২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এই নির্মমতার শেষ কোথায়?

-

রোগীর স্বজনদের হাতে মারধরের শিকার হয়ে খুলনায় ডাক্তারের মৃত্যুর ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সিসিটিভি (ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা) ফুটেজে দেখা যায়, রোগীর ক্ষুব্ধ স্বজনরা ডাক্তারকে নির্দয়ভাবে চোখে-মুখে আঘাত করছেন। একপর্যায়ে দেয়ালে তার মাথা ঠুকে দিচ্ছেন। এতে তিনি পড়ে যান এবং অচেতন হয়ে পড়েন। তার মাথায় রক্তক্ষরণ হয়। পরিণতিতে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই ফুটেজ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। হতভাগ্য এই ডাক্তারের নাম মো: আবদুর রকিব খান (৫৯)। তিনি খুলনা মহনগরীর গল্লামারী এলাকার রাইসা ক্লিনিকের পরিচালক। তিনি বিসিএস স্বাস্থ্য প্রশাসনে পরিচালক পদমর্যাদায় বাগেরহাট মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) অধ্যক্ষ ছিলেন।’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৭ জুন, ২০২০)
ডা: রকিব খানকে হত্যার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কান্না ধরে রাখতে পারিনি। করোনার এই সময়টায় একের পর এক চিকিৎসক মারা যাওয়ার ঘটনায় মনটা বিষাদে ভরে থাকে। তার ওপর এমন পাশবিকতা, নিষ্ঠুরতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। বয়স্ক একজন চিকিৎসক। সারাজীবন যিনি রোগীদের সেবায় ব্যয় করেছেন, তাদের হাতেই নিহত হতে হলো তাকে। এই করোনাকালে বেশির ভাগ চিকিৎসক রোগী দেখছেন না। অথচ ডা: রকিব নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে রোগীর সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন। অথচ তাকেই নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। চরম অমানবিকতা। মানুষের মধ্যে এমন পশুত্ব কিভাবে বাস করে? প্রতিনিয়ত চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। পত্রিকার পাতা থেকে তারই কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি।
‘সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর স্বজনেরা কর্তব্যরত এক চিকিৎসককে মারধর করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা কামরুল হাসান জানান, উপজেলার কোনাবাড়ি গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে মোহাম্মদ হাসান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক সাখাওয়াত হোসেন তাকে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু রোগীর সাথে আসা তার আত্মীয়স্বজন চিকিৎসকের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ওই চিকিৎসককে তারা মারধর করে চলে যান।’ (দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)
যারা রাজনীতিবিদ, নিজেকে মানবসেবী বলে দাবি করেন তারাও ক্ষমতার দাপট দেখাতে হাসপাতালকেই বেছে নেন। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যুবলীগ নেতার মায়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারকে (আরএমও) মারধর ও জরুরি বিভাগে ভাঙচুর করার অভিযোগ উঠেছে পৌর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস ইসলামের বিরুদ্ধে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ জুন বিকেলে যুবলীগ নেতা ইলিয়াসের মা ডলি বেগম (৫২) বাড়িতে অসুস্থতা বোধ করায় তাকে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে তিনি মারা যান। এদিকে তার মৃত্যুর খবর বাড়িতে পৌঁছলে পরিবারের সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটে আসেন এবং চিকিৎসকের অবহেলার অভিযোগ তুলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে হামলা চালিয়ে দরজা, জানালা ও আসবাবপত্র ভাঙচুর করেন। পরে দোতলায় উঠে আরএমও দেলোয়ার হোসেন নয়নকে মারধর করেন ইলিয়াস ও তার পরিবারের সদস্যরা। খবর পেয়ে শিবগঞ্জ থানা পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ( দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, জুন ১৯, ২০১৯)
কিছু দিন আগে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত হওয়া এএসআই-ও সাহস পান একজন ক্যাডার কর্মকর্তার গায়ে হাত তোলার। প্রত্যক্ষদর্শীর সূত্রে জানা গেছে, উরুতে ফোঁড়া নিয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী থানার জনৈক এএসআই। গত মঙ্গলবার বিকেলে হাসপাতালে তার ফোঁড়ার অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার স্যালাইনের পাইপে রক্ত উঠে যায়। তিনি নার্সদের ডাকলে সাড়া না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন। এ সময় ওই ওয়ার্ডে অন্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে ব্যস্ত থাকা চিকিৎসক সঞ্জয় কুমার রায়কে গালিগালাজ করেন তিনি। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তিনি এবং তার দুই ভাই সেনাবাহিনীতে কর্মরত সৈনিক ও পুলিশ কনস্টেবল ডা: সঞ্জয়কে মারধর করেন। ( দৈনিক সমকাল, ২০১৯-০১-১৬)
ওষুধ বিক্রেতা, যার জীবিকা চলে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে। তারাও দ্বিধা করেন না গায়ে হাত তুলতে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা: গালিবকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে ওষুধের দোকানির বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় হাসপাতালের স্টাফদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। ৮ মে এক রোগীর জন্য দেয়া ওষুধ পাল্টে দিতে বলায় কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তাকে মারধর করেন দোকানি। অভিযুক্ত ব্যক্তি হাসপাতালের সামনের এসএম ড্রাগ হাউজের মালিক। ভুক্তভোগী ডা: গালিব জানান, হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা এক রোগীর জন্য ব্যবস্থাপত্র দেখে রোগীর স্বজনকে জরুরি কিছু ওষুধ আনতে পাঠান নার্স। রোগীর স্বজনও ওষুধ নিয়ে ওয়ার্ডে ফেরেন। নার্স দেখেন এক ওষুধের পরিবর্তে অন্য ওষুধ দিয়েছেন দোকানি। ঘটনাটি আমাকে জানালে তাকে ওই দোকানে গিয়ে ওষুধটি বদলে আনতে পাঠাই। তিনি ফিরে এসে জানান দোকানি ওষুধ বদলে দেবে না, আবার টাকাও ফেরত দেবে না। তার কাছে টাকাও নেই। তখন অসহায় লোকটির দিকে তাকিয়ে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার সাথে দোকানে গিয়ে ওষুধটি বদলে দিতে অনুরোধ করি। তখন দোকানদার ওষুধ বদলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘ওই ওষুধ আমার এখানে নেই।’ তখন টাকা ফেরত চাই। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওষুধের দোকানি আমার ওপর হামলা চালায়। (বাংলানিউজ২৪.কম, ০৯ মে ২০২০)। মানবিকতার পুরস্কার কি মারধর?
এই হেনস্তা থেকে বাদ যান না দেশবরেণ্য চিকিৎসকও। অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহকে পরিচয় করে দেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি একুশে পদকজয়ী, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তার মতো চিকিৎসকও নাকি ‘ভুল’ চিকিৎসা করে থাকেন। তার কথিত ভুল ধরা পড়ে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কাছে। ‘গত ১৮ মে বিকেলে রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আফিয়া জাহিন চৈতি (২০) নামে ঢাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী। তিনি ১৭ মে সকালে জ্বর, গায়ে ব্যথা এবং র্যাশ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৮ মে দুপুরে ‘ভুল চিকিৎসায়’ তার মৃত্যু হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই ঢাবির কিছু ছাত্র হাসপাতালটিতে ভাঙচুর করে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা দায়িত্বরত ডাক্তারদেরকেও মারধর করে। কিন্তু তখনো ওই রোগীর মৃত্যু হয়নি। ১৮ মে রাতে ওই ঘটনায় পরস্পরের যোগসাজশে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে ধানমণ্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন ঢাবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ। মামলায় আসামি করা হয় অধ্যাপক ডা: এ বি এম আবদুল্লাহ, লে. কর্নেল (অব:) ডা: এ এস এম মাতলুবুর রহমান, হাসপাতালের পরিচালক এম এ কাশেমসহ ৯ জনকে। সেদিন বিকেলেই হাসপাতালটির পরিচালক এম এ কাশেমকে গ্রেফতার করে ধানমণ্ডি থানা পুলিশ। (মেডিভয়েজ, ২২ জুলাই ১৯)
নারী চিকিৎসকরাও বাদ যান না রোগীর লোকদের হাতে লাঞ্ছনা থেকে।
ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক রোগীর স্বজনদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন দুই নারী শিক্ষানবিস চিকিৎসকসহ তিনজন। হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার জানান, বিকেল ৪টার দিকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুর সদরের ধুলদী এলাকায় একটি মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়লে ওই মাইক্রোবাসের চারজন আহত হন। আহতদের চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। আহতদের পুরুষ সার্জারি বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আহত একজনের মৃত্যু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আহত একজনের মৃত্যু হলে তার স্বজনরা ওই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত শিক্ষানবিস নারী চিকিৎসক সানজিদা ও রুবাইয়া এবং শিক্ষানবিস চিকিৎসক আবুল হাসনাত ও এক সেবিকাকে প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। (দৈনিক সমকাল, ১২ জানুয়ারি ২০১৬)
নারী চিকিৎসকদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে বহুবার বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজে ২০১৭ সালে যা নিয়ে অনেক লংকাকাণ্ড হয়েছে। ২০১৪ সালে বারডেমে এক রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় মাসুদ নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা ও সাবেক এক মন্ত্রীর এপিএস ডা: শামীমা, ডা: আনোয়ার, ডা: কল্যাণসহ কয়েকজনকে মারধর করেন। ডা: শামীমা নিজেকে রক্ষা করতে বাথরুমে ঢুকে সিটকিনি লাগিয়ে দেন। দরজা ভেঙে তাকে বের করে এনে মারধর করা হয়। মারধরকারীরা আবার ফেসবুকে সে ঘটনা গর্বের সাথে প্রচার করেছেন।
উপরের ঘটনাগুলো হাজার হাজার ঘটনার কয়েকটি মাত্র। প্রতিনিয়ত মারধরের শিকার হতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। প্রতি বছর এমন কতটা ঘটনা ঘটছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এমন ঘটনা ঘটলে কয়েক দিন ফেসবুকে ঝড় ওঠে। আবার সব ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছি। কোনোটারই বিচার হয়নি। ভবিষ্যতে হবে না তাও জানি। ডা: আবদুর রকিব খানের হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে না তাও জানি। কিন্তু মেনে নিতে কষ্ট হয়।
কেন এমন হচ্ছে? আমাদের কাছে মনে হয় কয়েকটি কারণ আছে।
১. চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা কিন্তু চরমে। বিশ্বব্যাপী আয়ের অন্যতম একটি খাত স্বাস্থ্য পর্যটন। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা তৈরি করে রোগী ভাগানোর চেষ্টা অন্য দেশগুলোর। এ জন্য তারা আমাদের মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। মিডিয়া তাদের চক্রান্তে পা দিচ্ছে। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মিডিয়াগুলো নেতিবাচক নিউজ প্রচার করে যাচ্ছে। কেউ মারা গেলেই মিডিয়াগুলো হেডিং করছে, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। একজন মিডিয়াকর্মী বা রোগীর লোক কিভাবে নিশ্চিত হলেন ভুল চিকিৎসা হয়েছে। তারা কি চিন্তা করছেন না এর প্রভাব কত মারাত্মক। এ নিউজগুলো মানুষের মনে খারাপ ধারণা দিচ্ছে। এতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি তাদের মন ওঠে যাচ্ছে। এতে লাভ হচ্ছে কাদের? প্রতিবেশী দেশগুলোতে আমাদের দেশের রোগীদের ভিড় বাড়ছে। সেখানে কি খুব আলাদা চিকিৎসা হচ্ছে? আমার এক আত্মীয় রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগছিলেন। তিনিও জমি বেচে ছুটলেন ভারতে। লাখ তিনেক টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রয়োজন না থাকলেও দেয়া হয়েছিল খুব দামি ইঞ্জেকশন। দুই-তিনটা দেয়ার পর টাকা শেষ হয়ে আসে। শেষ হয়ে যায় চিকিৎসাও। তিন বছর পর আমাকে একবার খুব করে ধরলেন। নিয়ে এলাম অধ্যাপক সৈয়দ আতিকুল হকের কাছে। খুব কম ব্যয়ের চিকিৎসায় তিনি এখন অনেক সুস্থ। তিন বছর হয়ে গেছে। আমাকে দোয়া করেন খুব। অথচ তিনি তিন লাখ টাকা দেশে কি খরচ করতেন? বা করলেও কি চিকিৎসকের গোষ্ঠী উদ্ধার করতেন না। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় ভারত থেকে ফিরে এসে কী খুশি, ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মিষ্টি কথায় চিকিৎসা কিন্তু হয় না। ডায়াবেটিস হলেও ওপার থেকে ঘুরে না আসলে নাকি চিকিৎসা হবে না। অথচ বিদেশে আলোচনা হয় এমন চিকিৎসক কিন্তু দেশেই আছেন। কিছু দিন আগে বাংলাদেশী এক নাগরিক ভারতের নামকরা একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কি ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তার ভিডিও কিন্তু ভাইরাল হয়েছিল। কিন্তু তার কোনো নিউজ কি মিডিয়ায় এসেছে?
এমন নেতিবাচক রিপোর্টের জন্য কত টাকা পাচার হচ্ছে, তা কি হিসাব করেছি কেউ? ডয়চে ভেলের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘গত এক বছরে শুধুমাত্র বাংলাদেশ থেকেই লাখ দেড়েক নথিভুক্ত রোগী ভারতে এসেছেন চিকিৎসা করাতে। এর বাইরেও বহু ব্যক্তি ভারতে পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করে এ দেশে এসেছিলেন চিকিৎসা করাতে। স্বাস্থ্য পর্যটনে যাদের নাম নথিভুক্ত হয়নি। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১২ সালে চিকিৎসা করানোর জন্য ভারতীয় ভিসা চেয়েছিলেন দেড় লাখ বিদেশী। মাত্র চার বছরে সংখ্যাটি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে চিকিৎসার জন্য ভিসা নিয়েছেন চার লাখেরও বেশি মানুষ। আর ২০১৯ সালে সেই সংখ্যা তারও দ্বিগুণ। সরকারি হিসাব বলছে, ২০১৫ সালে এই খাতে ভারত আয় করেছিল এক লাখ ৩৫ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৭৭ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকায়। ২০১৯ সালে লাভের অঙ্ক একই অনুপাতে বেড়েছে। দেশের চিকিৎসকদের ভুল যে নেই তা বলছি না। রোগীদের সাথে একটু মিষ্টি কথা বললে কিংবা একটু সময় দিলে ক্ষতি কী?
২. রাষ্ট্রযন্ত্র চিকিৎসকদের নিরাপত্তা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ। চিকিৎসকদের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্র বিমাতাসুলভ আচরণ করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিভিন্ন বক্তব্যে তা বারবার উঠে এসেছে। এসব ব্যক্তির আশপাশে যারা থাকেন তারা তাদের ভুল বার্তা দিয়ে চলেন সব সময়। করোনার আগেও এমন ভুল বার্তা দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল চিকিৎসকরা চিকিৎসা না দিয়ে পালিয়ে গেছেন। এমনকি, প্রধানমন্ত্রী তাদের কথায় বিশ্বাস করে চিকিৎসকদের নিয়ে খুব কড়া কথা উচ্চারণ করেছেন। তিনি বিদেশ থেকে চিকিৎসক আমদানির কথাও বলেন। এখন যত দিন যাচ্ছে তত পরিষ্কার হচ্ছে, নিজেদের দোষ ঢাকতেই বরাবরের মতো চিকিৎসকদের ব্যবহার করা হয়েছে মহল বিশেষ থেকে। চিকিৎসকরা পালিয়ে যাননি। কাদম্বিনীর মতো লাশ হয়ে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। বিদেশী চীনা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট দলের বক্তব্য এটা প্রমাণ করে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম। চিকিৎসকসহ চিকিৎসাকর্মীর সংখ্যাও খুবই কম। তবু স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে তারা অসাধারণ কাজ করে যাচ্ছেন (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, জাগো নিউজ২৪. কম, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক যুুুুগান্তর)। বরং তারা এদেশে ব্যবস্থাপনার ত্রুটির বর্ণনা করেছেন। বিদেশি চিকিৎসক এবারই প্রথম আমাদের চিকিৎসকদের প্রশংসা করেনি। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য ভারত থেকে বিশেষ বিমানে উড়িয়ে আনা হয় ডা: দেবী শেঠীকে। তিনি সব চিকিৎসাসংক্রান্ত ব্যবস্থাপত্র দেখে বলেছিলেন দেশী চিকিৎসকরা সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি নির্ভুলভাবে করেছেন।
স্বাস্থ্যসেবা খাতের হাত ধরেই এসেছে এ সরকারের যত অর্জন। বিদেশে যতবার বাংলাদেশের নাম শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হয়েছে তাও কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের মাধ্যমে। তাহলে চিকিৎসকদের নিয়ে এত অপপ্রচার কেন?
এই চিকিৎসকদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে ভয়াবহ মাস্ক কাণ্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে সমাধান করতে হয়েছে। চিকিৎসকদের মাস্ক, পিপিই সরবরাহ না করে প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে ‘চিকিৎসকরা কাজ করতে চান না।’
এখন সব হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন। কিন্তু চিকিৎসা সরঞ্জাম কোথায়? হাসপাতালগুলোতে সামান্য অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থাও নেই। তাহলে প্রতি বছর বাজেটের কোটি কোটি টাকা কী করা হয়েছে? শুধু চিকিৎসক দিয়েই কি হাসপাতাল চলে? রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে চিকিৎসকদের নিয়ে যেভাবে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তাতে চিকিৎসক নিগ্রহে উৎসাহ জোগানো হচ্ছে। ডা: আবদুর রকিব খান তো চিকিৎসা দিয়েই প্রাণ হারালেন। তাকে নিয়ে কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি কোনো বক্তব্য দিলেন না। এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কেন? তার হত্যাকাণ্ডের আসামিদের ধরতে এত গড়িমসি কেন? ওসিকেই বা বহিষ্কার করতে হলো কেন? অথচ ভারত চিকিৎসকদের সুরক্ষায় কঠোর আইন করেছে।
ডয়চে ভেলের ২৩ এপ্রিল, ২০২০ এর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীদের মারলে তিন মাস থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল এবং ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের মারধর ও হেনস্থা থামাতে কড়া ব্যবস্থা নিলো নরেন্দ্র মোদি সরকার। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের আক্রমণ করলে, তাদের মারধর করলে অভিযুক্তদের কড়া সাজার ব্যবস্থা করা হলো। চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের আক্রমণ করা হলে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর জেল ও পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা হবে। আর এই অভিযোগে গ্রেফতার হলে জামিন পাওয়া যাবে না। চিকিৎসকের আঘাত গুরুতর হলে ছয় মাস থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। সেই সাথে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হবে।
বাংলাদেশে কি এমন একটি আইন হতে পারে না?
৩. দীর্ঘদিন থেকে চিকিৎসক সমাজ নেতৃত্বহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত। চিকিৎসক সমাজকে তারা নিজেদের স্বার্থেই বারবার ব্যবহার করছেন। তাদের কার্যক্রম চিকিৎসকদের হতাশ করেছে। এমনকি তরুণ চিকিৎসকদের মতে, এ নেতারাই দাবি দাওয়া আদায়ে বাধা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু নেতারাও যে খুব বেশি লাভবান হয়েছেন তাও বলা যায় না। উল্টো, আগে তাদের যে দাপট ছিল তা দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। এখন তাদের কথা খুব বেশি পাত্তা পায় না কোথাও। অথচ চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর ইতিহাস কিন্তু গৌরবের। স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের পতনের সূচনা বিএমএ-এর হাতেই শুরু হয়েছিল। আমার পরিচিত এবং বর্তমান সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সচিব এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, তারা নাকি বিএমএকে খুব সমীহ করতেন একসময়। তবে নতুনরা কিন্তু ‘জেগে উঠেছে’। তারা কয়েকটি সংগঠন করেছে যেগুলো চিকিৎসকদের আশা জাগাচ্ছে। তাদের চাপে হলেও বর্তমান বিএমএ কিছুটা হলেও চিকিৎসকদের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করছে।
৪. ক্যাডার সার্ভিসে নিদারুণ বৈষম্য চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। চিকিৎসকরা স্বভাবতই হাসপাতাল, লাইব্রেরি, রোগীÑ এর বাইরে যেতে চান না। ক্যাডার সার্ভিসে তারা এত নিগ্রহের শিকার হলেও কোনো দিন মুখ ফুটে বলার প্রয়োজনও মনে করেন না। একটি বিশেষ ক্যাডারের ২০০ জনের মধ্যে ৫০ জন সিনিয়র সচিব, সচিব হবেন আর চিকিৎসকদের গ্রেড-১ পদটিও কার্যত হারিয়ে গেল। প্রতি বছর হাজার হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এটা রাজনৈতিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এত চিকিৎসককে যে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তাদের প্রমোশন দেয়া হবে কিভাবে? উপরের দিকে কয়টি পদ আছে। আমার তো মনে হয় চিকিৎসকদের একসময় ‘মেডিক্যাল অফিসার’ হিসেবে চাকরি শেষ করতে হবে। চিকিৎসকদের উপর মন্ত্রণালয়ের অন্যায় খবরদারি তো আছেই। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে চিকিৎসকদের ‘ভিলেন’ বানিয়ে উপস্থাপন করে রেখেছেন বহু আগে থেকেই। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও নিজেদের চোখ দিয়ে না দেখে তাদের চোখ দিয়েই দেখছেন সবসময়। চিকিৎসক কর্মস্থলে না থাকলে ব্যবস্থা নেয়ার অনেক পদ্ধতি আছে। কিন্তু মিডিয়ায় তাদের গালিগালাজ করা যুক্তিযুক্ত নয়। যে চিকিৎসকরা এক এমপির গালির প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের মন্ত্রণালয় বদলি আদেশ জারি করে।
২০১৩ সালে শিশু ক্যান্সার বিভাগটি চালুর পর থেকেই ক্যান্সার আক্রান্ত, ফুলের মতো ফুটফুটে শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন প্রফেসর এ কে এম রেজাউল করিম। বিভাগটি চালু হওয়ার আগে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় অভিভাবকদের ছুটতে হতো ঢাকায় অথবা দেশের বাইরে। গত কয়েক বছরে শত শত রোগী এ বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে। দেশের তিনজন সেরা শিশু ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের একজন প্রফেসর রেজাউল করিমকে পেয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের অভিভাবকেরা আশায় বুক বাঁধেন। তিনিও পরম যতেœ চিকিৎসাসেবায় শিশুদের সারিয়ে তুলছিলেন। হঠাৎ করেই তাকে বদলি করে দেয়ায় বিস্ময়ে হতবাক রোগী ও তাদের অভিভাবক এবং স্বজনেরা। তাদের প্রশ্ন ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদেরই বা কী হবে? ( দৈনিক ইনকিলাব, ১১/০৭/২০১৯)
৫. বিচারহীনতা চিকিৎসকদের লাঞ্ছনার অন্যতম কারণ। চিকিৎসককে মারধর ও হাসপাতাল ভাঙচুর করে কারো শাস্তি হয়েছে এমন খবর কি কেউ কোনো দিন শুনেছেন বা পত্রিকায় পড়েছেন? এর কয়েকটি কারণ আছে। মারধরের শিকার হওয়া চিকিৎসকের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। না প্রশাসন, না নিজেদের সমাজের কেউ। উল্টো মারধরকারী চিকিৎসককে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হতে থাকে। এমনকি হত্যা বা ধর্ষণের মামলা করারও হুমকি দেয়া হয়। অনেক সময় স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চিকিৎসা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সাথে হাত মেলান। তাদের মধ্যস্থতায় নিপীড়নকারী মারধরের শিকার হওয়া, চিকিৎসকের কাছে দায়সারাভাবে ক্ষমা চায়। অসহায় চিকিৎসক ক্ষমা করে নীরবে কাঁদেন। আর ভাঙচুরের শিকার যদি বেসরকারি হাসপাতাল হয়, তাহলে লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হয়ে গেলেও কিছু বলার থাকে না। টাকা আদায় তো দূরে থাক, উল্টো ‘ক্ষতিপূরণ’ আদায় করে নেয় ভাঙচুরকারীরা।
৬. মূল্যবোধের মারাত্মক অবক্ষয় ও অস্থিরতা চিকিৎসক নিপীড়নের অন্যতম কারণ। অনেক সময় দেখা যায়, হাসপাতালের বিল পরিশোধ না করার মানসিকতা থেকেও ভাঙচুর চালানো হয় হাসপাতালে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে ভাঙচুর, মারধর চলে। মিডিয়ায় শোনা যায়, টাকার জন্য আটকে রাখা হয়েছে লাশ। মানবিক রিপোর্ট বটে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কি টাকা আদায় করবে, উল্টো টাকা দিতে বাধ্য হয় ভাঙচুরকারীদের। কারো মৃত্যু হলে রোগীর লোকেরা মানতেই চান না। সব দোষ গিয়ে পড়ে চিকিৎসকের ওপর। অথচ চিকিৎসক কি মানুষের বাঁচা-মরার কেউ। তারা শুধু চেষ্টা করতে পারেন। এমনও হয়েছে, দুই গ্রুপে মারামারি করে মৃতপ্রায় কাউকে হাসপাতালে এনেছেন। অথচ ও-ই ব্যক্তি মারা যাওয়ায় মারধরের শিকার হয়েছেন চিকিৎসক। জনগণকে বুঝতে হবে, সবার পক্ষে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসককে মারধর কোনো সমাধান নয়। চিকিৎসকদের মাথায় রাখতে হবে আজকে ডা: রকিব, আগামীকাল আরেকজন। ভাবছেন, আমি তো ভালো আছি কিন্তু পরেরজন আপনি হবেন না-এর নিশ্চয়তা কী? হ
লেখক : চিকিৎসক ও গণমাধ্যম কর্মী


আরো সংবাদ



premium cement