২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঋণখেলাপি আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা

অবলোপনকৃত ঋণের সুদ মওকুফে ছাড়
-

ঋণপুনর্গঠন, নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট, অবলোপনকৃত ঋণের সুদ মওকুফে ছাড়সহ নানা নামে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ না করে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন। অপর দিকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে নানা ঝুঁকি মোকাবেলা করে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করছেন অন্য গ্রাহকরা। একশ্রেণীর গ্রাহককে বছরের পর বছর ছাড় দেয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তাদের মধ্যেও ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মধ্যে এতে করে ব্যাংকে নতুন নতুন ঋণখেলাপি বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ গতকাল বুধবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, একশ্রেণীর ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপি নানা কৌশলে ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান নীতি শিথিলতার মাধ্যমে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। তিনি মনে করেন, এ ধরনের ঋণখেলাপিদের বেশির ভাগই ইচ্ছেকৃত খেলাপি। সর্বশেষ অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণেও সুদ মওকুফে ছাড় দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কোনো প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন সিদ্ধান্ত নিলো তা বোধগম্য নয়। তিনি মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে ছাড় দেয়া উচিত নয়। সর্বশেষ ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে যে ছাড় দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি করা উচিত। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়সীমা বেঁধে দেয়া দরকার। ছাড় দেয়ার ফলে বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে কী পরিমাণ আদায় হয়েছে, ব্যাংকগুলো আদৌ আদায় করতে পারল কি না তা যাচাই-বাছাই করা উচিত। তেমন কোনো সাড়া না পাওয়া গেলে সুদ মওকুফের শিথিলতা তুলে দেয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর মনে করেন, এভাবে ঢালাওভাবে ছাড় দেয়া হলে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন তাদের মধ্যেও ঋণ ফেরত না দেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাবে। এটা ব্যাংকিং খাতে নতুন নতুন ঋণখেলাপি সৃষ্টি উৎসাহিত করবে বলে তিনি মনে করেন।
জানা গেছে, গত ২০১৫ সালে ঋণপুনর্গঠনের নামে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়। ৫০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকার ওপরে ঋণখেলাপিদের মাত্র ২ ও ১ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। এ সুযোগ নিয়ে ১০টি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করে। কিন্তু এই ঋণের বেশির ভাগই আদায় হয়নি। এখন সুদাসলে মিলে এ ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
এর পরেই মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট এবং সুদের হারে বিশেষ ছাড় নিয়ে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ দীর্ঘ ১০ বছরের জন্য নিয়মিত করে নেয় ব্যবসায়ীরা। এ সুযোগের আওতায় বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ নবায়ন হয়ে যায়। কিন্তু যেসব ঋণ নবায়ন করা হয়েছে তার বেশির ভাগই কিস্তি পরিশোধ হচ্ছে না।
করোনার দুই বছরে ব্যাংকের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের জন্য সোনালি সময়। কোনো ফাঁকফোকর আর খুঁজতে হয়নি। কোনো রকম ঋণ পরিশোধ না করেই দিব্যি দুই বছর পার করে দেন ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা। এ দুই বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি শিথিলতার কারণে কোনো ঋণ পরিশোধ না করেই খেলাপির বদনাম মুক্ত থাকেন ওইসব ঋণ খেলাপি।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে চলতি বছরের শুরু থেকে। এর ফলে ঋণ আদায় না করেও খেলাপি থেকে মুক্ত থাকার শিথিলতা কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি জানুয়ারি থেকে তুলে নিয়েছে। এখন ঋণ পরিশোধ না করলেই খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন ওইসব খেলাপি। তবে অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের সুদ মওকুফে বিশেষ ছাড় নিয়ে বের হওয়ার কৌশল অবলম্বন করছেন একশ্রেণীর খেলাপি। আর এই অবস্থায় সুদ মওকুফে বিশেষ ছাড় দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত মঙ্গলবার সার্কুলার জারি করে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়, এটা আগের সার্কুলারের স্পষ্টকরণী।
জানা গেছে, আগে কোনো খেলাপি ঋণ অবলোপন করতে হলে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হতো। এ পাঁচ বছর ব্যাংকগুলো খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে বিশেষ জোর দিত। কিন্তু ঋণ অবলোপন করার সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছরে নামিয়ে আনা হয়। কেন এমন করা হলো, এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, দ্রুত খেলাপি ঋণ অবলোপন হয়ে গেলে ব্যাংকের নিয়মিত খেলাপি ঋণের হিসাব থেকে যেমন আলাদা হয়ে যায়, তেমনি নিয়মিত খেলাপি ঋণ থেকে আলাদা হিসাবে রাখায় ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাংকের এক ধরনের শিথিলতা চলে আসে। গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, কিন্তু সে মামলা বছরের পর বছর ঝুলতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিয়মিত খেলাপি ঋণের পাশাপাশি আরো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন হিসাবে আছে।
এ অবলোপনকৃত ঋণের সুদ মওকুফে এখন বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক জারিকৃত সার্কুলারে বলা হয়, অবলোপন করা ঋণের সুদও মওকুফ করা যাবে। সুদ মওকুফের শর্ত শিথিলের ফলে এখন থেকে অবলোপনকৃত ঋণের আসল পরিশোধ করে ঋণের সব সুদ মওকুফ পাবেন ঋণগ্রহীতারা। তবে কোনো ব্যাংক জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্ট ঋণ ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের সুদ মওকুফ করতে পারবে না। পাশাপাশি তিন বছর ধরে বন্ধ প্রকল্প, ঋণের জামানত ও প্রকল্পের সম্পত্তি বা প্রকল্প উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রয়ের পরও তহবিল ব্যয় মেটানো সম্ভব না হলে এবং পাওনা আদায়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পরও পাওনা আদায় সম্ভব না হলে তহবিল ব্যয় আদায়ে শর্ত শিথিল করা যেতে পারে। এছাড়া ঋণগ্রহীতার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, মড়ক, নদীভাঙন বা দুর্দশাজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতা যৌক্তিক কারণে ঋণ পরিশোধে অপারগ হলে সেই নির্দিষ্ট বছরের ৩১ ডিসেম্বরভিত্তিক তহবিল ব্যয় আদায়যোগ্য হবে না। কিন্তু তহবিল ব্যয় আদায়ের শর্ত শিথিল করার যৌক্তিকতা প্রমাণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগের মতামত নিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement