২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে বছর, সামনে ওমিক্রন

-

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আতঙ্কের মধ্যে বছরটি কেটেছে, সামনে রয়েছে ওমিক্রন। বাংলাদেশে অল্প কয়েকটি ওমিক্রনের রোগী শনাক্ত হলেও ইউরোপ ও আমেরিকায় ডেল্টার পাশাপাশি ওমিক্রনের মহামারী দেখা দিয়েছে। বিমান যোগযোগ যেহেতু বন্ধ হয়নি। সে কারণে যেকোনো সময় বাংলাদেশেও ওমিক্রনের মহামারী দেখা দিতে পারে। ফলে সামনের নতুন বছরটিও কাটতে পারে করোনাভাইরাসের ডেল্টা ও ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের আতঙ্কের মধ্যেই। করোনার কারণেই গেল বছরটিতে স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ‘নেই আর নেই’ শুনতে হয়েছে জনগণকে। স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতটির অন্যতম স্বাস্থ্য খাত। গেল বছরটিতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। মহামারীর ওই বছরটি ছিল আতঙ্কের ও উদ্বেগের। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি ছিল আলোচিত বিষয়। সংক্রমণের দ্বিতীয় বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর এই সাত মাস বাংলাদেশের জন্য ছিল খুবই বেদনাদায়ক।
স্বাস্থ্য খাত ছিল বেহাল দশায় : করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় বছরটিতেও সরকারের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। গেল বছরটিতেই সর্বোচ্চ সংখ্যক মারা যায় এবং আক্রান্ত হয়। মার্চের পর থেকে রূপান্তরিত ধরন ডেল্টা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল দশা প্রকটভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। দেখা যায়, সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুধু ‘নেই আর নেই’। করোনা আক্রান্ত রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজেনের। কারণ করোনা সংক্রমণ ঘটলে সব বয়সের মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মে অক্সিজেন নিতে পারে না মানুষ। ফলে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয় রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায়টিতে অক্সিজেনের ছিল চরম সঙ্কট। রোগীর আত্মীয়স্বজনকে দেখা দেছে, বাইরে থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। লকডাউনের সময় মানুষ মোটরসাইকেলে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যেত। অক্সিজেন ছাড়াও করোনা রোগীকে সেবা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স ছিল না। এমনকি ডাক্তার ও নার্সদের সুরক্ষার জন্য মানসম্মত পিপিই, মাস্ক ও গ্লোভসও ছিল না। পরের বছরও যে ভাইরাসটি আঘাত হানতে পারে এবং তা মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না। ফলে ২০২১ সালে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হলে দিশেহারা হয়ে পড়েন স্বাস্থ্যকর্মীরা। মার্চে ডেল্টার সংক্রমণ সামান্য থাকলেও মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ডেল্টার সর্বোচ্চ আঘাত। তবে একদিনে সর্বোচ্চ ২৮ জুলাই ১৬ হাজার ২৩০ জন করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। অপর দিকে ৫ ও ১০ আগস্ট এই দুই দিনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২৬৪ জন মারা গেছে করোনায়। আগে থেকে দেশীয় এবং বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যবিদেরা পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন যে, করোনাভাইরাসটি নির্মূল হবে না, তবে নিয়ন্ত্রণ হবে কিন্তু তা হতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এই পূর্বাভাস সত্ত্বেও করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যথেষ্ট জনবলের ব্যবস্থা করেনি সরকার। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই এর খেসারত দিতে হয়েছে ধন-সম্পদ হারিয়ে এবং জীবন দিয়ে। করোনা সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে গেলে দেখা গেছে, সিট নেই, খালি নেই। ঢাকার বাইরে থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকায় এলে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই বলে রোগীকে ফেরত দেয়া হয়েছে। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতেই রোগী মারা গেছে। এ দিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো বসেছিল টাকা কামানোর ধান্দায়। রোগীদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য ছিল তারা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অন্তত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি দেশের বাইরে থেকে মানুষ এলেও তাদের যথাযথ কোয়ারেন্টিনও করতে পারেনি সরকার। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিন থেকে করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিরা পালিয়ে গেছে। এসব কারণে গত বছরের মার্চের পর থেকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ দেখা গেছে দেশে।
টিকা ব্যবস্থাপনায় ছিল অদক্ষতা
এটা ঠিক বিশ্বে টিকা শুরুর একমাস পরই বাংলাদেশে করোনার টিকা চলে আসে। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় না এনে বেসরকারি বেক্সিমকো গ্রুপকে টিকা আনার দায়িত্ব দেয়া হলে দুই চালান (৭০ লাখ ডোজ) আনার পরই ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এপ্রিল মাসের দিকে বাংলাদেশে টিকা ব্যবস্থাপনায় ধস নামে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা সংগ্রহকারী সংস্থা কোভেক্স এগিয়ে আসে। দরিদ্র দেশ বলে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে প্রায় চার কোটি টিকা দেয়ার অঙ্গীকার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তা দিয়ে টিকাকরণ কর্মসূচি চালিয়ে নেয় সরকার। পরে এগিয়ে আসে চীন সিনোফার্মের টিকা নিয়ে। এভাবে সঙ্কটটা কাটিয়ে উঠতে পারে। এখনো যে হারে টিকা আসছে তাতে বড় ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়ে ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়ার মতো পরিস্থিতি সরকারের নেই।
এ দিকে বাংলাদেশেই টিকা তৈরির একটি চেষ্টা হয়েছে। ইনসেপ্টা ফার্মা সিনোফার্মের সাথে চুক্তি করে দেশেই টিকা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রক্রিয়াটিও চলছে ঢিমেতালে। ফলে বাংলাদেশের টিকা নির্ভরতা রয়েই গেছে। বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিপদটা এখানেই বলে বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। টিকাধারী ও টিকাবিহীন মানুষ একত্রে বসবাস করায় এখান থেকে টিকা প্রতিরোধী অন্য কোনো করোনার ধরন সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। সেজন্য খুব দ্রুততার সাথে জনগোষ্ঠীর সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার জন্য জনস্বাস্থ্যবিদরা বললেও এ ব্যাপারে সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে বলে তার আচরণে প্রকাশ পায়নি।
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ছিল আলোচিত ঘটনা
স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগে গত বছরটিতে ঘটেছে ঘুষবাণিজ্য, হয়েছে কেনাকাটায় দুর্নীতি। আর নানা ধরনের অনিয়মতো রয়েছেই। মহামারীর এই বছরটিতে স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতি অনেক বেড়েছে বলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি উল্লেখ করেছে। করোনাভাইরাস মহামারীকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে এক হাজার ৮০০ চাকরির নিয়োগ নিয়ে কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব, স্বাস্থ্যের ৩৫০ কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে। করোনাভাইরাস সঙ্কট শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার চিত্রটি প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির খবর যেন এই খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে। মাস্ক কেলেঙ্কারি, কোভিড টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি, জেকেজি আর রিজেন্ট হাসপাতালের মতো বড় আর আলোচিত ঘটনার পরও, গেল বছরটিতে স্বাস্থ্য খাতে শত শত কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তা এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত বা ব্যবস্থা নেয়ার কোনো তথ্য তাদের জানা নেই।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি মিলিয়ে দুর্নীতি বেশি হয়, এমন ১১টি খাত চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, করোনাভাইরাস সঙ্কটের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আস্থার সঙ্কটে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ স্বাস্থ্য খাতে অনেক পুরনো, ব্যবস্থা না নেয়ায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ ব্যাপারে বলছেন, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত, সেখানে দুর্নীতি বা অনিয়মের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এরকম ক্ষেত্রে খুব কমই আমরা কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাই। এই কারণে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে। আর এই মহামারীকে দুর্নীতির একটি মহোৎসবে পরিণত করা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement