০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রাজনীতির দেউলিয়াপনা

রাজনীতির দেউলিয়াপনা - ছবি : নয়া দিগন্ত

সম্প্রতি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য কুয়েতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। সংবাদ মতে, কুয়েতের গোয়েন্দাসংস্থা কর্তৃক তাকে মানব ও অর্থপাচার সংক্রান্ত অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে যদিও তার সহধর্মিণী (যিনি নিজেও একজন মহিলা সাংসদ) গ্রেফতারের কথাটি অস্বীকার করেছেন। ওই এমপির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা টেলিভিশন চ্যানেলে বলেছেন, তিনি এলাকায় তেমন পরিচিত নন, থাকেন কুয়েতে এবং সেখানে বড় ব্যবসায় পরিচালনা করেন। গত নির্বাচনে তিনি হঠাৎ দেশে এসে মনোনয়ন সংগ্রহ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী অজানা কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ালে তিনিই নির্বাচিত হয়ে যান। পরে তার সহধর্মিণীও সংরক্ষিত মহিলা কোটায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। প্রশ্ন হলোÑ একজন স্বল্প পরিচিত ব্যক্তি, যার কর্মস্থল কুয়েতে, তাকে কারা ভোট দিয়ে ‘নির্বাচিত’ করল? আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে কিভাবে তিনি এই মহামারীর সময়ে দেশত্যাগ করে বিদেশে বসে ব্যবসায়িক কাজকর্ম করছিলেন?

প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি হলো রাজার নীতি। অর্থাৎ ‘রাজাদের নীতি বা নীতির রাজা’। নীতির রাজা হিসেবে রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল সমাজের, দেশের এবং বিশ্বের সেরা। কিন্তু আমরা দেখছি এর উল্টোটা ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে আমাদের দেশসহ পৃথিবীতে চলছে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বিশ্বজুড়ে দেখা যাচ্ছে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন বা দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতারোহণের পদ্ধতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনায় অদ্যাবধি যা তিনি করেছেন, তা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনাকে আরো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছে। তার পরিণতিতে আমেরিকার সমাজ আজ স্পষ্টত দ্বিধাবিভক্ত। যদিও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের এই বিষবৃক্ষ যুগ যুগ ধরে মার্কিনিরা পরিচর্যা করে আসছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেটাকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করে তুলেছেন। করোনা মহামারী ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে পুননির্বাচিত হওয়ার মোহে তিনি দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ইতোমধ্যে আমৃত্যু স্বপদে বহাল থাকার আইন করে ফেলেছেন। উইঘুরের মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে তাদের ওপর চরম নির্যাতন-নিষ্পেষণ চালাচ্ছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও আরো ছয় বছর ক্ষমতায় থাকার বন্দোবস্ত করেছেন। মিসরের জেনারেল সিসি নির্লজ্জভাবে দেশের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে মাত্র এক বছর শাসনের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতায় বসেছেন। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাত উস্কে দেয়া এবং তাকে জিইয়ে রাখার নীতিই মূলত পশ্চিমা ভূ-রাজনীতির নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ইসরাইলি রাজনীতিকরা ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোকে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করছেন।

এদিকে সৌদি আরবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়ে ভবিষ্যৎ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেছেন। এমনকি ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে সংস্কারের নামে বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে লালিত ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ধারণাকে উলট-পালট করে দিচ্ছেন। দুর্বৃত্তপরায়ণ রাজনীতির চর্চা উপমহাদেশেও চলছে ব্যাপকভাবে। শ্রীলঙ্কায় উগ্র বৌদ্ধত্ববাদের উত্থানকে উস্কে দিয়ে রাজনীতিকরা ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছেন, যার বলি সংখ্যালঘু মুসলমানরা। উগ্র বৌদ্ধত্ববাদের চরম উত্থান ঘটিয়ে মিয়ানমারের অসামরিক পোশাকধারী সামরিক সরকার প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগত নিধনের মাধ্যমে দেশচ্যুত করে বাংলাদেশকে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন করে দিয়েছে। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারতেও চলছে দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি। অর্থনৈতিক সফলতায় ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উগ্র হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেছেন। এর পর থেকে তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন। বিতর্কিত ‘নাগরিকপঞ্জি’ তৈরির মাধ্যমে আসামের মুসলমানদের দেশবিহীন করে বন্দিশিবিরে আবদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের নামে ভারতের মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছেন। দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় একতরফাভাবে মুসলমানদের গণহত্যার শিকার করেছেন। সেই সাথে দীর্ঘ দিনের লালিত ঐতিহ্যকে পদদলিত করার মাধ্যমে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে কাশ্মিরকে কেন্দ্রীয় সরকারের অঙ্গীভূত করেছেন। কাশ্মিরকে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে মাত্র এক কোটি ৪০ লাখ নাগরিকের বিপরীতে ৯ লাখ সেনা মোতায়েন করে পুরো রাজ্যকে অত্যাচার-নির্যাতনের প্রকোষ্ঠ বা বৃহত্তর বন্দিশিবির বানিয়ে রেখেছেন। প্রতিদিনই সেখানে আজ মুসলিম নাগরিকরা নির্যাতন আর হত্যার শিকার। এসব জুলুম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে শুধু রাজনীতির নামে, রাজনৈতিক নেতাদের তত্ত্বাবধানে।

বিশ্ব রাজনীতির দেউলিয়াপনার ঢেউ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও এসে লেগেছে। রাজনৈতিক অরাজকতার সুযোগে অরাজনৈতিক আর নীতিবিবর্জিত ব্যক্তিরা এসে রাজনীতির ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। একজন এমপি আজ বিদেশ-বিভুঁইয়ে গ্রেফতার হয়ে দেশকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। অবশ্য এই বিরাজনীতিকরণ অর্থাৎ রাজনীতির নামে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে রাজনীতিকে কলুষিতকরণ প্রক্রিয়া বেশ আগেই শুরু হয়েছে আমাদের দেশে। গত এক দশকে দেশের পুরো রাজনৈতিক চরিত্রই বদলে গেছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে সব অগণতান্ত্রিক কাজই আমরা করছি। স্বৈরশাসনের অবসানের পর তিন জোটের রূপরেখা মোতাবেক পরপর চারটি সরকার সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করেছিল। পরবর্তীতে সরকারগুলো দেশে-বিদেশে প্রশ্নহীন কোন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটেছে হাইকোর্টের একটি রায়ের আলোকে। এতে বিরোধী দলের একগুঁয়েমি ও ভুল সিদ্ধান্তের পাশাপাশি সরকারি দল ফাঁকা মাঠে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠনের ব্যবস্থা করে ফেলে। এরপর থেকেই মূলত দেশের রাজনীতির আকাশে পুনরায় মেঘের ঘনঘটা। গণতন্ত্রের উদ্যান ছেড়ে রাজনীতি আবদ্ধ হয়ে পড়ে দলীয় চার দেয়ালের ভেতর। বিরোধী দল রাজনীতিতে ফেরার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে। ফলে পরের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিলেও ভোটাররা ভোটদানে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হয়। সারা বিশ্ব দেখে, এক অবাক করা নির্বাচনী ফলাফল।

তিনবারের সরকার পরিচালনা করা এবং অনস্বীকার্যভাবে জনপ্রিয় একটি দল ৩০০ আসনের মধ্যে পায় মাত্র পাঁচটি আসন। অবশ্য বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্বাচন প্রক্রিয়ার সচিত্র সংবাদ দেখে নির্বাচনে আসলে কী ঘটেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না দেশবাসীর। এর পরও পরাজিত বিরোধী দলটি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এতে ক্ষমতাসীন সরকার আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকারি দলের এই একচ্ছত্র আধিপত্যই মূলত অরাজনৈতিক বা নীতিবিবর্জিত ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করে। ভিড় করে বিভিন্ন শক্তিমান নেতাদের ছায়াতলে। তারা হয়ে ওঠে আশ্রয়দাতার চেয়েও শক্তিমান। অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি সবই তারা পেয়ে যায় রাতারাতি। একসময় এরা হয়ে পড়ে অপ্রতিরোধ্য। এদের দেখাদেখি অনেক দুবর্ৃৃত্তও এসে ভিড় জমায় এবং দুধের মাছির মতো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে থাকে। ফলে দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে যাতে রাজনীতির চরিত্রই কলঙ্কিত হতে থাকে। শেয়ার বাজারে ধস, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, ডেসটিনি ইত্যাদি কেলেঙ্কারি ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা তছরুপের মতো ঘটনাও ঘটে যায়।

একই ধারাবাহিকতায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে ছাত্র নেতাদের কোটি টাকা চাঁদা দাবি, আবরার হত্যাকাণ্ড এবং ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি মতো ঘটনাও ঘটেছে। আর উঠে এসেছে পাপিয়া, জিকে শামীম এবং ‘সম্রাট’রা। এমনকি তৃণমূলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও পিছিয়ে থাকেননি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে অংশ নিতে। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, এই করোনা মহামারীর সময় না খেতে পারা মানুষগুলোর মুখের খাবার পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছেন অসৎ তৃণমূল জনপ্রতিনিধি। এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ জনের মতো এই ধরনের জনপ্রতিনিধি এসব অপরাধে বরখাস্ত হয়েছেন বা আইনের আওতায় এসেছেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সর্বশেষ কেলেঙ্কারিতে জড়ালেন একজন সংসদ সদস্য। আরো লজ্জাজনক হলো তিনি গ্রেফতার হয়েছেন বিদেশের মাটিতে বিদেশী অপরাধ দমন গোয়েন্দাসংস্থার হাতে।

৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশের এ কী অবস্থা! সেই সব শহীদের রক্তের সাথে তাদের উত্তরসূরি হিসেবে আমরা কি বেইমানি করছি না? রাজনৈতিকভাবে আমরা কি এতই দেউলিয়া হয়ে পড়েছি? আমরা উত্তরসূরিদের হাতে এ কোন ধরনের রাজনীতি দিয়ে যাচ্ছি? আমাদের কি এতটুকু বোধোদয়ও হবে না? আসুন, আমরা সবাই মিলে সঠিক রাজনীতির চর্চা করি। যাদের রাজনীতি করার কথা, তাদেরই এই কাজটি করতে দেই। দেশের মানুষকে ভালোবাসি। তাদের কল্যাণের জন্যই রাজনীতি করি ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে। আর আন্তরিকভাবেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি করি। তাহলেই আমরা রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা থেকে বের হয়ে আসতে পারব ইনশাআল্লøাহ। অন্যথায় জাতি হিসেবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো চরমভাবে। 

লেখক : পিএইচডি গবেষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
E-mail : maksud2648@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement