ঢাকায় বায়ুদূষণ
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ২৯ মে ২০২৩, ০০:৪৬
শনিবার ২০ মে ছুটির দিনে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঢাকা। সকাল ৯টার বায়ুমানের কোয়ালিটি ইনডেক্স ছিল ১৬৬। ১৬৯ স্কোর নিয়ে লাহোর ছিল প্রথম স্থানে। ১৬১ স্কোর নিয়ে নয়াদিল্লি তৃতীয় স্থানে। ছুটির দিন স্কুল কলেজ অফিস আদালত বন্ধ থাকার সুবাদে বাতাস কিছুটা স্বাস্থ্যকর মানে থাকার কথা থাকলেও ঢাকা মহানগরীর বায়ুমান ছিল অস্বাস্থ্যকর। মাঝেমধ্যেই রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণে প্রথম স্থানে। মূলত বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড এবং ওজোন এর পরিমাণের ওপর নির্ণয় করা হয় বায়ুমান। এর ভিত্তিতে বিপজ্জনক, খুবই অস্বাস্থ্যকর, অস্বাস্থ্যকর, বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য অস্বাস্থ্যকর, সহনীয় এবং ভালো বায়ু এই কয় ভাগে ভাগ করা হয়। বায়ুমানের এই শ্রেণীবিন্যাসে ঢাকার অবস্থান অস্বাস্থ্যকর এবং বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ ব্যক্তির তালিকায় রয়েছে বয়স্ক, শ্বাসকষ্টের রোগী, উচ্চ রক্তচাপের রোগী, ক্যান্সারের রোগী এবং শিশু। অস্বাস্থ্যকর বায়ুমান শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া মাথাব্যথা, অনিদ্রা, মেজাজের অস্থিরতা, উচ্চরক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট এমনকি মরণব্যাধি ক্যান্সারেরও কারণ হতে পারে বয়স্কদের ক্ষেত্রে। ধুলাবালির কণা, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, ধোঁয়া, বায়ুতে ভাসমান গ্যাসীয় ও অন্যান্য পদার্থের সংমিশ্রণকে ভাসমান বস্তুকণা (Particulate Matter, PM) বলা হয়ে থাকে। ২.৫ মিলিমিটার বা তার চেয়ে আকারে ছোট এ বিষাক্ত পদার্থগুলো নিঃশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি সাধন করে। পরবর্তীতে এগুলো রক্তের সাথে মিশে গিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ও বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা সৃষ্টি করে।
ঢাকা মহানগরী পৃথিবীর শীর্ষ পাঁচটি বায়ুদূষণের নগরীর অন্যতম। অন্য নগরীগুলো হচ্ছে নয়াদিল্লি, কলকাতা, কানো (নাইজেরিয়া) এবং লিমা (পেরু)। আমেরিকার হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন নামক দুটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা উপাত্তে উঠে এসেছে এই তথ্য। তাদের গবেষণায় ঢাকা মহানগরীর বায়ুতে ভাসমান বস্তুকণার পরিমাণ পাওয়া গেছে ৭১.৪ মাইক্রোগ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুতে। নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ পাওয়া গেছে ২৩.৬ মাইক্রোগ্রাম প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুতে। বিভিন্ন গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, বাড়িঘরে ব্যবহৃত এসি, ফ্রিজ থেকে নির্গত নিয়ন গ্যাসের উপস্থিতি বায়ুমানকে অস্বাস্থ্যকর করে থাকে। এছাড়া ঢাকা মহানগরীর চতুর্দিকে অবস্থিত ইটভাটাগুলো বায়ুদূষণের আরেকটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত বহু আগেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমান নির্দেশিকায় ৫ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ এবং ১০ মাইক্রোগ্রাম নাইট্রাস অক্সাইডের গড় উপস্থিতি স্বাস্থ্যকর ঘোষণা করা হয়েছে। এদিক থেকে ঢাকায় পিএম ২.৫ এর উপস্থিতি ৭১.৪ প্রতি কিউবিক মিটার বায়ুতে। গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, ইটভাটা, শিল্প কারখানা এবং বাড়িঘরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অপর্যাপ্ততা ও বর্জ্য নিষ্কাশনে সচেতনতার অভাবই মূলত ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের বড় বড় প্রধান কারণ। ঢাকা মহানগরে ধারণক্ষমতার ৬ গুণ বেশি যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের কার্বন নিঃসরণ, মহানগরের উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে ধুলার আধিক্য বায়ুমানকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছে। পর্যাপ্ত গাছ গাছালি এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া ও দখল হয়ে যাওয়া খাল পরিস্থিতিকে আরো অসহনীয় করে তুলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুসারে প্রতিবছর দূষিত বায়ুর কারণে পৃথিবীতে ৭০ লক্ষ প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের সাম্প্রতিক তথ্য না থাকলেও ২০১৯ সালের এক রিপোর্ট অনুসারে, অস্বাস্থ্যকর বায়ুর কারণে সৃষ্ট রোগ থেকে রাজধানীতে মোট ১২ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।
সারা বিশ্বই এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। পরিবেশ পরিবর্তনের অভিঘাতে বাংলাদেশও বিপর্যস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত। পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় তা পরিশোধিত হতে না পারার কারণে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। নিঃসরিত কার্বন পরিশোধিত হয়ে বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপাদান সবুজ বৃক্ষরাজি যা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমানকে স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রাখতে সাহায্য করে। অপর দিকে গাছের প্রাচুর্য বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়াতে সরাসরি সাহায্য করে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, বোটানিক্যাল গার্ডেন, মানিকগঞ্জ, পূর্বাচল, গাজীপুর এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ঢাকার চাইতে অনেক বেশি। এর প্রধান কারণ গাছের প্রাচুর্য। নদী, খাল-বিল, ডোবাসহ বিভিন্ন পানির আরো বায়ুদূষণ প্রতিহত করতে সাহায্য করে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবে এই দুটোর পরিমাণ ঢাকা শহরে স্বাভাবিক মানের চাইতে অনেক নিচে।
বায়ুদূষণ রোধের জন্য প্রয়োজন প্রচুর গাছ। সড়কের দু’পাশে, সড়কদ্বীপে, সড়ক বিভাগকে দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগানো এখন জরুরি। স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গাছ লাগানোর জন্য ছাত্রসমাজকে উৎসাহিত করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। ফুটপাথে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাগানো যেতে পারে, বিভিন্ন ধরনের ফলদ গাছ। ঢাকা শহরের ডোবা ও পুকুরগুলোর সংস্কার সাধন করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা বায়ুদূষণের পরিমাণ কমতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। সাথে সাথে জরুরিভাবে ঢাকা শহরের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া বায়ুদূষণ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যানসমূহ। এ ব্যাপারে বছরে কয়েকবার ঢাকা শহরসহ সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযানের প্রয়োজন রয়েছে। দুঃখজনকভাবে, এসব গাড়ির মালিকেরা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাশালী। জনস্বাস্থ্যের কথা সামনে রেখে এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নেয়ার সময় এখন। ঢাকা শহর ছাড়াও সারা দেশে দ্রুত বনায়ন এখন অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রম, সর্বস্তরের জনসচেতনতা এবং কার্যকরী উদ্যোগ একমাত্র সমাধান। যত দ্রুত এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে ততই সামগ্রিক মঙ্গল। ঢাকা মহানগরীতে শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য, তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য বায়ুমান নিয়ন্ত্রণের জরুরি কার্যক্রম গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প নেই।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা