২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুইপার থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা

অবশেষে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে রংপুর স্বাস্থ্য বিভাগের সেই ফজলু

-


অবশেষে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে সুইপার থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রংপুর বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়া মো: ফজলুল হককে। দুর্নীতির মামলায় তাকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান। এ ঘটনায় তাকে ঘিরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য বিভাগে তৈরি হওয়া আধিপত্যবাদী সিন্ডিকেট ও বলয়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে ছোটাছুটি।
দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের আইনজীবী মো: রফিকুল ইসলাম জুয়েল জানান, রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দফতরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে দুই কোটি ৪০ লাখ ১৩ হাজার ২৯৪ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তার সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ জারি করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। ২০১৯ সালের ৩০ জুন তার নামীয় সম্পদ বিবরণী দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল করা হয়। পরবর্তীতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো: আতাউর রহমান সরকার বাদি হয়ে সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইন’২০০৪ এর ২৭(১) ধারার অভিযোগ আনা হয়।

অঢেল সম্পদের নেপথ্যে : স্বাস্থ্য বিভাগ এবং দুদকের তদন্ত সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯৭ সালে এমএলএসএস সুইপার পদে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে যোগদান করেন রংপুর মহানগরীর বানিয়াপাড়া এলাকার ফজলুল হক। পরে অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক, স্টোর কিপার হন, হেলথ ক্লাব এবং পরে চাকরিনীতিমালা ভেঙ্গে সচিব (চলতি দায়িত্ব) এবং পরে রংপুর বিভাগীয় পরিচালকের দফতরের (স্বাস্থ্য) প্রশাসনিক কর্মকর্তা হন। তদন্ত সূত্রগুলো জানায়, এই সময়ে মধ্যে ফজলুল হক স্বাস্থ্য বিভাগের ঠিকাদার মহি মিঠুর সান্নিধ্যে আসেন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল এবং বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতরগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। নিয়োগ, ঠিকাদারি বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন কমিশন বাণিজ্যে মেতে উঠেন। বানাতে থাকেন নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তার নেতৃত্বে তৈরি হয় ঠিকাদারসহ একটি শক্ত বলয়। অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে ফজলু ও তার সিন্ডিকেট। ফজলুর অঙ্গুলি হেলনের বাইরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যবিভাগের কোনো নিয়োগ, বদলি, কিংবা ঠিকাদারির সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। দুদকের অনুসন্ধান তথ্যসূত্র জানিয়েছে, গড়ে উঠতে থাকে ফজলুর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ।
সূত্র জানায়, দুদক ফজলুল হকের দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী অনুসন্ধানকালে দেখতে পায় রংপুর নগরীর কলেজ পাড়ায় মেয়ের নামে ৬ তলা বিশিষ্ট ৪০০ বেডের ফারজানা ছাত্রী হোস্টেল, নগরীর দেওডোবা বানিয়াপাড়ায় বহুতল বাড়ি, একই মৌজায় তিন একর জায়গাজুড়ে ছোট পুুত্রের নামে দেড় শ বেডের হোস্টেলসহ গড়ে তোলা বহুতল ভবনের ফাইয়াজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও যানবাহন, আরেক পুত্রের নামে আইটি সেন্টার, চাঁদের বাজার এলাকায় দুই শতাধিকের বেশি বিদেশী গরুর খামার, দেওডোবা বানিয়াপাড়া, মলাখাওয়ার পাথার, আলমনগর, দর্শনা, ফতেহপুর ও পাইকারপাড়া এলাকায় প্রায় চার একর জমি, কুড়িগ্রাম জেলার কাশিপুর ইউনিয়নে জমি, ঢাকায় বহুতল ফ্লাটসহ স্থাবর সম্পদ এবং আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। তার দুই ছেলেমেয়ে লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে বেসরকারি প্রাইম মেডিক্যাল কলেজে লেখাপড়া করে। এ ছাড়াও ফজলুল হক ও তার পরিবারের যাতায়াত করার জন্য দুটি কারসহ বিভিন্ন সম্পদের তথ্য পায় দুদক। কিন্তু এসব সম্পদ অর্জনের সপক্ষে আয়ের বৈধ কোনো উৎস সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে দেখাতে পারেননি মো: ফজলুল হক। এ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে তার স্ত্রীসহ নিজের নামে ও বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের তথ্য আসে দুদকের হাতে। শুধু তাই নয়, রংপুর মেডিক্যাল কলেজে সচিব পদে (চলতি দায়িত্ব) কর্মরত থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দাপট দেখিয়ে বিধি বহির্ভূতভাবে ছয় বছর ধরে কলেজের মাইক্রোবাস (রংপুর চ-০২-০০৪২) নিজে এবং পারিবারিকভাবে ব্যবহার করারও প্রমাণ পায় দুদুক।

যেভাবে সুইপার থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হলেন ফজলুল হক : স্বাস্থ্য বিভাগের ফজলুল হকের সার্ভিস বুক থেকে জানা যায়, ফজলুল হক ১৯৯৭ সালের ২৭ মে রংপুর মেডিক্যাল কলেজে এমএলএসএস কাম সুইপার (অফিস সহায়ক) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৪ সালের ১০ জুন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম কম্পিউটার অপারেটর হন। এরপর ২০০৯ সালের ১ নভেম্বর স্টোরকিপার, ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পান। কিন্তু নন-মেডিক্যাল কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী আর কোনো পদোন্নতির সুযোগ না থাকলেও ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর রংপুর মেডিক্যাল কলেজের সচিবের (চলতি দায়িত্ব) দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে রংপুরের বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয়ে তাকে বদলি করা হয়। এখনো তিনি ওই পদে আছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৮ সালের স্বাস্থ্য বিভাগীয় নন-মেডিক্যাল নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী ১০ম গ্রেডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতির জন্য ১১তম গ্রেডের যোগ্য ফিডার কর্মচারীদের যে তালিকা করা হয়েছিল সেখানে ফজলুল হকের পদোন্নতি বিধি বহির্ভূত বলে মন্তব্য করা হয়েছে। একই সাথে তার ২০২০ সালের এসিআর না থাকার কথাও উল্লেখ করা হয়।
বিষয়গুলো নিয়ে নাগরিক সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু জানান, এটা আমাদের দেশের এবং প্রশাসনের জন্য লজ্জাকর যে একজন অফিস সহায়ক পদে চাকরি করে বিধি না মেনে একটি দফতরের বিভাগীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে গেলেন। অথচ প্রশাসনিকভাবে তার কিছুই হলো না। ফজলুল হক যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন দেরিতে হলেও দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তিনি কারাগারে গেছেন। এটা ভালো দিক। তার ব্যাপারে এমন দৃষ্টান্তমূলক আইনি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন, যাতে অন্য কোনো সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা এ ধরনের কাজ করতে না পারেন।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফজলুল হক গ্রেফতারের পর থেকেই তার সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী, ঠিকাদার, রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমকর্মীসহ, পেশিশক্তিসহ অন্যরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। যাদের সবাই তার মাধ্যমে আখের গুছিয়েছেন। তাদের অনেকেই নিজেদের কার্যকলাপ আড়াল করতে নানা ধরনের তদবিরও করছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।


আরো সংবাদ



premium cement