশ প্রতীয়মান হচ্ছে। অধিক সংখ্যক নাটকেই বাবা-মাকে দেখা যাচ্ছে না গল্পে। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা, সাথে দু’চারটে অল্প গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দিয়ে নাটকের কাহিনী গড়ে উঠছে।
এর কারণ কী?
মূল কারণ, বাজেট সঙ্কট। প্যাকেজ পদ্ধতির শুরুতে নাটকের বাজেটের ধরাবাধা কোনো পরিমাণ ছিল না। নাটক নির্মাণে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হতো, সেই পরিমাণ অর্থই লগ্মি করতেন প্রযোজকরা। তাতে চরিত্র সংখ্যা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথাও ছিল না। নাটক অধিকাংশই হতো পারিবারিক গল্প নিয়ে। সেখানে বাবা-মা বেশ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে বিদ্যমান ছিলেন।
নাটকের শিল্পীদের সম্মানির ব্যাপারেও একটি অন্য ধারা প্রচলিত ছিল। যেমন প্রবীণেরা নবীনদের চেয়ে বেশি সম্মানি পেতেন। এতে কারো কোনো রকম সমস্যা ছিল না।
ক্রমেই এই মিডিয়াটা অধিকতরভাবে বাণিজ্য হিসেবে গড়ে উঠতে লাগল। বেশ বড় একটা ইন্ডাস্ট্রিই হয়ে গেল। তখনই শুরু হয়ে গেল সমস্যা।
কমতে থাকল বাজেট। তারকা নায়ক-নায়িকাদের সম্মানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করল অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে। ফলে নির্দেশকরা পড়লেন বিপাকেÑ আগে যেখানে পনের, দশ, পাঁচ লাখ টাকায় নাকট নির্মিত হতো, হালে তা এসে দাঁড়ায় এক লাফে বিশ থেকে দুই লাখে। যারা নাটক নির্মাণে বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন নিয়ে এই পেশায় এসেছিলেন তারা পড়লেন বিপাকে। টাকা কম হওয়ায় প্রথমত শুটিং খরচ কমানো হলো অর্থাৎ শুটিংয়ের সময় দু’দিন, দেড় দিন এমনকি একদিনেও এসে ঠেকল। এতে তো মান রক্ষা হয় না। আরো কমাও খরচ।
কোপ পড়ল বাড়তি চরিত্রের ওপর। সেগুলো ঝরতে লাগল একে একে। তাতেও কুলায় না। এবার বাদ যেতে লাগলেন প্রকৃত নাট্যকার পেশাগত সঙ্গীত পরিচালক সেট ডিজাইনার অডিও মেকআপ আর্টিস্ট লোকেশন বাছাবাছির গেল বালাই উঠেÑ বাধা কয়েকটা হাউজে আবদ্ধ হলো শুটিং।
সর্বশেষ কোপটা এসে পড়ল বাবা-মার চরিত্রে। এর আগে অবশ্য গৃহকর্মীদের বাতিল করা হলো, কারণ তারা নাকি টিভি পর্দার সৌন্দর্য নষ্ট করে। যাই হোক বাবা-মার চরিত্রগুলোতে সাধারণত অভিনয় করেন অভিজ্ঞ সব অভিনেতা-অভিনেত্রী। তাদের সম্মানটাও সাধারণত অন্য শিল্পীদের চেয়ে (নায়ক-নায়িকা বাদে) বেশি। সুতরাং চালাও কাঁচি। কাঁচি চলতে চলতে এমন হাল হলো যে, নাটকের ছেলেমেয়েরা প্রায় সব এতিম হয়ে গেল। কদাচিত বাবা থাকলে, তিনি হন বিপতœীক, আর মা হলে বিধবা। গল্পে তাদের অবস্থানও হয়ে যায় প্রায় গুরুত্বহীন। ভাই-ভাবীর অবস্থাও তথৈবচ। ভাই সাধারণত বিদেশে থাকেন, নয়তো ভাবী রাগ করে বাপের বাড়িতে। প্রায়ই তারা নিঃসন্তান। এর ফলে অনেক প্রবীণ শিল্পীর কাজ কমে যায়, অনেকে হয়ে পড়েন কর্মহীন। দর্শক যে এই পরিবারহীন রোমান্টিক নায়ক নায়িকাদের নাটক পছন্দ করেছেন তা নয়। এক শ্রেণীর দর্শক হয়তো বা হাততালি দিয়ে লাইক আর ভিউ বাড়িয়েছেন কিন্তু আমজনতা মুখ ফিরিয়ে নিলেন এ ধরনের নাটক থেকে। ইউটিউবে পুরনো নাটকে দর্শকদের মন্তব্য পড়লেই আমার কথার সত্যতা জানতে পারা যাবে।
অবস্থা যখন এমন, দেশের মিডিয়াগুলোও সোচ্চার হয়ে উঠল এ ধরনের গল্প কাঠামোর বিরুদ্ধে। বাঙালির শাশ্বত ঐতিহ্যকেই যেন বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে এসব নাটকে। প্রচুর, সমালোচনার মধ্যেই কেউ একজন অসহায় বাবা-মা মাকে নিয়ে নাটক বানালেন আর সেটা ভীষণ রকম সাড়া ফেলেছিল সোস্যাল মিডিয়ায়।
ব্যস, আর যায় কোথায়। এবার সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল বাবা-মাকে নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে। এই লেখক এখন প্রায় প্রতিদিনই একটি করে ফোন কল পাচ্ছে বাবার চরিত্রে অভিনয়ের জন্যÑ যেখানে বাবা অথবা বাবা-মা গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বেশ আবেগী সব চরিত্র। তাহলে বাবা-মাকে নিয়ে যে সঙ্কট মিডিয়ায় ছিল, তা কি শেষ হলো! আবার কি দর্শক যথাযথ বাঙালি পারিবারিক নাটক দেখতে পাবে?
আমার মনে হয়, না। সমস্যার সমাধান হয়নি। এও ব্যবসায়িক চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ। দু’দিন পরই দেখা যাবে অন্য কোনো ধারায় ছুটেছে সবাই গড্ডালিকার মতো।
তাহলে এর সমাধান কী?
সমাধান একটাই। বাজেট যথাযথ হতে হবে। নাটক লেখাটা নাট্যকারকেই করতে হবেÑ যারা বিভিন্ন মাত্রার গল্প নিয়ে দর্শকের সামনে আসবেনÑ আর তাতে যা খরচ হবে সেই পরিমাণ অর্থ নির্মাতাকে দিতে হবে নাটকটি নির্মাণের জন্য। মোটকথা নির্মাতার স্বাধীনতাকে একশ’ পার্সেন্ট মূল্য দিতে হবে এবং নির্মাতাকেও নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তিনি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো কারণে আপস করবেন না।
আমার মনে হয়, তবেই হয়তো টিভি নাটক আবার সেই সোনালি দিনে ফিরে আসবে। হ

লেখক : অভিনেতা, নাট্যকার, কথাশিল্পী


আরো সংবাদ



premium cement