১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


মধ্যযুগে সমাজ বিবর্তন ও নগরজীবন

-

মধ্যযুগে ইউরোপে নগরগুলোর উৎপত্তির সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যেমন কঠিন; তেমনি বিকাশের বিষয়টিও স্পষ্ট করে বলা দুরূহ। এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই যে, একাদশ শতকের শুরু থেকে ইউরোপে নগরের সংখ্যা এবং গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ফলে মধ্যযুগে ইউরোপের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মাত্রা পায়।

হাজার বছর আগে ইউরোপ নগরায়নের নতুন পর্বে প্রবেশ করে। জনসংখ্যা তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘটনায় ইউরোপে যে একটি জটিল আন্তঃব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তা নতুন শহরের উত্থানে সাহায়ক হয়। নগরগুলোর আকার বাড়তে থাকে। পণ্য কিংবা তথ্য প্রবাহে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে আস্তে আস্তে বিকশিত হয়। নবম-দশম শতকের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার পর একাদশ শতক থেকে শুরু হয় ইউরোপের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। এরপর কয়েক শতক ধরে বিকশিত নগরগুলোর অস্তিত্ব ইউরোপের সমাজকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করে।

ব্যবসায় বাণিজ্য বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ নগরের উৎপত্তি। দশম শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী ও জাতীয় অর্থনীতির মধ্যে নগরের কোনো স্থান বা ঠাঁই তেমন ছিল না। কিন্তু বাণিজ্যিক তাগিদে এবং প্রয়োজনে মানুষকে একত্রিত হতে হতো। পণ্য আমদানি-রফতানি, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা সক্রিয় ও চাঙ্গা রাখতে নগরজীবনের আবির্ভাব। পশ্চিম ইউরোপে বাণিজ্যের প্রয়োজনে যেসব স্থানে বণিক সমাজের সমাবেশ ঘটেছিল, সেগুলোতে জনবসতি আগেই গড়ে উঠেছিল। ইতালি ও স্পেনে বেশির ভাগই ছিল বিশপশাসিত অঞ্চলের নগর, আর নেদারল্যান্ডস, রাইনের পূর্বাঞ্চল ও দানিয়ুবের উত্তরাংশে জনপদগুলোর প্রসিদ্ধি ছিল দুর্গের অধিষ্ঠান কেন্দ্র রূপে। পরবর্তীতে এগুলোকে কৃষি সমাজের অপরিহার্য অঙ্গ বা শাসনের সুবিধায় কতকগুলো কেন্দ্র বলে মনে হতো। দ্বাদশ শতকের অসামান্য বাণিজ্যিক তৎপরতা বহু নগরকে পৌর চরিত্র অর্জনে সাহায্য করে তাদের রূপান্তর ঘটিয়েছিল।

মূলত একাদশ শতকের মধ্যে ইউরোপের কৃষি উৎপাদনের অভাবনীয় উৎকর্ষ, জনস্ফীতি ও শ্রমিক সরবরাহের নিশ্চয়তা নগরগুলোর উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তা ছাড়া সামন্ত ব্যবস্থা বিস্তারে উদ্ভূত ছিন্নমূল কারিগর কাছের নগরগুলোতে আশ্রয় নিয়ে সেখানকার উৎপাদন ব্যবস্থার অংশীদার হয়ে ওঠে। এভাবেও নগরের বিকাশ সহজ হয়ে উঠেছিল। দ্বাদশ শতকের আগেই ইউরোপের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ ফ্রান্স ও জার্মানির উত্তরাঞ্চল, ইংল্যান্ড ও স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোর জনবসতি ক্রমবর্ধমান হওয়ায় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও প্রাচ্যের পণ্যাদির জন্য চাহিদা বাড়তে থাকে। ইউরোপের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের এ চাহিদা ও সরবরাহ সহজতর করতে মধ্যবর্তী অঞ্চলের বহু স্থানে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে। বস্ত্রশিল্প, ডিনাটের তামার জিনিসপত্র, কর্ডোভার চর্মশিল্প এবং মওঁপেলিয়ের মসলা ও রঞ্জক দ্রব্যের উৎপাদন পুরো ইউরোপের বণিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে; যে কারণে দ্বাদশ শতকের মধ্যেই বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদন শুধু ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না থেকে উত্তর ও মধ্য ইউরোপীয় নগর, জেনোয়া, পিসা বা ভেনিসের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ভেনিসের সাথে কনস্ট্যান্টিনোপলের বাণিজ্য ছাড়া দশম খ্রিষ্টাব্দের পর, প্রাচ্যের মুসলমান রাজ্যগুলোর পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহজনিত দুর্বলতার কারণে ভেনিস, পিসা প্রভৃতি অতি দ্রুত অভাবনীয় সাফল্যের পথে এগিয়ে যায়। প্রথম ক্রুসেডের আগেই ইতালির বাণিজ্য জাহাজ সমুদ্রপথে প্রাচ্য দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। ইতালির বণিকদের এ সাফল্যই দেশটির অনেক নগরের উত্থানের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।

মধ্যযুগের ইউরোপীয় নগরগুলোর উৎপত্তি এবং দ্রুত নগরায়নে যেসব কারণের অবদান ছিল, সেগুলো মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দশম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়। কোথাও কোথাও সংখ্যাটা চারগুণ বেড়ে যায়। শহুরের জনসংখ্যা এ সময়ে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে দ্রুত বেড়ে গিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটেনে জনসংখ্যা ১০৬৬ ও ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনগুণ বেড়ে যায়। দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকাল থেকে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বাণিজ্যপ্রসূত লাভ বণিক শ্রেণীর হাতে পর্যাপ্ত মূলধন তুলে দেয়। ওই সময় বহু ভূস্বামী তাদের ভূসম্পত্তির মধ্যে জনগণকে বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করতে বিনাশর্তে জমি দিয়ে নিকটবর্তী অঞ্চলের মানুষদের প্রলোভিত করতেন। নগর গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভূস্বামীদের থেকে স্বাধীন হয়ে গড়ে ওঠা এসব জনপদ স্বায়ত্তশাসন লাভ করে নগরে পরিণত হয়েছিল। যেসব অঞ্চলে সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল ছিল, সেসব জনপদে পৌরশাসনের বিকাশ সহজ হয়েছিল; বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানির মধ্যাঞ্চলে। এসব অঞ্চলের জনপদগুলো কনসুলেট আখ্যা দেয়া হয়েছিল। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, দ্বাদশ শতকের শুরুতে গড়ে ওঠা নগরগুলোর আয়তন বৃদ্ধি পায় বলে মধ্যযুগের জার্মানির মাঝারি নগরগুলোর আয়তন ৫০ হেক্টরের বেশি ছিল না। দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুতে কোলনের আয়তন ছিল ১১৮ হেক্টর, ১১৮০ খ্রিষ্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯৬ হেক্টরে।

মধ্যযুগের প্রায় সব নগরই ছিল সুরক্ষিত। নগর প্রাচীর গ্রামাঞ্চল ও নগরের মধ্যবর্তী সীমারেখা নির্দিষ্ট করত। সাধারণত নগরের মাঝে তৈরি হতো বাজার এবং কাছাকাছি গির্জা ও টাউনহল। রাস্তাগুলো ছিল সঙ্কীর্ণ, বেশির ভাগ নগরই ছিল কুশ্রী ও ঘিঞ্জি। পরবর্তীকালে ইতালিতে প্রথম শান বাঁধানো রাস্তা তৈরি হয়। তার পর ফ্রান্স, প্রাগ ও ইউরোপের অন্যান্য শহরে শান বাঁধানো রাস্তা ও ফুটপাথের ব্যবস্থা করা হয়। নগরে সাধারণত পৌরভবন ও ক্যাথিড্রালের থেকে উঁচু বাড়ি নির্মাণের অধিকার কাউকে দেয়া হতো না।

কারুশিল্পীদের বাসস্থান দোতলা হতো, যাতে বাড়ির একতলা কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে এবং ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে বহু শাসক উন্নততর নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন নগর প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ইংরেজ শাসনাধীন অঞ্চলে ১২০টি উপনিবেশ নগর গড়ে ওঠে।

নগরজীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল পাকা দালান। বেশির ভাগ অঞ্চলের শহরগুলোতে একাদশ শতাব্দীর পর থেকে নির্মাণে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে। বৃহত্তর শহরে রাস্তাগুলোর কাঠামোর বিশেষ পরিবর্তন করা হয়নি। শুধু নতুন রাস্তাগুলো সংযুক্ত হয়েছিল। জমিদার ও ভাড়াটিয়ারা খোলা জমিতে গৃহ নির্মাণ করতেন। যেসব নগরে মেলা বসত, সেখানকার বাজারের রাস্তাগুলোই সাধারণত প্রশস্ত হতো। নতুন শহরের রাস্তাগুলো গ্রিড ব্যবস্থায় গড়ে ওঠে। বাজারগুলো প্রায়ই দুর্গ অথবা শহরের প্রবেশপথে যেখানে বিভিন্ন রাস্তা এসে মিশত সেখানে গড়ে উঠত। একাধিক বাজারের অস্তিত্ব ছিল ব্যস্ত শহরগুলোতে। কোলনের মতো প্রধান নগরগুলোতে সংসদীয় অঞ্চল, কোর্ট হাউজ ও নাগরিক ভবনগুলো প্রায়ই গড়ে উঠত প্রধান বাজার ও শহর কর্তৃপক্ষের ভবনসংলগ্ন অঞ্চলে।

নগর পুনর্নির্মাণ বলতে সাধারণত দুর্গ নির্মাণ, ক্যাথেড্রাল ও গির্জা পুনর্নির্মাণের সাথে যুক্ত বোঝাত। মধ্যযুগের ইউরোপে এ-জাতীয় কর্মসূচিতে বিশেষ অবদান ছিল বাণিজ্যিক সম্পদের, যা নবগঠিত নগরের নাগরিকদের ক্ষমতা এবং নগর শৃঙ্খলার ধর্মীয় আদর্শের প্রতি নগর কর্তৃপক্ষের সম্মতি উভয়ই প্রকাশ পেত। শহরের আকার নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ সম্মিলিত প্রকল্পে পরিণত হয় এবং জেনোয়ার নাগরিকরা তাদের বন্দরের পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। পিসা নাগরিকরা জেরুসালেমের আদলে একটি ক্যাথেড্রাল নির্মাণের প্রকল্পে অর্থের জোগান দেন। উত্তর ইউরোপের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মনিরপেক্ষ ‘প্রভু’দের ক্রমবর্ধমান সম্পদ এই স্থাপত্যশিল্পের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

মধ্যযুগে ব্যবসায় বাণিজ্যের বিপুল বিস্তারে নগরগুলোর ভ‚মিকা ছিল সক্রিয় এবং সেই কারণে ব্যবসা সচল রাখা ও নাগরিকদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতি নগর কর্তৃপক্ষের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকত। বিভিন্ন শ্রেণীর কারিগর বা ব্যবসায়ীদের দিয়ে গঠিত গিল্ডগুলোর ভ‚মিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পণ্যের চাহিদা ও জোগানের ব্যাপারে সামঞ্জস্য রাখা, উৎপাদনে নিযুক্ত কারিগরদের নিরাপত্তা দেয়া, সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিমিত মুনাফা লাভের পথ বন্ধ করা ইত্যাদি নাগরিক জীবনের সাথে যুক্ত সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে দ্বাদশ শতকে উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু গিল্ড গড়ে ওঠে। ত্রয়োদশ শতকে বিশেষ বিশেষ পণ্য উৎপাদনে নিযুক্ত কারিগরদেরই গিল্ড তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হতে দেখা যায়। ধীরে ধীরে অন্য পেশায় নিযুক্ত কারিগররা আলাদা আলাদা গিল্ড তৈরি করতে শুরু করেন। পণ্যের মূল্য ন্যায্য রাখতে- তার মান যথার্থ রাখতে গিল্ডগুলো নিজ নিজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার দাবি করত। চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে গিল্ড ব্যবস্থা মুষ্টিমেয় বণিকের স্বার্থ রক্ষাতেই নিয়োজিত হতে থাকে।

ইউরোপীয় সমাজে নগরের বাতাসে ঘুরে বেড়ায় মুক্তি ও স্বাধীনতা। জীবিকার প্রয়োজনে নগরের মধ্যে অসংখ্য মানুষের সমবেত হওয়ায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ইউরোপীয় সমাজজীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। নগরের পণ্য উৎপাদক ও কারিগর শ্রেণীর প্রয়োজনে শ্রমিকের অভাব আর অনুভূত হতো না। স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নগরবাসীর বিজয়ের অর্থ ইউরোপে একটি নতুন শ্রেণীর বিবর্তন হয়েছিল- একটি শক্তিশালী, স্বতন্ত্র ও স্বাবলম্বী গোষ্ঠী, যাদের ব্যবসায়ের আগ্রহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করে। এ শ্রেণীর সদস্যদের ডাকা হতো বার্গার বলে এবং বুর্জোয়া বলা হতো। রাজা সামন্তপ্রভুদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এদের ওপর বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন।

এ শ্রেণীর অর্থনৈতিক কায়েমি স্বার্থ ও কার্যকলাপ ইউরোপে প্রাথমিক পুঁজিবাদের জন্ম দেয়। শহরগুলোর উত্থান এবং বুর্জোয়া শ্রেণিগুলোর আবির্ভাবের সাথে জড়িত ছিল সার্ফডম ও ম্যানুয়াল ব্যবস্থার পতন এবং একটি আধুনিক সমাজের সূচনা। একটি মধ্যযুগীয় জনপদের নাগরিকের পদমর্যাদা জন্ম, বংশ ও জমির ওপর নয়; অর্থ ও পণ্যের ওপর নির্ভর করত। সামাজিক স্তরের শীর্ষে ছিল মেডিসি, ফুগার ও কোউরের মতো নামধারী ব্যবসায়ী পরিবার, দুর্দান্ত বণিক ও ব্যাংকিং পরিবার। তার পরের স্তরে থাকতেন মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ধনী বণিক এবং তাদের নিচে কারিগর এবং ছোট দোকানদার। নিম্নতম স্তরে ছিল অদক্ষ শ্রমিক, যাদের দারিদ্র্য ও অসন্তোষ মধ্যযুগের ইতিহাসের নিয়ত সত্য হয়ে ওঠে।

লেখক : ছাত্রনেতা


আরো সংবাদ



premium cement