০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রামমন্দির উদ্বোধন, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি!

রামমন্দির উদ্বোধন, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি! - ফাইল ছবি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আজকাল মনে হচ্ছে, তিনি রাজনীতিবিদ নন বরং ধর্মীয় নেতা। সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনা নয় বরং তার কাজ হচ্ছে মন্দিরের ঘণ্টা বাজানো। শুধু তাকেই আপাদমস্তক রামভক্তের আবেগি ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে তা নয়; তিনি দেশের জনগণকেও নিজেদের রূপ বদলাতে বলেছেন। সবাই জানেন, সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তিরই ব্যক্তিগত চারিত্রিক গুণ রয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সদগুণ হচ্ছে, তিনি প্রতিটি চারিত্রিক গুণে নিজেকে ধারণ করতে সুনিশ্চিত আস্থা রাখেন। এ কারণেই তিনি ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় নির্মাণাধীন অসম্পূর্ণ মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্মরণীয় করে রাখার জন্য পুরো দেশকে রাম নাম জপার নির্দেশ দেন। আর বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের তৎপরতায় চারিদিকে রামমন্দিরচর্চা নজরে পড়ে। বাহ্যত এটি ছিল রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। কিন্তু এর পুরো আয়োজন ছিল রাজনৈতিক। যার লক্ষ্য হচ্ছে, চলতি বছর অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনে বড় জয় অর্জন করা। এ জয় শুধু ক্ষমতায় নিজের আধিপত্য দৃঢ় করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং তার লক্ষ্য নিজেকে হিন্দুদের মুক্তিদাতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য করা।

এখানে ধর্ম ও রাজনীতিকে এমনভাবে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে যে, একে অন্যের স্বরূপ চেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। শঙ্করাচার্যরা ঠিকই বলেছেন, মন্দির উদ্বোধন একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এ জন্য এ কাজটি কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের করা উচিত এবং এর জন্য উপযুক্ত মহরতও জরুরি। এ কথা বলে চারজন শঙ্করাচার্য এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান, তারা ধর্মের নামে রাজনীতির অংশ হতে চাননি। শঙ্করাচার্যরা এ মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই উদ্বোধনের আয়োজনেরও আপত্তি জানান। তবে প্রধানমন্ত্রী ও তার দল এক্ষেত্রে নিরূপায়, কারণ নির্বাচনের আগেই তাদের এটি উদ্বোধন করতেই হবে। যাতে মোক্ষম সময়ে ভোটের ফসল তুলতে পারে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সফল করার জন্য বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার তাদের সব শক্তি প্রয়োগ করে। শুধু তাই নয়, এ অনুষ্ঠান নজিরবিহীন করার জন্য সরকারি উপকরণ ও সরকারি সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক নিয়োগ করা হয়। রামমন্দির ইস্যুতে বিশেষ ডাক টিকিটও প্রকাশ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী আজকাল দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলোতে মাথা ঠেকিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর তার পুরো ক্যাবিনেট বিভিন্ন মন্দিরের পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ব্যস্ত হয়ে আছে। এক সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা হয়েছে, সেখানকার পুরো প্রশাসন বর্তমানে শুধুই হিন্দু ধর্মের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছে। এ আশ^াস প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে যে, পুরো দেশ রামের পদতলে। আর সবাই তার জপ করছে। এ কারণেই ২২ জানুয়ারির অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিদের রামবিরোধী অভিহিত করে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়। কংগ্রেস এটিকে বিজেপি ও আরএসএসের নিজস্ব অনুষ্ঠান অভিহিত করে নিজেদের দূরে রাখে। অপর সেকুলার দলগুলোও এরই অনুসরণ করেছে। এ অনুষ্ঠান ঘিরে যেভাবে দেশের ভেতর ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়, তাতে দেশের সংখ্যালঘুদের ভেতর ভীতি ও ত্রাস সৃষ্টি হয়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর আগে অযোধ্যায় উপহার বিতরণ করতে গিয়ে সেখানে ২২ জানুয়ারি ভিড় এড়াতে লোকদের কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘তারা যেন অযোধ্যায় না আসেন। তারা যখন ৫০০ বছর অপেক্ষা করেছেন, তখন আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে পারবেন।’

সবাই জানেন, ৫০০ বছরের সময়টা শুরু হয়েছে ১৫২৮ সাল থেকে, যখন সেখানে মোগল শাহেনশাহ বাবরের সিপাহসালার মীর বাকী বাবরি মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। বাবরি মসজিদের ব্যাপারে সঙ্ঘ পরিবার সরাসরি এ মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করেছে যে, এ মসজিদ রামমন্দির ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছিল। বাবরি মসজিদকে ‘দাসত্বের নিদর্শন’ অভিহিত করে এক রক্তঝরা আন্দোলন শুরু করা হয়। যার খেসারত দিতে হয়েছে জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে। দেশের দু’টি বড় সম্প্রদায় একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। এ আন্দোলনের মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল দেশের ভেতর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এমন পরিমাণে ছড়িয়ে দেয়া যে, এ দেশের মুসলমানদের যেন শত্রু হিসেবে দেখা হয় এবং তাদের পদে পদে লাঞ্ছিত করা হয়। সেকুলারিজমের দর্শন তাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। এটিকে এমনভাবে দুর্বল ও অসহায় করে দেয়া হয়েছে যে, নিজেদের সেকুলার বলা দলগুলো বিজেপির থাবা থেকে বের হতে অস্থিরতা অনুভব করছে।

এ কথা বেশ জোরেশোরে বলা হচ্ছে যে, রামমন্দির যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় নির্মাণ হচ্ছে, এ কারণে দেশের সব নাগরিকের এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা উচিত। এ দেশে কয়েক লাখ মন্দির রয়েছে এবং রয়েছে কয়েক কোটি হিন্দু। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মন্দির নির্মাণ ও তার উদ্বোধনকে এতটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সবাই জানেন, এ কর্মসূচির মৌলিক লক্ষ্য সেকুলারিজমের দর্শনকে একেবারে দুর্বল করা এবং মুসলমানদের এ কথা বিশ্বাস করানো যে, তোমাদের পূর্বপুরুষরা যে জুলুম নির্যাতন করেছিলেন, তোমাদের তার শাস্তি ভোগ করতে হবে। বারবার এ কথা বলা হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রামমন্দির নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু এ কথা বলা হচ্ছে না যে, ৯ নভেম্বর, ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ বাবরি মসজিদের জমি হিন্দু পক্ষকে সোপর্দ করার নির্দেশ দেয়ার সময় তিনটি কথা বেশ স্পষ্ট করে বলেছিলেন। প্রথমটি হচ্ছে, আদালত এ কথার কোনো প্রমাণ পাননি যে, বাবরি মসজিদ কোনো মন্দির ভেঙে বানানো হয়েছিল।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ২২-২৩ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ সালের মধ্যরাতে বাবরি মসজিদের ভেতর মূর্তি স্থাপন করা অপরাধমূলক কর্ম ছিল। তৃতীয়তটি হচ্ছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা ছিল অপরাধমূলক তৎপরতা। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, এ ব্যাপারে মুসলমানদের অবস্থান সম্পূর্ণ সঠিক ছিল এবং বিরোধী পক্ষের সব প্রমাণ ছিল ভিত্তিহীন। কিন্তু উচ্চ আদালত তিনটি মৌলিক বাস্তবতা স্বীকার করা সত্ত্বেও ওইসব লোকের জন্য কোনো দণ্ড প্রস্তাব করেননি, যারা ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল। ওই লোকেরা আজো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের এ কথা জিজ্ঞাসা করার কেউ নেই যে, তোমাদের মুখে কয়টি দাঁত রয়েছে? এটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অবিচার। উল্লেখ্য করার বিষয় হচ্ছে, মন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেশের যে আট হাজার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তন্মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের সেই পাঁচজন বিচারকও শামিল আছেন, যারা বাবরি মসজিদ-রামজন্মভূমি মামলার রায় দিয়েছিলেন। সম্প্রতি শঙ্করাচার্য অভিমুক্তেশরানন্দ দাবি করেছেন, অযোধ্যা বিবাদের সমাধান সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হয়নি; বরং আদালতের বাইরে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে হয়েছিল। কেননা, ইউপি সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াক্ফ বোর্ডের চেয়ারম্যান জেড ফারুকি বাবরি মসজিদে তাদের মালিকানা অধিকার ছেড়ে দেয়ার হলফনামা আদালতে পেশ করেছিলেন।

অযোধ্যায় নির্মাণাধীন রামমন্দির শুধু ইট-মশলা দিয়ে তৈরি একটি স্থাপনা হবে না; বরং এর মাধ্যমে এটিও প্রমাণিত করা হবে যে, আমরা ৫০০ বছর আগে হওয়া লাঞ্ছনার প্রতিশোধ নিয়েছি। এখানে এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে, এর আসল লক্ষ্য কারা এবং আগামীতে এ হিন্দু পুনরুজ্জীবনপ্রীতির খেসারত কারা দেবে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এখন এ দেশ কোন ভিত্তিমূলে দাঁড়াবে এবং এখানে বসবাসকারী সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে মুসলমানদের কী অবস্থা হবে। বর্তমান প্রশাসন এটি প্রমাণ করতে কোনো ত্রুটি করেনি যে, এ দেশ শুধু হিন্দুদের। আর এখানে তাদেরই কর্তৃত্ব চলবে। যেখানে সংখ্যালঘুদেরকে হিন্দুদের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর জীবন অতিবাহিত করতে হবে। এ মনোভাব দূর করার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হচ্ছে- আগামী সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানদের সর্বাত্মকভাবে সেকুলার দলগুলোর হাত শক্তিশালী করা। নিজেদের ভোট বিক্ষিপ্ত হতে দেয়া যাবে না। সেকুলারিজম ও গণতন্ত্রই ভারতের আত্মা। এছাড়া হিন্দুস্তানের কোনো কল্পনাই করা যায় না।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 


আরো সংবাদ



premium cement
গণতান্ত্রিক বিষয়কে বিএনপি ফাঁদ মনে করে : ওবায়দুল কাদের বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় দুর্ঘটনায় স্বামী নিহত, আইসিইউতে স্ত্রী গোবিন্দগঞ্জে যুবককে কুপিয়ে হত্যা, আটক ২ টানা ৮ দফা কমার পর আবার বাড়লো স্বর্ণের দাম সুন্দরবনে ২ কিলোমিটার জুড়ে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনার প্রায় ৩২ ঘণ্টা পর আপ লাইন চালু ফের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে এলো মিয়ানমারের ৪০ বিজিপি রোববার থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলেন শিব্বির আহমদ রাজশাহী পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের শিডিউল বিপর্যয়, ভোগান্তি যাত্রীদের গণহত্যা বন্ধ করে ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে : ছাত্রশিবির

সকল