২১ মে ২০২৪, ০৭ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১২ জিলকদ ১৪৪৫
`


গাজার রাফাহ সীমান্ত কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

- সংগৃহীত

গাজা উপত্যকার সবচেয়ে দক্ষিণে রাফাহ শহরে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী হামলা শুরু করার পর থেকে রাফাহ শহর এবং রাফাহ ক্রসিং আবারো বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

রাফাহ হলো গাজা উপত্যকার সবচেয়ে দক্ষিণে ৫৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি শহর এবং রাফাহ ক্রসিং হলো মিশর আর গাজা ভূখণ্ডের মধ্যে একমাত্র সীমান্ত পারাপারের পথ। যেটা মিসরের সিনাই মরুভূমি ঘেঁষে অবস্থিত।

গত ৫ মে রাফাহ ক্রসিং থেকে কিছুটা পূর্বে ইসরাইলের সীমান্তঘেঁষা এবং ইসরাইলের নিয়ন্ত্রিত কেরেম শালোম ক্রসিং-এর দিকে রকেট ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করে হামাসের সামরিক বাহিনী আল-কাসাম ব্রিগেড।

এরপরই রাফাহকে ঘিরে ইসরাইল তার কার্যক্রম শুরু করে।

নিরাপদ অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছে মানুষ
গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরাইলে হামলা চালানোর পর গাজায় বিমান হামলা ও স্থল অভিযান শুরু করেছিল ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।

সে সময় রাফাহকে ইসরিইলি সামরিক বাহিনী ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা দিলে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে পালিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি শহরটিতে আশ্রয় নেয়।

এখন ইসরাইলি সামরিক বাহিনী লিফলেটের মাধ্যমে রাফাহতে বড় ধরনের আক্রমণ শুরুর ঘোষণা দিয়ে সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

এরপর রাফাহতে আশ্রয় নেয়া ফিলিস্তিনিরা শহরটি ছেড়ে যেতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বেশির ভাগই মধ্য গাজার দেইর এল-বালাহ শহরের দিকে পা বাড়িয়েছেন।

ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সম্প্রচারিত এক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় রাফাহর ফিলিস্তিনি অংশে ইসরাইলি ট্যাঙ্ক প্রবেশ করছে। এছাড়া আকাশ থেকেও বোমাবর্ষণ চলছে।

সেই সাথে রাফাহ ক্রসিং এবং এর দুই পাশে বিস্তৃত সাড়ে তিন কিলোমিটার এলাকা, যা ফিলাডেলফি করিডোর নামে পরিচিত, সেটার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী।

উদ্দেশ্য হলো- যুদ্ধে জর্জরিত গাজাবাসী যাতে এই সীমান্ত দিয়ে চলাচল করতে না পারে এবং রাফাহ সীমান্ত দিয়ে কোন সাহায্যও প্রবেশ করতে না পারে।

রাফাহতে অভিযানের কারণ হিসেবে ইসরাইলি বাহিনী এই অঞ্চল থেকে হামাসের ঘাঁটি উপড়ে ফেলার কথা বলছে।

গাজা থেকে বের হওয়া পথ
গাজা উপত্যকাটির দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার। প্রস্থে কোথাও ছয় আবার কোথাও ১২ কিলোমিটার। এখানে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বসবাস করেন।

উপত্যকার উত্তর ও পূর্ব দিকে ইসরাইল, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর আর দক্ষিণে মিশর।

গাজার আকাশসীমা এবং এর সমুদ্র উপকূল নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল, অন্যদিকে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজাবাসীর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।

রাফাহ ক্রসিং ছাড়াও স্থলপথে গাজার আরো দুটি ক্রসিং রয়েছে। একটি রাফাহ ক্রসিং থেকে কিছুটা পূর্বে এগিয়ে গেলে ইসরাইলের সাথে সীমান্ত পথ কেরেম শালম ক্রসিং। আরেকটি ক্রসিং হলো একদম উত্তরের বেইত হানুন বা ইরেজ ক্রসিং।

এর বাইরে গাজার সাথে ইসরাইলের আরো চারটি ক্রসিং থাকলেও গত ১০/১৫ বছর ধরেই সেগুলো বন্ধ রয়েছে।

হামাস ইসরাইলে হামলা চালানোর সময় থেকেই ইসরাইলের সাথে গাজার দুটি ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া হয়। খোলা থাকে শুধু রাফাহ ক্রসিং।

উপকূলও ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সমুদ্রপথে এই অঞ্চল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব না। গাজার বিমানবন্দরও ২০০১ সালে ধ্বংস করে দেয় ইসরাইল।

এমন অবস্থায় রাফাহ ক্রসিং হয়ে উঠেছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষদের গাজা ছেড়ে যাওয়া এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর একমাত্র স্থলপথ, একে তখন গাজার লাইফলাইনও বলা হয়েছিল।

এখন সেই পথেরও নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিয়েছে ইসরাইল।

৬ মে হামাস, মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিলেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এতে সায় দেয়নি। বরং তারা রাফাহতে অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছে।

ইসরাইল এই রাফাহ শহর ও রাফাহ ক্রসিং নিয়ে যা করছে তা অসলো শান্তি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পারাপারের কঠোরতা
রাফাহ ক্রসিং মিশরের সীমান্ত ঘেঁষা হলেও ফিলিস্তিনিরা চাইলেই এই পথ দিয়ে গাজা ছাড়তে পারেন না। এর প্রক্রিয়া বেশ লম্বা এবং জটিল।

রাফাহ ক্রসিং পার হতে হলে একজন ফিলিস্তিনিকে অবশ্যই তার ভ্রমণের অন্তত দুই থেকে চার সপ্তাহ আগে স্থানীয় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে নিবন্ধন করাতে হয়।

এই নিবন্ধন করালেই যে তারা পার হতে পারবেন তারও কোনো গ্যারেন্টি নেই। কারণ তাদের আবেদন ফিলিস্তিনি বা মিশরীয় কর্তৃপক্ষ কোনো নোটিশ বা ব্যাখ্যা ছাড়াই প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

এমনকি গাজাবাসীর জন্য যুদ্ধের আগেও এই রাফাহ ক্রসিং দিয়ে ওপারে যাওয়া সহজ ছিল না। এজন্য তাদেরকে গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদনপত্র জমা দিতে হতো।

এই তালিকা তৈরির কাজ করে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ। তালিকায় জায়গা পেতে মধ্যস্থতাকারীকে টাকাও দিতে হতো। এরপরও গাজাবাসীর সীমান্ত পার হওয়া ছিল অনিশ্চিত।

যুদ্ধের সময়ে রাফাহ ক্রসিং পারাপারের খরচ কয়েকগুণ বেড়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে যেখানে জনপ্রতি ৭০০ ডলার লাগত, সেটা ২০২৪ সালের এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কমপক্ষে পাঁচ হাজার ডলার এবং শিশুদের জন্য কমপক্ষে আড়াই হাজার ডলার।

আবার কেউ কেউ এটাও বলেছেন যে- জনপ্রতি সীমান্ত পাড়ি দেয়ার খরচ ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে।

রাফাহ শহর সম্পর্কে আমরা কী জানি?
রাফাহ হলো বিশ্বের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি, যার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে।

তবে আধুনিক যুগে এর পরিচিতি হয়েছে গণমাধ্যমে নানা খবর প্রকাশের কারণে।

রাফাহ-র বেশির ভাগ বাসিন্দার মতে তারা এই শহরে এসেছেন খান ইউনিস শহর থেকে, যা গাজার আরেক প্রান্তে অবস্থিত।

এছাড়া নেগেভ মরুভূমি এবং সিনাই মরুভূমি অঞ্চল থেকেও অনেকে এসেছেন।

এরপর ১৯৪৮ সালে নাকবার পর ফিলিস্তিনের বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে হাজার হাজার মানুষ রাফাহয় বসবাস করতে শুরু করেন।

গত কয়েক মাস ধরে ১৫ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি রাফাহতে আশ্রয় নিয়েছেন, যাদের বেশির ভাগই যুদ্ধ থেকে বাঁচতে নিজেদের বাড়িঘর ফেলে এসে রাফাহতে বাস্তুচ্যুত জীবন যাপন করছেন।

ইসরাইল রাফাহ-র নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় এখন সেখানকার পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

বিপর্যয়কর প্রভাব
রাফায় আক্রমণ করলে বহু বেসামরিক মানুষ হতাহত হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে ইসরাইলকে হামলা না চালাতে চাপ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, রাফাহতে সামরিক অভিযান চালানো হলে এর পরিণাম বিপর্যয়কর হবে।

অন্য দিকে পূর্ব রাফাহ থেকে এক লাখ ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ইসরাইলের সিদ্ধান্তকে অমানবিক বলে আখ্যা দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার।

এটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং মানবিক নীতির চরম লঙ্ঘন বলে তিনি জানান।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ত্রাণ দেয়া বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএ-র মতে, রাফাহ ক্রসিং বন্ধ করে দেয়ায় সোমবার থেকে এই পথ দিয়ে কোনো ত্রাণবাহী যান বা ট্রাক গাজায় ঢুকতে পারছে না।

এতে গাজার মানবেতর পরিস্থিতি আরো প্রকট হতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছে।

রাফাহতে হামলাকে ইসরাইলের ‘কৌশলগত ভুল, রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং মানবতার দুঃস্বপ্ন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।

এমন অবস্থায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাতে ইসরাইল ও হামাসকে আরো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

গত অক্টোবর থেকে শুরু করে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যুদ্ধের সাত মাসে ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই শিশু ও নারীসহ বেসামরিক মানুষজন।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement