৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ফাঁকা ঢাকায় নিরুত্তাপ বর্ষবরণ

চারুকলার উদ্যোগে রাজধানীর শাহবাগে ১ বৈশাখের শোভাযাত্রা : নয়া দিগন্ত -


ফাঁকা রাজধানীতে এবার অনেকটা নিরুত্তাপ বর্ষবরণ হয়েছে। পয়লা বৈশাখ ঘিরে অন্যান্য বছর রাজধানীজুড়ে প্রাণচাঞ্চল্য থাকলেও এবার তা ছিল না। মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, গান, আবৃত্তিসহ সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন থাকলেও মানুষের উপস্থিতি ছিল একেবারেই হাতে গোনা। এ ছাড়া অন্যান্য বছর ইলিশ পান্তা ভাতের আয়োজন থাকলেও এবার তাও ছিল অনুপস্থিত। এমনকি রমনা বটমূল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শোভাযাত্রায়ও লোক সমাগম ছিল তুলনামূলক কম।

উৎসবমুখর ছিল না রমনা বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো। আগতরা বলছেন, মানুষ ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার রাজধানী ছিল ফাঁকা। আর যারা রাজধানীতে ছিলেন তারাও অতিরিক্ত গরমের কারণে বাসা থেকে বাইরে বের হননি। ফলে বৈশাখের প্রথম দিনে ঢাকা ছিল অনেকটা নীরব ও ফাঁকা। যা আগে কখনো হয়নি।
এছাড়া বর্তমানে ইলিশের চড়া মূল্য। এক কেজি একটা ইলিশের দাম ২ হাজার থেকে-আড়াই হাজার টাকা। ফলে এটি এখন সাধারণ ক্রেতার সামর্থের বাইরে। ফলে বিক্রেতারা লোকসানের আশঙ্কায় এবার পান্তা ইলিশ আয়োজন করেননি।
অন্যান্য বছর পয়লা বৈশাখে মানুষের চাপ সামলাতে ফার্মগেট থেকে শাহবাগ যেতে বাংলামোটর এলাকায় ডাইভারশন ছিল। এবারো একই জায়গায় ডাইভারশন দিয়ে যানবাহন বিকল্প পথে পাঠিয়েছে পুলিশ। যদিও বাংলামোটর থেকে শাহবাগ বা শাহবাগ থেকে রমনা বটমূল সড়ক ছিল একেবারেই ফাঁকা।

এদিকে বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের এবারের শোভাযাত্রার স্লোগানটি কবি জীবনানন্দ দাশের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের ‘তিমিরহননের গান’ কবিতা থেকে নেয়া। অন্ধকার কাটিয়ে আলোর দিকে ধাবিত হওয়ার প্রত্যয়ে হলো ১৪৩১ সনের বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’।
সকাল সোয়া ৯টায় শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর শাহবাগের ঢাকা কাবের সামনে দিয়ে ঘুরে টিএসসি মোড় হয়ে ফের চারুকলার সামনে গিয়ে তা পৌনে ১০টার দিকে শেষ হয় শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীকী উপস্থাপনের নানা বিষয় স্থান পায়।

শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ এস এম মাকসুদ কামাল। এতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো: আতিকুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন। শোভাযাত্রা উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো ছিল পুরো এলাকা।
শোভাযাত্রায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানে সব কিছুই। উপস্থিতি কম হলেও ঢাক-ঢোলের বাদ্যের তালে তালে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য, হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দ উল্লাস মাতিয়ে রেখেছিল পুরো শোভাযাত্রা।
২০১৬ সালে জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে চালু হওয়া এ মঙ্গল শোভাযাত্রা।
শোভাযাত্রা উপলক্ষে সকাল থেকেই টিএসসি, দোয়েল চত্বর, শাহবাগ ও এর আশপাশের এলাকায় মানুষ জড়ো হতে থাকে। সকাল ৯টার মধ্যেই এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। লাল-সাদা পোশাকে উচ্ছল নারীদের মাথায় শোভা পায় নানান রঙের ফুলের টায়রা। তরুণদের পরনে ছিল লাল-সাদা পাঞ্জাবি।
শোভাযাত্রা ঘিরে ছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। পুলিশ, র‌্যাবের সাথে ছিল সোয়াত সদস্যরা। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ড্রোনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানস্থল পর্যবেক্ষণ করে।
এবারের শোভাযাত্রার শিল্প-কাঠামোগুলোর মধ্যে ছিল ময়ূর, হাতি, গন্ধগোকুল, টেপাপুতুল। এছাড়া ছিল পাখি, মাছ, রাজা-রানির মুখোশ। দুই পাখি ও কাঠঠোকরা। শোভাযাত্রায় আরো ছিল মা ও শিশু এবং বাঘের মুখোশ, টেপাপুতুল, রাজা-রানি, বাঘের মুখোশ।

পথিমধ্যে কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারেননি। কারণ চতুর্দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে মানবপ্রাচীর গঠন করা হয়। গতবারের মতো এবারো মুখোশ ব্যবহার ও ভুভুজেলা বাজানো নিষিদ্ধ ছিল শোভাযাত্রায়। নিরাপত্তার জন্য বন্ধ রাখা হয় রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা ও কেন্দ্রীয় রাস্তা।
এর আগে ভোরের আলো ফোটার মুহূর্ত থেকে রমনার বটমূলে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষের আসা শুরু হয়। ছায়ানটের উদ্যোগে সকাল সোয়া ৬টায় আহির ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে শুরু হয় বর্ষবরণের এবারের অনুষ্ঠান। নতুন বছরকে এক কণ্ঠে বরণ করে নেন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের শতাধিক শিল্পী। সেখানে জীর্ণতা ঘুচিয়ে নতুনের আহ্বানে নববর্ষকে স্বাগত জানান সর্বস্তরের মানুষ।
ছায়ানটের পুরো অনুষ্ঠান সাজানো হয় নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম-দেশপ্রেম আর আত্মবোধন-জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। এবারের আয়োজনে ছিল ১১টি সম্মেলক গান, ১৫টি একক গান, পাশাপাশি পাঠ ও আবৃত্তি।

চট্টগ্রামে নানা আয়োজনে বাংলা বর্ষবরণ
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বর্ণিল নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষকে বরণ করেছে চট্টগ্রামবাসী। আনন্দঘন উৎসবের রঙে রঙিন হয়েছে পুরো চট্টগ্রাম।
নগরীর ডিসি হিল, সিআরবি শিরিষতলা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ও জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ নগরীর বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে বাংলা নববর্ষ বরণে আয়োজন করা হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতার। সুর্যদয়ের সাথে সাথে ডিসি হিল নজরুল স্কয়ারে শুরু হয় পয়লা বৈশাখের মূল আয়োজন। বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা একক ও দলীয় পরিবেশনার মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। একই সময় সিআরবি শিরিষতলায়ও শুরু হয় নববর্ষের আনুষ্ঠানিকতা। শিরিষতলায় সংগীত ভবন, সুরাঙ্গন বিদ্যাপীঠ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, অদিতি সংগীত নিকেতন, সৃজামি, রাগেশ্রীসহ বিভিন্ন সংগঠন সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিবেশনায় অংশ নেয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
এছাড়া চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নিয়েছেন।
সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ চট্টগ্রামের আহ্বায়ক আহমেদ ইকবাল হায়দার জানান, এবারের বৈশাখের আনুষ্ঠানিকতায় চট্টগ্রামের ৩২টি সাংস্কৃতিক সংগঠন অংশ নিয়েছে।

উৎসবে মেতেছিল বরিশালবাসী
বরিশাল ব্যুরো জানায়, প্রভাতী অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি, মঙ্গল গীত ও নৃত্য পরিবেশন আর ঢাকের তালে তালে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে বাংলার নতুন বর্ষকে বরণ করতে উৎসবে মেতেছিল বরিশালবাসী। রোববার সকাল সাড়ে ৬টায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বরিশাল জেলা সংসদের আয়োজনে নগরীর ব্রজমোহন (বিএম) স্কুল প্রাঙ্গণে প্রভাতি অনুষ্ঠান শুরু হয়। এতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করার পাশাপাশি, বাংলা দেশাত্মবোধক গান, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশন করে শিল্পীরা। প্রভাতি অনুষ্ঠান শেষে ও গুণীজন সন্মাননা প্রদান করা হয়। পরে চারুকলা বরিশালের উদ্যোগে ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাখি পড়িয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় সকাল সাড়ে ৮টায়। যা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে অশ্বিনী কুমার হল প্রাঙ্গণে শেষ হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রায় চারুকলার বিভিন্ন ধরনের মুকুট, মুখোশ, পাখা, পালকী, ঘোড়া, হাতিসহ বিভিন্ন লোকজ উপকরণ শোভা পেয়েছে। এছাড়া উদীচী বরিশালের উদ্যোগে ব্রজমোহন স্কুল মাঠে ৩ বৈশাখ পর্যন্ত চলবে মেলা।
এদিকে বাংলা বর্ষষবরণ উপলক্ষে শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার শহীদ মিনারে তিন দিনের বৈশাখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, সেই সাথে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বরিশাল সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গণ থেকে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এসব আয়োজনে নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ।


আরো সংবাদ



premium cement