২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের আরেক সাফল্য

-

মলা, ঢেলা মাছের মতোই সবার কাছে সমাদৃত এবং ভিটামিন ‘এ’, খনিজ উপাদান ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসে ভরা সুস্বাদু পিয়ালি মাছ। এটি অন্ধত্ব দূর এবং দাঁত ও হাড় গঠনে সহায়তা করে। বাড়ন্ত শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য পিয়ালি মাছ অন্যতম পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। পিয়ালি মাছ পদ্মা, যমুনা ও শাখা নদী বিধৌত এলাকার মানুষের কাছে অতি পরিচিত। এই মাছের স্বাদ ভোজনরসিক মানুষের মুখে মুখে। এক সময় পদ্মা, যমুনা ও শাখা নদী এবং বাঙ্গালী ও আত্রাই নদীতে প্রচুর পাওয়া যেত এই মাছ। পরিবেশ বিপর্যয় ও অতি আহরণের ফলে এটি এখন সঙ্কটাপন্ন মাছের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় পিয়ালি রক্ষার্থে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বগুড়া জেলার সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। এতে পিয়ালির পোনা প্রাপ্তি এখন সহজ হবে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, এক মাসের ব্যবধানে দেশীয় ছোট মাছ ঢেলা ও বাতাসির পর এবার পিয়ালি মাছের পোনা উৎপাদন ইনস্টিটিউটের গবেষকদের বিরাট সাফল্য। ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এ পর্যন্ত পাবদা, গুলশা, টেংরা, বাটা, ফলি, মহাশোল, খলিশা, বৈরালী, জাতপুঁটি, গজার, আঙ্গুস, খলিসা, মেনি, বালাচাটা, দাতিনা, গুতুম, ঢেলা, বাতাসি ও পিয়ালিসহ বিলুপ্তপ্রায় ২৯টি প্রজাতির মাছের পোনা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। পিয়ালি মাছের গবেষক দলে ছিলেন উপকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ডেভিট রিন্টু দাস, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: মনিরুজ্জামান ও মালিহা খানম।
মহাপরিচালক জানান, পিয়ালি মাছ এলাকা ভেদে জয়া বা পিয়াসি নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম অংঢ়রফড়ঢ়ধৎরধ লধুধ। এটি মিঠা পানির একটি মাছ। বাংলাদেশের পদ্মা ও যমুনা এবং তাদের শাখা নদীতে, ভারতের আসাম, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর প্রদেশ, নেপাল, ইরান, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও আফগানিস্থানে এই মাছের বিস্তৃতি রয়েছে। পিয়ালি মাছ দৈর্ঘ্যে ৫ থেকে ১৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর দেহ লম্বা ও পার্শ্বীয়ভাবে চাপা। পরিপক্ব পুরুষ মাছের পেট হলুদাভ থাকে এবং স্ত্রী মাছের চেয়ে আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। স্ত্রী মাছের পেট ধবধবে সাদা ও হালকা স্ফীতাকার হয়ে থাকে। এর একটা বৈশিষ্ট্য হলোÑ প্রতি বছর পিয়ালি মাছের শরীরের আঁশ ঝড়ে পড়ে এবং নতুন আঁশ তৈরি হয়।
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, গবেষকরা যমুনা, বাঙ্গালী ও আত্রাই নদীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পিয়ালি মাছের পোনা সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করেন। তারা পিয়ালি মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করেন। প্রাকৃতিক জলাশয়ে পিয়ালি মাছ মূলত প্লাংকটন (শ্যাওলা) ভোজী। তা ছাড়া বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে পিয়ালি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। এ প্রজাতির মাছ সাধারণত বর্ষাকালে অগভীর জলাশয়ে প্রজননে অংশগ্রহণ করে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, মে থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে নদীতে প্রজননক্ষম পরিপক্ব স্ত্রী মাছ পাওয়া যায় এবং জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে জলাশয়ে পিয়ালির পোনার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এতে প্রমাণিত হয় পিয়ালি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে-আগস্ট এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারি।
গবেষক দলের প্রধান ড. ডেভিড রিন্টু দাস জানান, পিয়ালি মাছ দ্রুত বর্ধনশীল ও খুবই সুস্বাদু। এই মাছ আমিষ, চর্বি, ক্যালসিয়াম ও লৌহসমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম পিয়ালি মাছে মেথিয়োনিন ৭৫০ মিলিগ্রাম, সিস্টিন ৪২০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৪৩০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৬৭০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ১৫০ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ১২.৮ মিলিগ্রাম, আয়রন ২৫ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ ৮.২১ মিলিগ্রাম এবং ১.৪০ শতাংশ কপার রয়েছে, যা অন্য অনেক দেশীয় ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণে এই মাছ অত্যন্ত কার্যকরী।
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আরো জানান, শিগগিরই আরো দু’টি দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনের সাফল্যের খবর আসছে। দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সব ছোট মাছ গবেষণার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ভোক্তাদের খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
সূত্র মতে, আইইউসিএন বাংলাদেশের হিসাব মতে (২০১৫), দেশের ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। এর মধ্যে ৯টি (৩%) অতি বিপন্ন, ৩০টি (১২%) বিপন্ন ও ২৫টি (১০%) শঙ্কাগ্রস্ত পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে গত ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চার গুণ। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি ‘লাইভ জীন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ এবং পোনা উৎপাদনে গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করে।


আরো সংবাদ



premium cement