২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পানির দেশে পানির আকাল

ঘিওরে ধলেশ্বরী নদীর প্রশস্ততা কমে জীর্ণদশা : নয়া দিগন্ত -


নদী মাতৃক বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে নদীতে বছরজুড়েই পানির প্রভাব ছিল
বিস্তর। কিন্তু আজ যেন পানির দেশেই পানির জন্যই হাহাকার। মানিকগঞ্জে ছোট-বড় মিলিয়ে এক ডজনের মতো নদ-নদী ছিল। এসব নদীর দৈর্ঘ্য ২৪১ কিলোমিটার। পদ্মা ও যমুনার মতো বড় দু’টি নদী ছাড়াও এ জেলায় ছিল ইছামতী, কালীগঙ্গা, কান্তাবর্তী, মনলোকহানী, গাজীখালি, ক্ষীরাই মন্দা, ভুবনেশ্বর ও ধলেশ্বরীর মতো শাখা নদী। নদী শুকিয়ে গেছে। শুকনো মৌসুমে এখানে সর্বত্র পানিসঙ্কট বিরাজ করছে।
ড্রেজিং না করা, যাও যৎ সামান্য ড্রেজিং করা হয় তা অপরিকল্পিত ও দখলের কারণে ছয় নদী, ৪২টি খাল-বিল ও দুই শতাধিক ছোট জলাশয়ের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। একসময় যেখানে বছরজুড়ে পানি থাকত, শুকনো মওসুমে সেখানে এখন এক ফোঁটা পানিও মেলে না। নৌকার পরিবর্তে চলাচল করে ঘোড়ার গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন। এ যেন পানির দেশে পানির জন্য হাহাকার।
‘জল ও জীবিকা, জলের অপচয় রোধ, পানির উৎসকে বাঁচিয়ে রাখা’ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে মানিকগঞ্জ নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি এবং বারসিকের সহযোগিতায় আলোচনা ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন ধলেশ^রী নদী বাঁচাও আন্দোলন

কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস। বক্তব্য রাখেন, সমাজকর্মী অ্যাডভোকেট দীপক কুমার ঘোষ, সুজনের সভাপতি ইকবাল হোসেন কচি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার শহীদুল ইসলাম ফারুক, বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায়, রাশেদা আক্তার, আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব আবদুল হামিদ চান্দু, সমাজকর্মী ইকবাল খান, সাংবাদিক আব্দুল মোমিন, সমাজকর্মী আবদুস সালাম।
সভায় বক্তারা বলেন, ‘পানি ছাড়া জীবন বাঁচে না আর পানি না থাকলে নদী বাঁচবে না। নদীতে এখন পানি নাই। নদীতে ধুলা উড়ে। আলোচনা সভা শেষে মানিকগঞ্জের সব নদী ও খালের নাব্য রক্ষায় নিয়মিত খনন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবর স্মারকলিপি জমা দেয়া হয়।
শিক্ষক মতিন দেওয়ান বলেন, পানিকেন্দ্রিক নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। কিন্তু সেই ঐতিহ্য, জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, কৃষি, অর্থনীতি ক্রমেই হয়ে আসছে সঙ্কুচিত।
মানিকগঞ্জ সীমানায় এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। ধলেশ্বরী-কালীগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। নতুন প্রজন্মের কাছে ধলেশ্বরী আর কালীগঙ্গা নদী আজ কেবল কাগজেকলমে রয়েছে। বাস্তবে এই নদীর চিত্র এতটাই করুণ যে, বুঝার উপায় নেই যে, নদীর বুকে চর নাকি চরের বুকে নদী?


পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা দেশের প্রধান দুই নদী পদ্মা ও যমুনা ছাড়াও ধলেশ্বরী, পুরনো ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, ইছামতি নদী রয়েছে। ১৩৭৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মানিকগঞ্জে এসব নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪১ কিলোমিটার। কিন্তু নাব্য হারানো এসব নদীর আকার-আয়তন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে নদীর গতিসীমা।
জানা যায়, নাগরপুরের যমুনা থেকে ধলেশ্বরীর উৎপত্তি। সেখান থেকে এই নদী মানিকগঞ্জের ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটি সিঙ্গাইর হয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। এই ৬০ কিলোমিটারের তিন-চতুর্থাংশই আছে শুধু নামে। বর্ষা ছাড়া নৌকা চলাচলের মতো পানিও থাকে না। ধলেশ্বরীর শাখা কান্তাবতী, মনলোকহানী, ক্ষীরাই, মন্দা ও ভুবনেশ্বরের এখন আর অস্তিত্ব নেই। নতুন প্রজন্ম এসব নদীর নাম বই-পুস্তক আর প্রবীণদের মুখে শুনেছে মাত্র, দেখার ভাগ্য হয়নি। ২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পুরনো ধলেশ্বরী নদী দৌলতপুর উপজেলার মূল যমুনা থেকে শুরু হয়ে ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় এসে শেষ হয়।


ধলেশ্বরীর আরেকটি শাখা নদী গাজীখালি একসময় স্রোতস্বিনী থাকলেও বর্তমানে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর হয়ে গাজীখালি নদী সাভারের বংশী নদীতে পতিত হয়েছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এ নদী বছরের ৮-৯ মাসই পানিশূন্য থাকে। সেই সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে নদীটির বিশাল এলাকা। দখলকৃত জায়গায় কেউ বাড়িঘড় নির্মাণ করে আছে, কোথাও আবার দোকানপাট, শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে, কেউ নিয়মিত চাষাবাদ করে নদীর অবশিষ্ট চিহ্নটুকু মুছে ফেলছে।
দৌলতপুরের কাছে যমুনা থেকে কালীগঙ্গা নদী উৎপন্ন হয়ে জাবরা কোল ঘেঁষে সিঙ্গাইরের ধল্লা পর্যন্ত এ নদীটির বিস্তৃৃতি। এর দৈর্ঘ্য ৪৫ কিলোমিটারের বেশি। বর্তমানে এই নদীর অধিকাংশ স্থানে শুকনো মওসুমে নৌকা চলার মতো পানিও থাকে না। কোথাও কোথাও একেবারেই শুকিয়ে গেছে। চলছে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ।


পদ্মার শাখা ইছামতী হরিরামপুর উপজেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ফের পদ্মায় মিশেছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯০ কিলোমিটার। বর্তমানে এটি মৃতপ্রায়। কেবল বর্ষা মওসুমে একটা সরু ধারা প্রবাহিত হয়।
নদী ও খাল-বিলে পানি নেই বলে জেলেরা বদল করেছেন পেশা। যাদের মূল পেশাই ছিল নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা। জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ অঞ্চলের বেশির ভাগ গরিব চাষি আগে নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতেন। নদীগুলো মরে যাওয়ায় এখন মারাত্মক সেচ সঙ্কটে পড়েছেন কৃষকরা।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মাঈন উদ্দিন জানান, নদী খনন ও পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। এ ছাড়া আরো খননের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড বরাবর প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement