৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ হতে পারে ভয়ঙ্কর

-

চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়তে পারে। তা হতে পারে ভয়ঙ্কর। গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এই বছরের প্রথম তিন মানে ডেঙ্গুতে মৃত্যু দ্বিগুণেরও বেশি। গবেষণায় ঢাকাসহ ৯টি জেলায় ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার উচ্চঘনত্ব দেখা গেছে। আর ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, এই বছর ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, গাজীপুর, বরিশাল, বরগুনা ও মাদারীপুরে ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের চেয়েও বাড়বে। এই অধ্যাপক বলেন, মার্চ মাসে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে দেখা গেছে, এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি ওই জেলাগুলোতে আরো খারাপ হবে। আমরা ডেঙ্গু মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ডেঙ্গু রোগী এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেই। তাতে দেখা গেছে, এবার ওই জেলাগুলোতে শীতকালেও এডিস মশার ঘনত্ব ১০-এর উপরে ছিল। এটা মার্চ মাসের হিসাব। বৃষ্টি হলে এটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এবার আগাম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ধারণা করি এখন এডিস মশার ঘনত্ব দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর যদি রোগীর সংখ্যা বিবেচনা করি, ২০২৩ সালের তুলনায় এ বছরের মার্চ মাসে দ্বিগুণেরও বেশি ছিল। ফলে আমরা যে তথ্য-উপাত্ত পাচ্ছি তাতে ডেঙ্গু এবার অনেক প্রকট হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছর প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ৯ জনের। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২২ জন, যা গত বছরের একই সময়ে দ্বিগুণের বেশি। এ বছর একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। গত বছর প্রথম তিন মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ৮৪৩ জন। এবার প্রথম তিন মাসেই ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৭০৫ জন।

২০২৩ সালে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় এক হাজার ৭০৫ জন। গত বছর জুলাই-আগস্টের দিকে হঠাৎ ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় কোথাও কোথাও স্যালাইন সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। তখন স্যালাইনের দামও বেড়ে যায়। চলতি বছর সেরকম পরিস্থিতি যাতে না হয় সে জন্য গত ৩১ মার্চ বৈঠক করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, কৃত্রিম সঙ্কট মোকাবেলা করতে চাহিদার চেয়ে বেশি স্যালাইন উৎপাদন হওয়া প্রয়োজন। এ কারণে উৎপাদন বাড়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া সব হাসপাতালে এখন থেকে স্যালাইন কিনে মজুদ করে রাখতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ) চিকিৎসার জন্য প্ল্যাজমা ও রক্তক্ষরণ প্রতিরোধী ওষুধ আমদানি করা যায় কি না, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মার্চ থেকে অক্টোবরকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়। এ সময়ে সারা দেশে প্রতি মাসে স্যালাইনের চাহিদা থাকে প্রায় ৫০ লাখ লিটার। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ কম থাকে। ওই সময়ে এ ধরনের স্যালাইনের মাসিক চাহিদা থাকে প্রায় ৩০ লাখ লিটার।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: লেনিন চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের চিকিৎসকরা এখন যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছেন। হাসপাতালগুলোতেও ব্যবস্থাপনা এখন ভালো। তার পরও প্রস্তুতি প্রয়োজন। জেলা, উপজেলার সব হাসপাতালেরই আগাম প্রস্তুতি দরকার। সেই সাথে দরকার মানুষকে সচেতন করা। তবে সমস্যা হলো আগেই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করে ডেঙ্গু রোগ যাতে না হয় তার ব্যবস্থা তেমন নেয়া হচ্ছে না। আর এখন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে না গিয়ে অপেক্ষা করেন। রোগীর অবস্থা জটিল হলে হাসপাতালে যায়। ফলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাড়ছে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। এটা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এডিস মশার একটি ধরন হলো শহুরে এডিস। কিন্তু ২০১৯ সালের পর আমরা আরেকটি প্রজাতির এডিস মশা দেখতে পাচ্ছি যেটি বুনো এডিস। এটা বনে বাদাড়ে, গাছের কোটরে থাকে। ফলে এখন গ্রামেও ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এখন দেশের মানুষ ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে জানে। এডিস মশা চেনে। এই মশা প্রতিরোধে কী করতে হয় তাও জানে। জানার পরও তারা বাড়িঘর পরিষ্কার করেন না। স্বচ্ছ পানি জমতে দেন। আর এই পানিতেই এডিস মশা জন্মায়। আর সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেই।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনই প্রতি বছর মশা মারতে তাদের বাজেট বাড়ছে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ঢাকার দুই সিটির চলতি অর্থবছরে মশা মারার বাজেট ১৫২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে উত্তরের ১২১ কোটি ৮৪ লাখ আর দক্ষিণের ৩১ কোটি এক লাখ টাকা। আর গত ১২ বছরে ঢাকার মশা মারার আয়োজনে খরচ হয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই বাজেটের টাকা মশা নিবারণের নানা যন্ত্রপাতি, কীটনাশকসহ আরো অনেক কাজে ব্যয় হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১০টি অঞ্চলে ৭৫টি ওয়ার্ডে মশা নিধনে ১৫০ জন মশক সুপারভাইজারসহ এক হাজার ৫০ জন কাজ করছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি অঞ্চলে মোট ৫৪টি ওয়ার্ডের ৭৫ জন মশক সুপারভাইজারসহ প্রায় ৬০০ জন কাজ করছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা: ফজলে শামসুল কবির বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় এখন ডেঙ্গু রোগী তেমন নেই। হাতেগোনা কয়েকজন পাওয়া গেছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন নিয়মিত মশা নিধনের কাজ চলছে। ঈদের পর আমরা আরো বড় পরিসরে কাজ শুরু করব। সরকারের বিভিন্ন দফতরের সমন্বয়ে কাজ করা হবে। সবাইকে চিঠি দেয়া হবে। সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হবে। তার কথায়, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু আমরা নয়, সবাইকে কাজ করতে হবে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে তো আর মশা নিধন করতে পারব না। তাই এবার আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব। কোনো বাড়ি বা স্থাপনায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে।

এ দিকে, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, মশা নিধনে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এটা আরো জোরদার করা হচ্ছে। তবে বাসাবাড়ির জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্মায়। তাই বাসাবাড়ির ছাদ, বারান্দা, বাথরুম এগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য উত্তর সিটি করপোরেশন এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস ছাড়াও পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি নগরবাসীর কাছ থেকে নগদ মূল্যে সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে মেয়র জানিয়েছেন, যাতে ওই সবের ভেতর পানি জমতে না পারে। পরিবেশও রক্ষা পায়। আর মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করা হবে। ঈদের পর থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলররা জনগণকে সচেতন করতে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে বলেও মেয়র জানিয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement