১৮ মে ২০২৪, ০৪ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫
`


গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনার প্রায় ৩২ ঘণ্টা পর আপ লাইন চালু

উদ্ধার তৎপরতা - ছবি : নয়া দিগন্ত

গাজীপুরে যাত্রীবাহী টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের সাথে তেলের কন্টেইনারবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের প্রায় ৩২ ঘণ্টা পর শনিবার (৪ মে) সন্ধ্যায় চালু হয়েছে ঢাকা-জয়দেবপুর রেলরুটের আপ লাইনটি।

বগিসহ দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন দু’টি লাইনের উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে রেল লাইনের মেরামত কাজ শেষে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিট থেকে ওই লাইন চালু করা হয় বলে জানিয়েছেন জয়দেবপুর জংশন স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো: হানিফ মিয়া।

এদিকে, এ ঘটনায় ঢাকা-জয়দেবপুর ডাবল রেললাইনের একটি লাইন (আপ) বন্ধ থাকায় ঢাকার সাথে ময়মনসিংহসহ উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সবক’টি ট্রেন চলাচল সিডিউলের বিপর্যয় ঘটেছে। একাধিক ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন ট্রেনের যাত্রীরা।

জয়দেবপুর জংশন স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো: হানিফ মিয়া জানান, শুক্রবার সকালে ঢাকা-জয়দেবপুর ডুয়েল রেলরুটের গাজীপুরের জয়দেবপুর জংশন স্টেশনের পার্শ্ববর্তী আউটার সিগন্যালের ছোট দেওড়া কাজীবাড়ী এলাকার ক্রসিং পয়েন্টে আপ লাইন দিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা যাত্রীবাহী ট্রেন টাঙ্গাইল কমিউটারের সাথে একই লাইন দিয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সৈয়দপুরগামী জ্বালানি তেলের কন্টেইনারবাহী অপর একটি ট্রেনের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। যাত্রীবাহী ট্রেনের দুইটি বগির মধ্যে একটি অপরটির ভিতরে ঢুকে যায়। এঘটনায় যাত্রীবাহী ট্রেনের ইঞ্জিনসহ পাঁচটি বগি এবং কন্টেইনার বাহী ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সাতটি বগি দুমড়ে মুচড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরমধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেনের চারটি ও কন্টেইনারবাহী ট্রেনের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়। এঘটনায় উভয় ট্রেনের চালক (লোকো মাস্টার)সহ চারজন আহত হন। এ ঘটনায় ওই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা পর ওই ডুয়েল রেলরুটের আপ লাইন বন্ধ ডাউন লাইন দিয়ে উভয় দিকের ট্রেন চলাচল শুরু করে।

তিনি আরো জানান, এ দুর্ঘটনার পর ট্রেন দু’টিকে উদ্ধার করতে বিকেলে ঢাকা থেকে উদ্ধারকারী রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে আসে। পরে আখাউড়া থেকে অপর একটি ক্রেনও ঘটনাস্থলে পৌছে উদ্ধার কাজে যোগ দেয়। তারা টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত বগিগুলো রেখে অন্য বগিগুলো পেছনের দিকে টেনে জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন এলাকায় নিয়ে রাখে। উদ্ধারকারীরা টানা প্রায় ৩১ ঘণ্টা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে শনিবার বিকেল ৬টা পর্যন্ত তেলবাহী ট্রেনের একটি বগি বাদে বাকি বগিগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে লাইনের উপর তুলে পেছনে ধীরাশ্রম রেল স্টেশনে নিয়ে রাখে। দুর্ঘটনাকবলিত লাইনের দু’পাশে ব্লক করে কাজ করা হয়। পরে তেলবাহী ট্রেনের অবশিষ্ট বগিসহ দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন দুইটির ইঞ্জিন ও সবকয়টি বগি লাইনের উপর থেকে সরিয়ে নিয়ে লাইন মেরামত শেষে দুর্ঘটনার প্রায় ৩২ ঘণ্টা পর ওই লাইনে ট্রেন চলাচলের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়। এরপর শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ক্লিয়ারেন্স দিয়ে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল চালু করা হয়।

এদিকে, উদ্ধারকাজে অংশ নিতে ক্রেনম্যান আবুল হোসেন বলেন, ক্রেন দিয়ে লাইনচ্যুত হওয়া বগিগুলো লাইনের উপর তোলা হয়। পরে যেগুলো সচল করা সম্ভব ছিল, সেগুলো টেনে বগিগুলো জয়দেবপুর রেল স্টেশনে এবং তেলের কন্টেইনারবাহী বগিগুলো ধীরাশ্রম রেল স্টেশনে নিয়ে রাখা হয়েছে। উদ্ধার কাজ শেষে ক্রেনটি আখাউড়া ফিরে যাবে। আর তেলের বগিগুলো ধীরাশ্রম রেল স্টেশনে রাখার পর দুর্ঘটনাকবলিত দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন একসাথে টেনে ঢাকার কমলাপুর নিয়ে যাওয়া হবে। পরে সেখান থেকে এগুলো চট্টগ্রাম ওয়ার্কশপে পাঠানো হবে।

আবুল হোসেন আরো বলেন, এসব কাজ শেষ করতে আজকে সারাদিন লেগে যাবে। কাজ শেষ করে আমরা লাইন ক্লিয়ার করার পর ঢাকা-জয়দেবপুর ডুয়েল গেজ ডাবল লাইনের বন্ধ থাকা লাইনে রেল চলাচল শুরু হবে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনাকবলিত দু’টি ট্রেনের একটি ট্রেনের বগিতে দাহ্য পদার্থ রয়েছে। তাই তেলের কন্টেইনারবাহী ওই ট্রেনের প্রতিটি বগিকে সতর্কতার সাথে লাইনের উপর থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এজন্য একটু বেশি সময় লেগেছে। তবে বিকেল পর্যন্ত ওই ট্রেনের একটি ওয়াগন ব্যাতীত অন্যগুলোকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পরে যে ওয়াগনটি লাইনের উপর ছিল সেটিকেও সরিয়ে নেয়া হয়। বগিগুলো সরিয়ে নেয়ার পর লাইন মেরামত শেষে রেল কর্তৃপক্ষের ক্লিয়ারেন্সের প্রেক্ষিতে সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

শিডিউল বিপর্যয়, যাত্রীদের ভোগান্তি
গাজীপুরে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর থেকে ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গ চলাচলকারী সকল ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এতে যাত্রীরা পড়েছে ভোগান্তিতে।

জয়দেবপুর জংশন স্টেশনে শনিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বিভিন্ন জেলার শত শত যাত্রী গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। সেখানে কথা হয় রাজশাহী যেতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকা গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তন্ময়ের সাথে। তার সাথে তার এক বন্ধু রয়েছেন। তন্ময় বলেন, টিকেট কেটে সকাল পৌনে ৭টা থেকে জয়দেবপুর জংশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছি, কিন্তু বেলা প্রায় ১১টার দিকেও ট্রেনের দেখা মেলেনি।

জামালপুরগামী তিস্তা ট্রেনের জন্য একই স্টেশনে অপেক্ষায় আছেন আরেক যাত্রী জামাল। তিনি উত্তরার বায়িং হাউজে কাজ করেন। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি জামালপুর যাওয়ার জন্য প্লাটফর্মে বসে আছেন। শনিবার সকাল সাড়ে ৭টায় জয়দেবপুর স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টা পর্যন্ত স্টেশনে ট্রেন পৌঁছেনি।

স্টেশন মাস্টার মো: হানিফ মিয়া জানান, দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর থেকে পাশের লাইনে (ডাউন) ট্রেন চলাচল শুরু করলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এক লাইনে ট্রেন চলাচল করতে গিয়ে পদ্ধতিতে ট্রেন চালানো হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী ধীরাশ্রম স্টেশন এবং জয়দেবপুর জংশনে ট্রেন অপেক্ষায় রেখে একটি একটি করে ট্রেন দুই দিকে চলতে দেয়া হচ্ছে। এতে করে কোনো ট্রেনেরই শিডিউল ঠিক থাকছে না।

জয়দেবপুর রেল স্টেশনের কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার আল ইয়াসবাহ বলেন, এক লাইনে ট্রেন চলাচলের কারণে ঢাকা থেকে নেত্রকোনা চলাচলকারী মহুয়া কমিউটার ট্রেন (নং ৪৩ ও ৪৪), ঢাকা-জয়দেবপুর চলাচলকারী তুরাগ কমিউটার ট্রেন (নং তুরাগ কমিউটার ১৪) এবং ঢাকা-জামালপুর চলাচলকারী জামালপুর কমিউটার ট্রেন (নম্বর-৫১/৫২) শনিবারের উভয়মুখী যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। এছাড়াও ঢাকা থেকে কলকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রা প্রায় ৩ ঘণ্টা বিলম্বিত হয়েছে।

দুর্ঘটনায় তদন্ত শুরু, জংশন ও হাসপাতালে তদন্ত কমিটি
গাজীপুরে শুক্রবার ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি শনিবার কাজ শুরু করেছে।

প্রথমে এ কমিটির প্রধান ও গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: মতিউর রহমান জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশনে আপ গুমটি স্টেশন মাস্টার আবুল হাসেম, পয়েন্টসম্যান সাদ্দাম ও মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এসময় তার সাথে ছিলেন ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন ও জয়দেবপুর জংশনের স্টেশন মাস্টার মো: হানিফ মিয়া।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মতিউর রহমান জানান, এদিন সকালে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্তের বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরে দুপুরে জয়দেবপুর জংশনে ট্রেন দুর্ঘটনার দিন কর্তব্যরত স্টেশন মাস্টার আবুল হাসেম, য়েন্টসম্যান সাদ্দাম ও মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার ও তাদের লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করা হয়।

তিনি আরো বলেন, পরে তদন্ত কমিটি শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিকৃত দুর্ঘটনাকবলিত টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের যাত্রী শরীফ মাহমুদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। কিন্তু সেখানে ভর্তিকৃত এএলএম সবুজ হাসান ও এলএম মো: হাবিবুর রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর হওয়ায় তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব হয়নি।

ইতোমধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটনা তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনের একটি ও রেলওয়ের দু’টিসহ মোট তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় রেলওয়ের তিন কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তকৃতরা হলেন- আপগুন্টি স্টেশন মাস্টার মো: আবুল হাসেম, পয়েন্টস ম্যান সাদ্দাম হোসেন ও মোস্তাফিজুর রহমান। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন কর্মকর্তা।

ঘটনার দিন শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা কম ছিল। ফলে ভয়াবহ হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।


আরো সংবাদ



premium cement