চার দিকে গভীর অন্ধকার। চুপচাপ নীরবতা ছড়িয়ে আছে। সারা দিনের প্রচণ্ড গরম শেষ করে এখন বেশ ঠাণ্ডা আবহাওয়া জেঁকে বসেছে। লোকজন খুব দ্রুত কাজ শেষ করে যার যার ঘরে ঢুকে পড়েছে। দূরে দু-একটি বাড়ি ছাড়া কোথাও আলোর দেখা নেই। হতে পারে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে অথবা আলো নিভিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
অন্ধকারে রাস্তাঘাট ভালো দেখা যায় না। তার মধ্যে এক পথিক হেঁটে যাচ্ছে। সুনমান নীরবতা কিংবা শীত কোনো কিছুরই পরোয়া নেই। লোকটা চিকনা শুকনা হলেও বেশ পেটানো শরীর। দিনের আলোয় যে কেউ দেখতে পেত তার চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ। উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে একই সাথে খানিকটা চিন্তার রেখা। খুব ব্যস্ততা নেই এমনভাবে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে এদিকে ওদিকে একটু খেয়াল করছেন। কাউকে খুঁজছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
হাঁটতে হাঁটতে পথিক একটু দাঁড়ালেন। কোথা থেকে যেন শব্দ আসছে। কান পেতে আরেকটু ভালো করে শোনার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, মনে হচ্ছে কোথাও বাচ্চা ছেলে কাঁদছে। কিন্তু কাছাকাছি তো কোনো বাড়ি চোখে পড়ছে না। তাহলে কান্নার শব্দ আসছে কোত্থেকে? তার কান ভুল শোনেনি। আবার ভালো করে এদিক ওদিকে তাকিয়ে খুঁজলেন।
শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। একটু পেছনে ফেলে আসা একটি বাড়িতে সামান্য একটু আলো জ্বলছে। কান্নার শব্দ সেখান থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটি নয় কয়েকটি ছেলেমেয়ে, কেউ একটু কাঁদছে, কেউ কথা বলছে, কেউ আবার আবদার করে কিছু চাচ্ছে। বাচ্চা কাচ্চাদের কাজ ভেবে পথিক আবার হেঁটে চলে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। একটু আগাতেই আবার মনের মধ্যে খচখচ করছে। রাত তো কম হয়নি। এখনো বাচ্চারা জেগে আছে! এর বাবা-মা’ই বা কি করছে। ওরা কান্নাকাটি করছিল কেন? পথিক কৌতূহলী হয়ে ভাঙা প্রাচীরের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন।
একটি চুলায় জ্বাল ঠেলছেন এক মহিলা। চুলার চার পাশে কয়েকটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এদিক সেদিক বসে আছে। কারো কারো চোখে তখনো পানির ছাপ দেখা যাচ্ছে। পথিক মহিলার কথাবার্তা অল্প অল্প টের পাচ্ছিলেন। মহিলা বাচ্চাদের বুঝাচ্ছেন আরেকটু সময় অপেক্ষা করার জন্য। কোনো রকমে ছেঁড়া কাপড় গায়ে জড়িয়ে ওরাও অপেক্ষায় আছে। মহিলার কোলের একদম ছোট বাচ্চাটি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকিদেরও ঢুলু ঢুলু চোখ। পথিক খুব অবাক হলেন মহিলার কাজকর্ম দেখে। প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন এত রাত করে রান্নাবান্না করার জন্য। ছোট ছেলেমেয়েদের শুকনো মুখ দেখে ভীষণ খারাপ লাগছিল তার। বাচ্চারা না খেয়েই এক-দু’জন করে ঘুমিয়ে পড়ছে। জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনিও অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন ওরা খেতে পাবে তার জন্য। কী এমন রান্না হচ্ছে যে এত সময় লাগছে!
অনেকক্ষণ পরে মহিলার রান্না মনে হয় শেষ হলো। চুলা নিভিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। পথিক দেখলেন বাচ্চারা সবাই ঘুমে ঢলে পড়েছে আর মহিলা বাচ্চাদের ঘুম থেকে না ডেকে বরং গায়ের কাপড় ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে নিজেও শোয়ার আয়োজন করতে লাগলেন। কী বোকা এই মহিলা! তার কি কোনো মায়া দয়া নেই!
পথিকের আর তর সইছে না। টক টক করে দরজায় নক করে বসলেন। মহিলা একটু চমকে উঠলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন কে?
-জ্বি আমি একজন পথিক
- এত রাতে ...
-ভয় পাবেন না। আমি চোর ডাকাত নই। আপনাদের প্রতিবেশী, এ শহরেই থাকি।
মহিলা তবু নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। কিছুক্ষণ কি ভাবেন তারপর আস্তে দরজা খুলে মাথা বের করে দেন।
-কে আপনি, কাকে খুঁজছেন।
-মাফ করবেন। আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। এ পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম, মনে হয় আপনার ঘর থেকেই বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলাম।
-হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন।
-আমি জানতে চাচ্ছিলাম, এত রাতে ওরা কান্নাকাটি করছিল কেন, মানে কোনো সমস্যা?
-ওদের আসলে খুব ক্ষুধা পেয়েছিল।
-কিন্তু আপনি মনে হয় কিছু রান্না করছিলেন।
-আমি আসলে কিছুই রান্না করিনি।
-আপনি কিছুই রান্না করেননি মানে? আপনি এতক্ষণ চুলায় রান্না করছিলেন যে...
মহিলা একটি করুণ দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, আপনি যখন নাছোড়বান্দা তখন বলছি শুনুন। আমি খুবই অসহায়। বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাই। সব সময় খাবার জোটাতে পারি না। আজও তেমনই অবস্থা। রাতের কথা বলে বাচ্চাদের দুপুরে ঘুম পাড়িয়েছি। ভেবেছিলাম রাতে একটি ব্যবস্থা হবেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে রাতেও কিছুই করতে পারিনি। এখন ঘণ্টা ধরে চুলায় পানি আর নুড়ি পাথর জাল দিয়ে বাচ্চাদের বুঝ দিয়েছি। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। এভাবেই রাত কেটে যাবে।
শুনতে শুনতে পথিকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে পড়ে। মাথা নিচু করে কী যেন ভাবেন তিনি। তারপর মহিলাটিকে একটু সময় অপেক্ষা করতে বলে প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন। দৌড়ের উপরেই আবার ফিরে এলেন অল্প সময়ের মধ্যে। তার কাঁধে একটি বড় ব্যাগ এবং সাথে একজন মহিলা। হয়তো তার স্ত্রী হবেন। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে ময়দা বের করে রুটি বানালেন, সুজি পাকালেন, তারপর বাচ্চাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে পেট ভরে খাওয়ালেন। মহিলা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন। সবার খাওয়া শেষে পথিক তার ব্যাগ মহিলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন এতে যে অর্থ আছে তাতে আপনার আরো কয়েক দিন চলে যাবে। তারপর ঝটপট সাথের মহিলাকে নিয়ে বের হয়ে পড়লেন। মহিলা ততক্ষণে সম্বিত ফিরে পেলেন। পেছন থেকে ডেকে বললেন, হে পথিক, আমি খুবই কৃতজ্ঞ আপনার কাছে; কিন্তু আপনার এবং আপনার সঙ্গী মহিলার পরিচয় তো জানা হলো না।
-আমি সামান্য একজন মানুষ, অন্যদের খোঁজ খবর রাখাই আমার দায়িত্ব। এর বেশি আর পরিচয় দেয়ার মতো কিছু নেই।
পথিক আর দেরি না করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। মহিলা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভাবতে লাগলেন, কে এই দয়ালু লোকটি। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ! কই আগে তো দেখিনি! লোকটি কি রাতের পাহারাদার? কিন্তু তাহলে তার হাতে লাঠি কিংবা অস্ত্রপাতি থাকত। গায়ে পাহারাদারের পোশাকও থাকত। কোনো সরকারি লোক নাকি! না, তাও হবে না। সরকারি লোকের এত গরজ কিসের গভীর রাতে এসে উপকার করতে যাবে? ঝটপট এত খাবার দাবারইবা আনবে কোত্থেকে?
রাতের প্রহর বেড়েই চলছে। শুয়ে পড়েন মহিলাটি। তবে দু’চোখের পাতা আর এক হয় না। ভাবনাগুলো ঘুরে ঘুরে আসে। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায়, আরে হ্যাঁ, তাইতো। লোকটি যখন নিজে রুটি বানাচ্ছিল তখন সাথের মহিলা তাকে একবার আমীরুল মুমেনীন বলে ডেকেছিল। আমিরুল মুমেনীন! মুসলমানদের খলিফাকে যে নামে ডাকা হয়!
মহিলা উত্তেজনায় শোয়া থেকে উঠে বসেন। বিস্ময়ে নেচে ওঠে তার মন। মাথার মধ্যে একটা চক্কর খেলে যায়। অস্ফুট কণ্ঠে বলে ওঠেন, আমিরুল মুমেনীন, খলিফা ওমর! খলিফা ওমরের সেবা পাবার আনন্দে আর চিনতে না পারার আফসোসে মহিলার দু’চোখে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা