০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


এক দীঘিতেই ব্যয় ১৪ কোটি টাকা

একই প্রকল্পে অসম ব্যয়; ২০টিতে গড় ব্যয় ১.৬৫ কোটি টাকা
-

নদী, পুকুর, খাল ও দীঘি খনন খরচে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে এই খননকাজের খরচ এত বেশি আকারে লম্ফ দেয়, যা অবাক করার মতো। ২০১৯ সালে নেয়া চলমান পুকুর ও দীঘি খনন প্রকল্পে প্রতিটি পুকুর খননে খরচ ৬০ লাখ ১২ হাজার টাকা। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ২১টি দীঘি খনন প্রকল্পে ২০টির জন্য গড়ে ব্যয় ১.৬৫ কোটি টাকা এবং শুধু একটির জন্য ১৩ কোটি ৮১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা প্রস্তাব নিয়ে হতবাক পরিকল্পনা কমিশন। একই প্রকল্পে দীঘি খনন খরচে এত আকাশপাতাল ব্যবধান কেন?
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব দীর্ঘকালের। এ ছাড়াও ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডর, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা, ২০১৩ সালের ঘূর্ণিঝড় মহাসেন, ২০১৯ সালের ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুল এবং ২০২০ সালের সুপার সাইক্লোন আমফানে উপকূলীয় সুপেয় পানির উৎসগুলো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি মহাসঙ্কটে রূপ নেয়। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় নদ-নদীতে লবণাক্ততার পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বাঁধ কেটে লবণপানি প্রবেশ, অনিয়ন্ত্রিত চিংড়ি চাষ, নদী প্রবাহে বাধা, নদী-খাল দখলসহ নানাবিধ কারণে যুগ যুগ ধরে সুপেয় পানির সঙ্কট অব্যাহত রয়েছে। তাই পুকুর ও দীঘি খনন করে ভূ-উপরস্থ পানি সংরক্ষণ করা আবশ্যক। সরকারি ও খাস জমিতে পুকুর বা দীঘি খনন করা যেতে পারে, যেগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা যাবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে উপকূলীয় অঞ্চলের সুপেয় পানির সঙ্কট মেটানো সম্ভব।
প্রস্তাবে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় পানির বিশালতা থাকলেও মিঠা পানির উৎস এবং প্রাপ্যতার ভিত্তিতে সঙ্কট সব সময়ই ছিল। আর খুলনা জেলার দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, তালা ও আশাশুনি উপজেলা এবং বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলাগুলো সুন্দরবন এবং সমুদ্রসংলগ্ন হওয়ায় মিঠা পানির সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। অধিকাংশ স্থানেই ভূ-গর্ভে খাওয়ার যোগ্য পানির স্তর না পাওয়ায় গভীর নলকূপ চালু করা যায় না। অগভীর নলকূপের পানিতে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা ও আর্সেনিক দূষণ। এলাকার মানুষের পানির চাহিদা পূরণের জন্য পুকুর ও রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট হচ্ছে ভরসা। বৃষ্টির পানি ধারণ করে তা এই প্ল্যান্টের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। আবার অপরিকল্পিত চিংড়ির চাষ ও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে স্থানীয় পুকুরগুলোর অধিকাংশই মিঠা পানির আধার হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কিছু কিছু এলাকায় রেইনওয়াটার হারভেস্টিং প্ল্যান্ট থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এই এলাকার অর্ধেক জনগোষ্ঠী বৃষ্টির পানি ও পুকুরের পানি ফিল্টার করে পান করে। বাকি অর্ধেক পুকুরের পানি পান করে ফিল্টার ছাড়াই। ফলে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সঙ্কট চলছেই। দীঘি খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সুপেয় পানির সঙ্কট মেটানো সম্ভব।
ডিপিপি অনুযায়ী, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় এলাকায় ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য দীঘি খনন’ প্রকল্পে এমন ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। ৪৬ কোটি ১৩ লাখ ১১ হাজার টাকা। প্রায় তিন বছরে প্রকল্পটি সম্পন্ন করার কথা। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে।
ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় ২১টি (ছয় লাখ ৫৫ হাজার ৯৯৭ ঘনমিটার) দীঘি খনন বাবদ মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৫ কোটি ৮০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে গড়ে প্রতিটির ব্যয় পড়বে দুই কোটি ১৮ লাখ ১৩ হাজার টাকা। তবে এখানে পৃথকভাবে খনন করাতে সাতটির জন্য ১২ কোটি এক লাখ টাকা। ফলে এতে খরচ গড়ে এক কোটি ৭১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। আর ১৩টির জন্য খরচ ১৯ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার টাকা। এখানে প্রতিটিতে ব্যয় এক কোটি ৫৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর বাকি একটির জন্যই ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। গড়ে প্রতি ঘনমিটার খননে খরচ ধরা হয়েছে ৬৯৮ টাকা ৩০ পয়সা।
২০১৯ সালের আগস্টে অনুমোদিত চলমান প্রকল্পের সাথে বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪৩টি উপজেলায় ৭১৫টি পুকুর ও ১০টি দীঘি পুনঃখনন হয়। সেখানে ১০টি দীঘি খননে ব্যয় ছয় কোটি দুই লাখ টাকা এবং গড়ে ৬০ লাখ ১২ হাজার টাকা। আর ৭১৫টি পুকুর খননে ৮০ কোটি আট লাখ টাকা। এখানে প্রতিটিতে ব্যয় ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখানে দু’টিতে ব্যবধান আকাশপাতাল।
এক সরকারি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগকে পুকুর ও খাল নিয়ে জরিপ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর এলজিইডির পক্ষ থেকে সরেজমিন গিয়ে খাল ও পুকুর যাচাই-বাছাই করে জেলাভিত্তিক তালিকা করা হয়। সারা দেশে মোট ১৪ হাজার ৯১০টি খাস পুকুর, দীঘি, তিন হাজার ৪৯৩টি প্রাতিষ্ঠানিক এবং ছয় হাজার ৫৩৬টি খাস খাল রয়েছে। এসব পুকুর ও খাল পুনঃখননের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ করে সেচসুবিধা সম্প্রসারণসহ বহুমুখী কাজে পকুর ও দীঘির পানি ব্যবহার করা হবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত কম। সেচকাজে মূলত ভূগর্ভের পানি ব্যবহৃত হয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, উন্নয়নের নামে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। আর এ কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েই চলছে। তিনি বলেন, সরকার যদি এ দিকে নজর না দেয় তাহলে জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এসবসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এর মাধ্যমে লুটপাট ও দুর্নীতি হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৪৬ কোটি ১৩ লাখ ১১ হাজার টাকা; কিন্তু ডিপিপির বিভিন্ন অঙ্গের যোগফল মোট ৪৬ কোটি ৮৮ লাখ ১১ হাজার টাকা হয়, যা প্রস্তাবিত ব্যয় অপেক্ষা ৭৫ লাখ টাকা বেশি। এ বিষয়ে পিইসি সভায় আলোচনা ও প্রশ্ন তোলা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মো: মামুন আল রশীদ বলেন, দীঘির আকার ভেদে খরচের ব্যবধান হতে পারে। সেখানে দীঘির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা দেখতে হবে। কত ঘনমিটার খনন করা হবে সেটি এবং বর্তমান কাজের দর কত সেটিও একটা বিষয়। তিনি বলেন, রেট শিডিউলের সাথে তাদের খরচের প্রস্তাবের মিল আছে কি না সেটি অবশ্যই পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় বিশ্লেষণ করা হবে।


আরো সংবাদ



premium cement