২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানিকগঞ্জের হাজারী গুড় অনন্য ঐতিহ্যের নাম

-

মানিকগঞ্জের হাজারী গুড়। গোটা দেশে এক নামেই পরিচিতি বিশেষ এই খেজুর গুড়ের। ইতিহাসখ্যাত হাজারী গুড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দু’হাতে গুঁড়ো করে ফুঁ দিলে তা ছাতুর মতো বাতাসে উড়ে যায়। এ ঐতিহ্য দু-এক দিনের নয়; প্রায় দুই শত বছরের। মানিকগঞ্জের ঝিটকা গ্রামে মিনহাজ উদ্দিন হাজারী নামে একজন দক্ষ গাছি ছিলেন। দক্ষতা, সাধনা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আবিষ্কার করেন সুস্বাদু সুগন্ধি গুড়। তার নাম অনুসারেই এ গুড়ের নাম রাখা হয় হাজারী গুড়। হাজারী পরিবারের সদস্যরা এখনো এ সুনাম অক্ষুণœ রেখেছেন।
লোভনীয় স্বাদ আর মন মাতানো সুগন্ধে অতুলনীয় হাজারী গুড় এখন বিশ্ব সমাদৃত। একবার খেলে দ্বিতীয়বার খেতে চাইবে না এমন লোকের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথকেও এ গুড় উপহার দেয়া হয়েছিল। কথিত আছে, রানী এলিজাবেথ এই গুড়ের স্বাদ আস্বাদন করে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এমনকি বিশ্বের কমপক্ষে ২০টি দেশের বিভিন্ন শ্রেণী- পেশার মানুষ এ গুড়ের স্বাদ নিতে মুখিয়ে থাকেন, করেন ভূয়সী প্রশংসা। এক শ্রেণীর অসাধু গুড় তৈরিকারক সাদা রঙের গুড়ের উপর হাজারী গুড়ের নাম খোদাই করে বাজারজাত করে সাধারণ ক্রেতাদের ধোঁকা দিচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, ইদানীং মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি, ভেজালবিরোধী অভিযানে জেল-জরিমানা ও কঠোর হুঁশিয়ারির ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজারী গুড়ের নামে নকল গুড় দিয়ে বাজার সয়লাব করতে পারছে না। নির্বিচারে খেজুরগাছ কেটে ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবে পুড়িয়ে এই গুড় শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ছাড়াও গাছিসঙ্কট তো রয়েছেই। ফলে দিন দিন জৌলুশ আর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে হাজারী গুড়ে। যদিও ভোজন রসিকরা এর মান নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন তবুও স্বাদে-গন্ধে ঝিটকার হাজারী গুড় এখনো সারা বাংলায় তুলনাবিহীন এবং এর চাহিদা ব্যাপক।
বিখ্যাত এই হাজারী গুড় সম্পর্কে Final report on survey and settlement operations in the district of Dacca নামক নথিতে (১৯০১-১৯১১ খ্রি:) মি. এসকোলি যে মন্তব্য ছিল, ÔÔThe Cultivation of date palm is practically confined to the western thanas of the district two third of the recorded trees being found in the small thana of Harirumpur. Where 1.5 trees are found in every area. Jhitka in thana Harirumpur is the Centre of the date sugar (Gur) industry in the district ÔHazari GurÕ being deservedly famous for its purely and flavors.Ó (তথ্যসূত্র : মানিকগঞ্জের লোক ঐতিহ্যÑ মো: মোশাররফ হোসেন)। মি. এসকেলির মন্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, ঝিটকার খেজুরগাছ ও হাজারী গুড় আমাদের দেশের এক বিশাল কৃষিভিত্তিক লোকায়ত সম্পদ ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে এই গুড়ের সুনাম এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। এখনো এই গুড়ের কদর দেশ-বিদেশে রয়েছে।
চার পুরুষ ধরে গুড় উৎপাদন করে আসা গাছি আজমত আলি হাজারী (৬৭) জানান, ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই গুড় উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য সময়। আগের দিন বিকেলে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেয়া হয়। পরদিন ভোরে (সূর্য ওঠার আগে) রস সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে ছেঁকে মাটির তৈরি (জালা) পাত্রে চুলায় জ্বালিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় হাজারী গুড়। এই পদ্ধতি এখন আর হাজারী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রায় গাছিদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। এই গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া হাজারী গুড় হয় না। প্রতি কেজি গুড় ১৪ শ’ টাকা ১৫ শ’ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় বলে তিনি জানান। কালোই গ্রামের গাছি করিম মিয়া জানান, বাজারে একধরনের হাজারী সুদৃশ গুড় পাওয়া গেলেও মৌলিকভাবে তার ব্যবধান রয়েছে। নানা প্রতিকূলতায় মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী হাজারী খেজুরের গুড় প্রায় বিলীন হতে চলেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার খেজুরগাছ কেটে ইটভাটায় লাকড়ি হিসেবে পুড়িয়ে এই গুড় শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
এ হাজারী গুড়ের নানা উপকথা রয়েছে। হাজারী কোনো বংশগত নাম নয়। এটা ব্যক্তিবিশেষের নাম। প্রায় দুই শ’ বছর আগে ঝিটকা অঞ্চলের হাজারী প্রামাণিক নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। হঠাৎ একদিন বিকেলে খেজুরগাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামা মাত্রই একজন দরবেশ তার কাছে রস খেতে চায়। তখন ওই গাছি দরবেশকে বলেছিলেন, সবেমাত্র গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এ অল্প সময়ে বড়জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে। তবুও দরবেশ তাকে গাছে উঠে হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার আকুতি জানায়। দরবেশের রস খাওয়ার ইচ্ছায় গাছি সত্যি সত্যি খেজুরগাছে উঠেই হতবাক হয়ে যান। গাছি দেখতে পান, সারা রাত ধরে রস পড়তে থাকলে যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল সেখানে মাত্র কয়েক মিনিটে পুরো হাঁড়ি রসে ভরে গেছে। গাছি হাঁড়ি ভরপুর রস নিয়ে নিচে নেমে দরবেশকে রস খাওয়ান এবং পা জড়িয়ে ধরেন। গাছিকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে দরবেশ বললেন, কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সবাই খাবে এবং তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওই দরবেশকে পাওয়া যায়নি। ওই দিন থেকেই হাজারী প্রামাণিকের নামেই এ গুড়ের ‘হাজারী’ নামকরণ করা হয়।
আবার প্রবীণ অনেকেরই মতে, গাছের রস থেকে বিশেষ কৌশলে সুগন্ধময় স্বাদ সফেদ এ গুড়ের উদ্ভাবন করেছিলেন হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা গ্রামের মিনহাজ উদ্দিন হাজারী। প্রকৃত হাজারী গুড় তৈরীর গোপন কৌশল একমাত্র তার পরিবারের সদস্যদের মাঝেই রয়ে গেছে। আজো এ গুড় নিয়ে মানিকগঞ্জবাসীর অহঙ্কারের কমতি নেই। তার নামেই এই গুড়ের নামকরণ করা হয়েছে ‘হাজারী গুড়’।
যেভাবে তৈরি হয় হাজারী গুড় : স্থানীয় গাছিরা দুপুরের পর থেকে খেজুরগাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে দেন। সারা রাত ওই হাঁড়িতে রস পড়ার পর ভোররাতে আবার গাছ থেকে হাঁড়ি নামানো হয়। এরপর গাছি পরিবারের মহিলারা মাটির চুলায় ভোর থেকে রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে। রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে একটি মাটির হাঁড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘুঁটে ঘুঁটে তৈরি করা হয় সাদা রঙের হাজারী গুড়। বেশি শীত অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ গুড় উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য সময়। আগের দিন বিকেলে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেয়া হয়। পরদিন ভোরে (সূর্য ওঠার আগে) গাছ থেকে রস নামিয়ে ছেঁকে ময়লা পরিষ্কার করে মাটির তৈরি জালা অথবা টিনের তৈরি তাফালে (পাত্র) বাইনে (চুলা) জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় খড়কুটো, নাড়া ও কাশ। এ গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া এ গুড় হয় না।
হাজারী গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ২০১৭ সালে মানিকগঞ্জের ডিসি মো: নাজমুছ সাদাত সেলিমের সভাপতিত্বে মানিকগঞ্জ জেলা ব্র্যান্ডিং নামে একটি বই ছাপা হয়। ‘লোক সঙ্গীত আর হাজারী গুড়, মানিকগঞ্জের প্রাণের সুর’ লোগো নির্মিত বইটির মাধ্যমেই বেঁচে থাকবে ঝিটকার ঐতিহ্যবাহী হাজারী গুড়ের নাম।
ঝিটকা হাট-বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: জহিরুল ইসলাম (সেন্টু) জানান, শীত মৌসুমে খেজুরগাছ এ অঞ্চলে একটি শিল্পে পরিণত হয়। বিশেষ করে হাজারী গুড়ের বদৌলতে এখানে অর্থনৈতিক চাঙ্গাভাব বিরাজ করে। রস থেকে গুড় উৎপাদন ও ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে পেশাদার গাছি, কুমার, কামার, জ্বালানি ব্যবসায়ী, পরিবহনের শ্রমিক, ট্রাক মালিক-চালক, ভ্যান চালক, আড়তদারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ সংযুক্ত হন। পৌষের মাঝামাঝি থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই এই হাজারী গুড় দেশ-বিদেশে চলে যায়।
স্থানীয় গালা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিক বিশ্বাস জানান, সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র মানিকগঞ্জের ঝিটকাতে তৈরি হয় এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ হাজারী গুড়। ঝিটকা এলাকা খেজুর গুড় শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। গুণে-মানে, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় এই গুড়ের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের অন্তত ২০টি রাষ্ট্রে। হাজারী গুড় ও এই এলাকার সুনাম অক্ষুণœ রাখতে অসাধু ব্যবসায়ী ও ভেজাল গুড়ের বিরুদ্ধে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি আমরা ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকেও নিয়মিত তদারকি করে আসছি।
নানা প্রতিকূলতায় মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী হাজারী খেজুরের গুড় প্রায় বিলীন হতে চলেছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ এই গুড় শুধু হাজারী পরিবারকেই বিখ্যাত করেনি, বৃহত্তর ঝিটকা তথা মানিকগঞ্জ জেলাকেই করেছে বিখ্যাত, প্রসিদ্ধ ও সমৃদ্ধ।


আরো সংবাদ



premium cement