২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাইরে স্কুলের সাইনবোর্ড ভেতরে তৈরি হচ্ছে নকল পণ্য

মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসছে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী
-

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে নকল প্রসাধনী ও কৌটা তৈরির কারখানা। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোড়কে এসব পণ্য উৎপাদন করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। স্কুলের সাইনবোর্ডের আড়ালে তৈরি হচ্ছে নকল পণ্যের কৌটা বা মোড়ক ছাড়াও বিদেশী কসমেটিকস। এ দিকে আরেক চক্র দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী দেশে এনে টেম্পারিং করে তারিখ পরিবর্তন করে বাজারে বিক্রয় করছে। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এসব পণ্য দেশের বাজারে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, ওই সব নকল পণ্য কারখানা থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেয় পুলিশ ও স্থানীয় কিছু অসাধু নেতা।
জানা গেছে, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের মধ্যে রয়েছে- বিশ্বমানের ব্র্যান্ড গার্নিয়ার, লরেল, রেভলন, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, লাক্স লোশন, অ্যাকুয়া মেরিন লোশন, পেনটিন, নিভিয়া, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান, সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, রয়েল, হ্যাভক ও কোবরা। অলিভ অয়েল কিওকারপিন, আমলা, আফটার সেভ লোশন, জনসন, ভ্যাসলিন হেয়ার টনিক, জিলেট ফোম, প্যানটিক প্রোভি ও হারবাল অ্যাসেনশিয়াল লোশন চাদা সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ইন্ডিয়ান ইউনিলিভারের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, ফগ স্প্রে ও ইতালিয়ান পণ্যের নামীদামি নেইল পলিশ, সেভিং ফোম, সেভিং লোশন ও ক্রিম, পারফিউম, টেলকম পাউডার, সুগন্ধি কেশ তেল, বিউটি ক্রিম, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার প্যারাসুট, কুমারিকা, ডাবর আমলা, কিউটসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল নারিকেল তেলসহ দেশী ও বিদেশী উভয় নকল পণ্য অবাধে বাজারে প্রবেশ করছে। এসব পণ্যের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন গলিঘুপচির কারখানাগুলোতে তৈর হচ্ছে। মৌলভীবাজারের মোতালেব মার্কেট, মরিয়ম প্লাজা, ১০ নম্বর গলি, পুরান চকবাজার, খান মার্কেট, মুনসুর খান মার্কেট, রহমান মার্কেটে এসব নকল পণ্য বেবিক্র হচ্ছে। বিদেশী পণ্যের পাশাপাশি এসব দোকানে দেশীয় অবৈধ কারখানায় তৈরিকৃত নিম্নমানের পণ্য প্রকাশ্যে বিক্র করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, রাজধানীর ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এলাকায় দুই শতাদিক ঘুপচি কারখানায় নকল প্রসাধনী পণ্য ও মোড়ক উৎপাদন করে চকবাজার, সোয়ারীঘাট, নবাব কাটারার পাইকারি মার্কেটগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বেশি মুনাফার কারণে এসব পণ্যে পাইকারদের কাছে চাহিদা বেশি। এসব নকল মোড়ক উৎপাদন হচ্ছে খোদ রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বিভিন্ন প্লাস্টিক কারখানায়। এসব কারখানার সামনে বিভিন্ন সাইনবোর্ড ও সামনে তালাবদ্ধ রেখে ভেতরে কারখানায় বিভিন্ন নামীদামি কোম্পানির জনপ্রিয় পণ্যের নকল কৌটা বা মোড়ক তৈরি হচ্ছে।
এসব মোড়ক তৈরির অন্যতম হচ্ছে ওই এলাকার আলীনগর চৌরাস্তার দক্ষিণ পাশে হুজুরপাড়া রোডের মিন্টু মিয়ার হাসান পলিমার কারখানায়। পণ্যের নকল বোতল ও কৌটা তৈরি করাই ওই কারখানার প্রধান ব্যবসা। ওই কারখানায় বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের হুবহু কৌটা তৈরি করা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, কারখানার প্রধান ফটকে ঢাকা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাইনবোর্ড রয়েছে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, কয়েকটি খারখানায় প্লাস্টিক দানা গলিয়ে বোতল, কৌটা ও কর্ক তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি একটি মেশনে ডাইস শিতলীকরণ করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ফজল হোসেন ফজর এ প্রতিবেদককে বলেন, করোনা আসার পর থেকে ব্যবসা একদম কমে গেছে। প্রতি বস্তা প্লাস্টিক দানার দাম চার হাজার টাকা। প্রতিদিন কারখানা চালাতে প্রচুর খরচ। সলিড পার্টির কাজ করলে বিলের টাকা ওঠাতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যায়। আর কপি মাল (বিখ্যাত পণ্যগুলোর হুবহু নকল মোড়ক) বানালে অগ্রিম টাকা পাওয়া যায়। এ জন্য বাধ্য হয়েই এসব পণ্য বানাচ্ছেন বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, শুধু আমরাই নই, কামরাঙ্গীরচরে প্রায় দুই শতধিক কারখানায় এমন মাল বানানো হয়। তা ছাড়া থানা পুলিশ ছাড়াও কিছু সাংবাদিক নিয়মিত মাসোহারা নেন বলে জানান তিনি।
কারখানার মালিক মিন্টু মিয়া বলেন, আমার ভ্যাট ট্যাক্সসহ সব লাইসেন্স রয়েছে। অবৈধভাবে ব্যবসা করি না। তবে মাঝে মধ্যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য দু-একটি নকল পণ্যের মোড়ক বানাতে হয়। তবে বৈধতার সপক্ষে তিনি কোনো কাগজ দেখাতে পারেননি।
এ দিকে এক লিটার ওজনধারী প্রতি হাজার প্লাস্টিক কৌটা ছয় হাজার টাকায় বিক্রয় হলেও নকল পণ্যের কৌটা প্রতি হাজার ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এ জন্য কারখানা মালিকরা পণ্য নকলকারীদের অর্ডার সাপ্লাই করতেই বেশি পছন্দ করেন। শুধু রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের অলিগলিতে এমন দুই শতাধিক কারখানা রয়েছে।
অন্য দিকে, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বিভিন্ন নামীদামি কোম্পানির মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য লাগেজ পার্টির মাধ্যমে দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। ওই সব পণ্যে টেম্পারিং করে (কেমিক্যাল ব্যবহার করে পুরাতন লেখা উঠিয়ে নতুন মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া) বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে এসব পণ্য দেশের বাজারে প্রবেশ করে বলে জানিয়েছেন ব্যাবসায়ীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাবসায়ী বলেন, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মার্কেটের দোকানের মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য শহরের বাইরে নিয়ে দোকান মালিকের নিজ খরচে ধ্বংস করতে হয়, যা অনেক ব্যয়বহুল। ওই সব মার্কেটে দেশীয় কিছু ব্যবসায়ী মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য ধ্বংস করার কথা বলে বিনামূল্যে সংগ্রহ করে লাগেজ পর্টিার মাধ্যমে দেশে নিয়ে আসছে। এরপর তুলনামূলক কম দামে এসব পণ্য বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। একই সাথে আইনি ব্যবস্থাকে আরো জোরদারসহ গণমাধ্যমকে আরো সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে। সর্বোপরি ভোক্তাদের নকল পণ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মৌলবীবাজার ব্যাবসায়ী সমিতির সভাপতি হাফেজ মো: এনায়েত উল্লাহ এ প্রতিবেদককে বলেন, নকলবাজরা দেশ ও জাতির শত্রু। এরা প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এদের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানান তিনি।
কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, থানা এলাকায় নকল পণ্য উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও র্যাব, ডিবি ও সিআইডি নিয়মিত ওই সব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করছে।
ওই সব অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement