২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠুক নতুন পৃথিবী

সময়-অসময়
-

করোনাভাইরাসের কারণে কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হওয়ায় খাদ্যের অভাবের জন্য সরকার ঘোষিত লকডাউন মানতে পারছে না। লকডাউন ভাঙার কারণে যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার সায়েমা হাসান এলাকার বয়স্ক মুরুব্বিদের কান ধরে উঠবস করিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ ছিল না; কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বেতনভুক আমলাদের ‘গায়ে গরম বেশি’ বিধায় তারা ক্ষমতাহীন জনগণকে ‘মানুষ’ মনে করেন না; ফলে ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ আমলারা সাধারণ গণমানুষের সাথে যে ব্যবহার করতেন এখনো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। পাবলিক সার্ভেন্টদের এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে, যেমনটি ঘটেছে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়; সহকারী কমিশনার (ভূমি) সঞ্চিতা কর্মকারকে মাছ বিক্রেতা ‘দিদি’ সম্বোধন করায় লাথি মেরে ড্রেনে ফেলে দিয়েছেন তাকে (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা ৫ এপ্রিল ২০২০)। ব্রিটিশ আমলাদের মতো দেশী আমলাদের ‘গায়ে গরম’ বেশি হওয়ার কারণেই ভাই, দিদি, বোন সম্বোধন করলে তাদের মতে অবমূল্যায়ন মনে করে বিধায় ব্রিটিশ অনুকরণে ‘স্যার’ সম্বোধনটি তারা বেশি পছন্দ করেন। কথা প্রসঙ্গে ওই ঘটনাগুলো এসে গেলেও মূল বক্তব্য করোনা, করোনা প্রতিরোধ এবং করোনা থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় কি?
করোনা প্রতিরোধের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সরকার লকডাউন দিয়েছে, অর্থাৎ যে যে অবস্থায় আছে সে অবস্থাতেই স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ থাকতে হবে, যাতে করোনা জীবাণু-বহনকারীর শরীর থেকে অন্য কারো দেহে জীবাণুটি সংক্রমিত হতে না পারে। উদ্দেশ্যটি অত্যন্ত মহৎ।
মানুষের জীবন রক্ষার্থে প্রদত্ত সরকারি এ নির্দেশ জনগণ মানছে না কেন? প্রধান কারণ বেঁচে থাকার জন্য, ‘জীবন’কে রক্ষার নিমিত্ত ‘ক্ষুধার’ চাহিদা মানুষকে মিটাতে হয়। প্রবাদ রয়েছে, ÔNecessity does not know the lawÕ লকডাউন মেনটেইন করার জন্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও জনগণের সমাবেশ বন্ধ করতে পারছে না, কোথাও কোথাও জরিমানা করেও সন্তোষজনক ফল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য দিকে বেতনের দাবিতে গার্মেন্ট শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করছে। খাদ্যের দাবিতে অবরোধ করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেখানে জনসমাগম বেশি। সঙ্গতভাবেই ত্রাণের চাল চোরদের বাড়ি হলুদ পতাকা দিকে লকডাউন করার দাবি উঠেছে ক্ষুধার্ত মানুষের পক্ষ থেকে।
প্রধান বিচারপতি চেম্বার জজ ও হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ চালু করার প্রজ্ঞাপন জারি করলেও আইনজীবীদের প্রতিবাদের মুখে তা স্থগিত হয়ে গেছে। জুমা ও তারাবিতে মসজিদে ১২ জনের বেশি উপস্থিত হলে ম্যাজিস্ট্রেট মুসল্লিদের বের করে দিয়েছেন। অন্য দিকে সরকার গার্মেন্ট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা স্ববিরোধী সিদ্ধান্ত। এক দিকে বলা হচ্ছে, ঘর থেকে বের হবেন না, মসজিদে যাবেন না, অন্য দিকে গার্মেন্ট, শপিংমল, মার্কেট খুলে দিলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারেÑ তা সরকার কি উপলব্ধি করতে পারছে? গার্মেন্ট বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি বড় খাত। জাতীয় উন্নয়নে কৃষকদের মতো গার্মেন্ট শ্রমিকরাও জাতির বন্ধু। বন্ধু আরো রয়েছেন যারা বিদেশ থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। করোনার কারণে বৈদেশিক রেমিট্যান্সের দরজাও বন্ধ হয়ে গেল বৈকি!
প্রাণঘাতী করোনা আমাদের কী শিখিয়ে যাচ্ছে? করোনা আক্রান্ত সন্দেহে চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় ফেলে দেয়া, কোনো বাড়িতে এতে আক্রান্ত হলে সে বাড়ির লোকজনকে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য মহল্লাবাসী একত্রিত হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে আক্রান্ত পরিবারকে আক্রমণ করা, সরকারি ত্রাণের চাল চুরি ও আত্মসাৎ, ত্রাণের নামে চাঁদাবাজি প্রভৃতি গণবিরোধী অপকর্ম করোনা বন্ধ করতে পারেনি। মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়েও বন্ধ হয়নি খুন, ধর্ষণ, কালোবাজারি ও মজুদদারি। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে সাধারণ মানুষের চোখের পানি ধরে রাখা যায় না, কিন্তু বিশ্ব নেতাদের পাষাণ হৃদয় এতে একটুও কেঁপে ওঠে না। অথচ পাষাণদের মনোরঞ্জনে বিলিয়ন ডলার ব্যয় হচ্ছে নিরীহ মানুষ হত্যার পরমাণুু বোমা তৈরির জন্য। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, করোনা জীবাণুু তৈরি করা হয়েছে চীনের গবেষণাগারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রয়েছে ভিন্ন মত। তাদের মতে, প্রকৃতি থেকেই করোনার উৎপত্তি। ট্রাম্পের বক্তব্য প্রমাণ করার আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। হিটলার মনে করত, সব মানুষ মরে গেলেও গোটা পৃথিবী তার পদতলে থাকতে হবে। অনুরূপ চিন্তা চীনের মাথায়ও থাকতে পারে। তবে চীন, আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি শক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধানরা মুসলিমবিরোধী বলে প্রমাণিত। চীন বলে বেড়াচ্ছে, তারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বন্ধু, যদি তাই হয় তবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে মুসলিম রোহিঙ্গাদের চরম দুর্দশা কেন? রোহিঙ্গারা শুধু মুসলিম হওয়ার কারণেই চীনের এ বিমাতাসুলভ আচরণ নয় কি?
করোনা মানেই মৃত্যু এবং গোটা বিশ্বে এ মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর বিগত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন, পৈশাচিকতার পদভারে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস যখন ভুক্তভোগী মানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে যায়, অত্যাচারী ও অযোগ্য ব্যক্তিরা যখন অপকৌশল করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তখনই প্রতি শতাব্দীতে অন্তত একবার করে এ ধরনের মহামারীর আবির্ভাব ঘটে, যার পূর্বাভাস বড় বড় বৈজ্ঞানিকদের চিন্তা-চেতনা বা গবেষণাতেও ধরা পড়ে না।
শত প্রতিকূল অবস্থা এবং ঘটে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষ কী প্রত্যাশা করতে পারে? করোনায় ধ্বংস হয়ে যাক শাসকশ্রেণীর দুর্বৃত্তায়ন, শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে নিরীহ নিপীড়িত মানুষরা মুক্তি পাক, অধিকার আদায়ে ব্যর্থ গণমানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাসে আকাশ-বাতাস যেন আর ভারী না হয়ে ওঠে, বিচার বিভাগে অনেকের পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ তথা সরকারের তাঁবেদারি আর যেন দেখতে না হয়, ব্যাংকলুটেরা, ভূমিদস্যু, পুঁজিপতিদের পদতলে রাজনীতি যেন আত্মসমর্পণ না করে, রাজনৈতিক দলের নমিনেশন নিলামে যেন বিক্রি না হয়, স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, পুত্রের হাতে পিতা-মাতা খুন, ভাইয়ের হাতে ভাই খুনের খবর যেন আর শুনতে না হয়Ñ এ কামনায় চেয়ে থাকি নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের বসবাসযোগ্য একটি শোষণহীন পরিচ্ছন্ন পৃথিবীর প্রত্যাশায়। তাই প্রত্যাশা রইল সৃষ্টি হোক প্রভাবমুক্ত একটি জাতিসঙ্ঘের। দৃঢ়চিত্তে প্রত্যাশা করিÑ জেগে উঠুক এক নতুন পৃথিবী, যে পৃথিবীতে শিশুর নির্মল হাসিতে, আনন্দঘন পারিবারিক পরিবেশে, ভয়হীন সমাজে, কল্যাণমূলক একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বস্তির নিঃশ্বাসে অধিকারবঞ্চিত মানুষরা সৃষ্টিকর্তার কর্মতৎপরতাকে উপলব্ধি করতে পারবে। সৃষ্টিকর্তা বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা আছে সবাই তাঁর (আল্লাহ) কাছে কামনা করে, তিনি (আল্লাহ) প্রতি মুহূর্তে তাঁর কর্মে নিয়োজিত।’ (সূরা আর রহমান, আয়াত-২৯) অসহায়, নিপীড়িত, নির্যাতিত, অধিকারবঞ্চিত গণমানুষ সেটিই প্রত্যাশা করে। কারণ মহান সৃষ্টিকর্তাই একমাত্র এবং একমাত্র হেফাজতকারী।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনীতিক


আরো সংবাদ



premium cement