০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


চলতি বছর রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়বে

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি
-

বাংলাদেশ থেকে ২০২০ সালে জনশক্তি যাওয়ার হার মোটেও সন্তোষজনক না হওয়ার পরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছে বলে মনে করছে প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গত বছর রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদেরকে সাত লাখ ভিসা ক্রয় করতে হয়নি। যদি প্রয়োজন হতো তাহলে তাদেরকে কমপক্ষে ১০৫ কোটি মার্কিন ডলার পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হতো। ভিসা কেনা লাগেনি বলেই এই হুন্ডির প্রয়োজন পড়েনি। তবে ২০২০ সালে বিদেশে শ্রমিক যেতে না পারার কারণে চলতি বছর (২০২১) রেমিট্যান্সে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম অভিবাসনের গতি-প্রকৃতি ২০২০ : অর্জন এবং চ্যালেঞ্জ শীর্ষক বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্যই দিয়েছে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। অনলাইনে মূল প্রতিবেদন তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী।
রেমিট্যান্স নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমে দাঁড়াবে এক হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারে। এই আয় গত বছরের (২০১৯) তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। অথচ ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অভিবাসী শ্রমিকরা ১৯.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। রেমিট্যান্সপ্রবাহের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৯ সালের তুলনায় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ১৭.০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১৮.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে এই রেমিট্যান্স বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ ৩৯.৬৫ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর ছিল ৩৮.৫০ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবেদনে কোন দেশ থেকে কত ডলার রেমিট্যান্স এসেছে তার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সর্বাধিক রেমিট্যান্স এসেছে সৌদি আরব থেকে ৪.১৮৬ বিলিয়ন (২১.২৬ শতাংশ)। এরপরই যথক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২.৬০৩ বিলিয়ন (১৩.২২ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২.১৪৭ বিলিয়ন (১০.৯১ শতাংশ), মালয়েশিয়া ১.৩৮৯ বিলিয়ন (৭.০৬ শতাংশ), যুক্তরাজ্যে ১.৩৭৪ বিলিয়ন (৬.৯৮ শতাংশ) এবং ওমান ১.২৬৬ বিলিয়ন (৬.৪৩ শতাংশ)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণকারী ব্যাংক হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। যার ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আহরণের পরিমাণ ৫.১৬৮ বিলিয়ন (২৬.২৫ শতাংশ) মার্কিন ডলার। এরপরের স্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক ২.২২৪ বিলিয়ন (১১.৩০ শতাংশ), ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড ১.৭৭১ বিলিয়ন (৮.৯৯ শতাংশ), সোনালী ব্যাংক ১.৩০৩ বিলিয়ন (৬.৬২ শতাংশ) এবং জনতা ব্যাংক ০.৮৩৫ বিলিয়ন (৪.২৪ শতাংশ) মার্কিন ডলার।
এসব পরিসংখ্যান তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাস বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হয়নি। করোনার প্রভাবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই নি¤œমুখী ছিল রেমিট্যান্সের ধারা। মার্চ ও এপ্রিলেও বড় বিপর্যয় ঘটে রেমিট্যাপন্সে। আগস্টে এসে রেমিট্যান্স সামান্য কমলেও সেপ্টেম্বরে আবারো বেড়ে যায়। রেমিট্যান্স বাড়ার অনেকগুলো কারণ কাজ করছে বলে মনে করছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
প্রথমত রিক্রুটিং এজেন্সির বিদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ নেই। সাত লাখ ভিসা ক্রয় করতে হলে ভিসা প্রতি গড়ে ১৫ শ’ ডলার যদি দাম হয় তবে তাদের প্রয়োজন পড়ত ১০৫ কোটি মার্কিন ডলার। এ অর্থ তারা হুন্ডির মাধ্যমেই সংগ্রহ করতেন। ভিসা কেনা লাগেনি বলেই এই হুন্ডির প্রয়োজন পড়েনি। দ্বিতীয়, ২০২০ সালে বাণিজ্য ছিল কম। মূল্য পরিশোধের জন্য হুন্ডির যে টাকা প্রয়োজন পড়ত সেটি তাদের লাগেনি। ধরে নেয়া যায়, স্বর্ণ চোরাচালানও ২০২০ সালে কম হয়েছে। ফলে তাদেরও হুন্ডির টাকা দরকার ছিল না।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক অভিবাসীকে দেশে ফেরত আসতে হচ্ছে। যাদের চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে তারা তাদের সঞ্চয় ভাগে ভাগে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। কারণ সাথে করে বেশি টাকা আনা যায় না।
বিদেশে থাকা অনেকে সঞ্চয় ভেঙে টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন। করোনা, বন্যা ইত্যাদির কারণে অনেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। সঙ্কটে থাকার পরও অনেক প্রবাসী ঈদের সময় দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে। সে অনুযায়ী ১ জুলাই ২০১৯ থেকে প্রবাসীরা প্রতি ১০০ টাকার বিপরীতে দুই টাকা প্রণোদনা পাচ্ছেন।
বাজেটে এ জন্য ৩০৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে। এরসাথে যুক্ত করে অনেক ব্যাংক আরো এক শতাংশ বেশি প্রণোদনা দিচ্ছে। বৈধপথে রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, সব অভিবাসীই ভালো আছেন। চলতি বছরের রেমিট্যান্সপ্রবাহের গতি প্রকৃতি অন্যরকম হতে পারে আশঙ্কা করে রামরুর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেমিট্যান্স সবসময় কিউমিলিটিভ। এ বছরে যারা যান তারা পরের বছর থেকে নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাতে শুরু করেন। তাই ২০২০ সালে লোক যেতে না পারায় আগামী বছরের রেমিট্যান্সপ্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়। যেকোনো মহামারী পরিস্থিতিতে অভিবাসীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন বলেও উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে ২১ হাজার ৯৩৪ জন নারীকর্মীসহ বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র দুই লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জনের। এর মধ্যে এক লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ জনই গেছেন সৌদি আরবে। অপর দিকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছিল সাত লাখ ১৫৯ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন তিন লাখ ৯৯ হাজার কর্মী। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী।


আরো সংবাদ



premium cement