২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে সমুদ্র সম্পদ আহরণ পরিকল্পনা প্রয়োজন

-

সমুদ্রকে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বলছেন, বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সমুদ্রের তলদেশে অতি মূল্যবান যে খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে তা কাজে লাগাতে পারলে দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দেবে সমুদ্র সম্পদ। তাই সমুদ্র সম্পদ রক্ষার আইনের কঠোর প্রয়োগ, যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষক ও পরিবেশবাদীরা।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদন ও বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের অগভীর ও গভীর সমুদ্রের তলদেশে অতি মূল্যবান খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে ভারী খনিজ বালুও পাওয়া গেছে। এ বালু ইলমেনাইট, গার্নেট, সিলিমানাইট, জিরকন, রুটাইল ও ম্যাগনেটাইট সমৃদ্ধ।
সমুদ্র গবেষণাকারী সংস্থা ‘সেভস আওয়ার সি’ জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ টন মৎস্য আহরিত হয়। সেখানে বাংলাদেশ মাত্র ৯৫ হাজার টন মাছ ধরতে পারে। বাংলাদেশী জেলেরা ৩৫৪ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত গিয়ে মাছ শিকার করেন। তাদের কাছে দূর সমুদ্রে গিয়ে মাছ শিকারের জন্য যেমন উন্নত প্রযুক্তির জাহাজ নেই, তেমনি নেই উন্নতমানের মাছ ধরার জাল। অথচ জেলেরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সামুদ্রিক মৎস্য সংগ্রহ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে বাংলাদেশ।
২০১৪ সালের জুলাইয়ে ভারত এবং এর আগে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকা (টেরিটোরিয়াল সি), ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার পেয়েছে। ব্লু ইকোনমি বা নীল সমুদ্রের অর্থনীতি হিসেবে খ্যাত এ খনিজ সম্পদ উত্তোলন করতে পারলে রাতারাতি ভাগ্য বদলে যাবে বাংলাদেশের।
বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে ২৫০ জাতের মিঠাপানির মাছ এর বিপরীতে সাগরে রয়েছে অন্তত ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে প্রতি বছর ৮ মিলিয়ন টন মাছ ধরা পড়ে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন মাছ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করে। যার সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মোট মাছের উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৩৩ লাখ মেট্রিক টন। এ পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত কিছু জরিপ থেকে জানা যায়, নানা প্রজাতির মূল্যবান মাছ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির চিংড়ি, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত এক সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা সমুদ্র সম্পদ আহরণে পরিকল্পিত পরিকল্পনা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়ে বলেন, সমুদ্রসৈকতে চলাচলকারী জলযানগুলোর অসচেতনতা আর পর্যটকদের উদাসীনতায় নষ্ট হচ্ছে সাগরের নিচের সৌন্দর্য। সমুদ্রের নিচের সৌন্দর্য যেভাবে বিনষ্ট হচ্ছে, তা এখনই ঠেকাতে না পারলে নীরবেই হারিয়ে যাবে অমূল্য সম্পদ।
অন্য দিকে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের জীববৈচিত্র্য বিভাগের সদস্য ও সেভ আওয়ার সির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিসুজ্জামান খান জানান, এসডিজির ১৪ নম্বর লক্ষ্যতে সাগর ও সমুদ্র অর্থনীতির কথা বলা আছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও সাগরতলে বহু সম্পদ আছে। তবে পরিবেশের তোয়াক্কা না করেই এলএনজি টার্মিনাল, গভীর সমুদ্র বন্দর, বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য, কক্সবাজার সৈকতের অপরিকল্পিত হোটেল মোটেল নির্মাণ করায় সমুদ্রের অভ্যন্তরণে ও সমুদ্রসংলগ্ন এলাকার জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। তার মতে, সাগরের সাথে সহাবস্থান করেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন উদ্ভাবন। সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
সমুদ্র সম্পদ রক্ষার আইনের কঠোর প্রয়োগ, যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করেন পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করা প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু। সমুদ্রকে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিয়ম না মেনে আহরণের কারণে সমুদ্রের মৎস্য সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
অতীতে সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বিরোধ থাকায় সমুদ্র সম্পদ ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা ছিল বাংলাদেশের। জাতিসঙ্ঘের আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নিয়ে সেই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়েছে। সমুদ্র আইনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ পেয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সমুদ্রসীমা, যার ১২ নটিক্যাল মাইল রাজনৈতিক সীমা (এই অংশে বাংলাদেশ যা খুশি তাই করতে পারবে), ২০০ নটিক্যাল মাইল অবধি অর্থনৈতিক সীমা (প্রাণিজ-অপ্রাণিজ ও তেল-গ্যাসসহ খনিজসম্পদ উত্তোলনের ক্ষমতা) আর ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল মহীসোপান অঞ্চলে মৎস্য আহরণ, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও অন্যান্য খনিজসম্পদ আহরণের আধিপত্য।


আরো সংবাদ



premium cement