১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

বোরো কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় হাওরের কৃষকরা

ধান কাটার শ্রমিক পাচ্ছে না সাতজেলার কৃষক; ধানের দাম অন্যান্য বছরের চেয়ে কমে যেতে পারে
-

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বোরো ধান ঘরে তোলা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছে হাওর অধ্যুষিত সাত জেলার কয়েক হাজার কৃষক পরিবার। ধান কাটার শ্রমিকের অভাব ও পর্যাপ্ত মেশিন না থাকায় যথাসময়ে বোরো ধান কেটে গোলায় উঠাতে পারবে কি না এ নিয়ে চরম অনিশ্চিয়তায় ভুগছে তারা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধান কাটতে না পারলে অকাল বন্যা এবং পাহাড়ি ঢলে ফসল তলিয়ে যাবে। একই সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ধানের মূল্য কম পাওয়ার দুশ্চিন্তা। এ অবস্থায় উচ্চ সুদে ঋণ পরিশোধসহ উৎপাদনের খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হবে কৃষকদের। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কৃষকদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলার কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশের খাদ্য সরবরাহের বড় অংশটি নিশ্চিত হয় বোরো ধানের মাধ্যমে। সরকারি গুদামে মজুদের মূল অংশটিও নির্ভর করে এ ফসল থেকে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে মূলত বোরো কাটা শুরু হলেও এবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে কিছুটা দেরিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এবার বোরোতে দুই কোটি টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সিলেটের একাংশের অন্তত আড়াই শ হাওরে বোরো আবাদ হয়। দেশের মোট বোরো ফসলের প্রায় ১৯ শতাংশ আসে এসব হাওর থেকে। গত দুই বছর অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে কৃষকরা বোরো ধান ঘরে উঠাতে পারেনি। এতে এক ফসলি জমির উপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। এবার কড়া সুদে ঋণ নিয়ে আবার সেই জমিতে আবাদ করে। তবে ফসল ঘরে ওঠাতে না পারলে তবে জমি বিক্রি করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকবে না।
কৃষকরা জানান, বোরো ফসল উঠিয়েই ধান বিক্রি করে ধান কাটার শ্রমিক, মাড়াই এবং ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এ সময় প্রতি বছর ধানের দাম একদম কম থাকে। তবে করোনার কারণে ধানের দাম আরো কমে যাওয়া শঙ্কা করছেন তারা। এমনটা যদি হয় তবে কৃষকরা এবারো ঋণের বোঝা কমাতে পারবে না।
কিশোরগঞ্জ ইটনা ধইলং হাওরে প্রায় দুই হাজার মণের ফসল করেছেন বাচ্চু মিয়া। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক ম্যানেজ করতে পারিনি। ইতোমধ্যে বিআর২৮ ধান পেকে গেছে। এক সপ্তাহ মধ্যে এ ধান না কাটতে না পারলে ধান নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে বাকি জাতের ধান আগামী ১০ দিনের মধ্যে কেটে শেষ করতে হবে। না হয় হাওরে পানি চলে আসবে। এখন কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ধান কাটার কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার দেয়া হয়েছে। ধান কাটার পুরো সময়টুকুতে হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, নিকলী এবং তাড়াইল ইউএনও এবং কৃষি কর্মকর্তারা সমন্বয় করে কাজ করবেন। তিনি বলেন, ধান কাটার জন্য জামালপুর, কুড়িগ্রামসহ আরও কয়েকটি জেলা থেকে শ্রমিকরা আসেন। যানবাহন বন্ধ থাকায় এবার একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে অনেক হাওরে বিকল্প পদ্ধতিতে শ্রমিকরা এসেছে বলে জানান তিনি।
এদিকে গত সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেটের আওতায় হাওর অঞ্চলের (কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ধান কাটার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার বরাদ্দ দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন,বর্তমানে হাওর অঞ্চলে ৩৬২টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১০৫৬টি রিপার সচল রয়েছে। এ ছাড়াও পুরোনো মেরামতযোগ্য ২২০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৪৮৭টি রিপার অতি দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান বলেন, ধান কাটার শ্রমিক কিছুটা সমস্যা হতে পারে। সে জন্য এবার আমরা অতিরিক্ত ধান কাটার যন্ত্রপাতি দিয়েছি। অন্যান্য জেলা থেকে ধান কাটতে আসা শ্রমিকরা যেন সমস্যা না পড়ে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে হাওর এলাকায় শ্রমিকরা যাতে নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে সেই উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে প্রচুর শ্রমিক গিয়ে এখন গ্রামে অবস্থান করছেন। তারা এখন ধান কাটার কাজে অংশ নিতে পারবেন। তাই ধান ওঠানোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন তিনি।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা রিপার ও হারভেস্টার কিনেছি। যন্ত্রপাতিগুলো হাওরে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়ায় হাওর শুকনা, কোনো কাদা নেই। তাই এই কমন হারভেস্টার বা রিপার দিয়ে ধান কাটতে কোনো সমস্যা হবে না। তাই শ্রমিকদের চাপ এবার একটু কম হলেও সমস্যা হবে না। আর প্লেইন ল্যান্ডে বোরো ঘরে তুলতে সমস্যা হবে না বলে জানান তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড আবদুল মঈদ বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ৫০ পার্সেন্ট পরিশোধের মাধ্যমে ধান কাটার মেশিন দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট জটিল আকার দেখা দিলে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে অন্যান্য ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে। কৃষকদের ধান ঘরে তোলার স্বার্থেই সরকার হাওরের ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ইতোমধ্যে হাওরে বাঁধগুলোর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। আশা করছি সুন্দরভাবেই কৃষক ঘরে ফসল তুলতে পারবে। তিনি বলেন, আাগামী জুনের মধ্যে ৬৪ জেলায় তিন ক্যাটাগরির কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- কম্বাইন হারবেস্টর, রিপার এবং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার সরবরাহ করা হবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চার ড. মোহনকুমার দাশ বলেন, সারাদেশে উৎপাদিত ধানের ১৮ শতাংশের বেশি আসে হাওরাঞ্চল থেকে। কিন্তু কোনো রকম বন্যা হলেই ফসলগুলো তলিয়ে যায়। এতে পথে বসতে হয় কৃষকদের। এবার করোনাভাইরাসের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া অনুরোধ করেন তিনি।
হাওর নিয়ে কাজ করে সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্ট্রর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম নামে একটি সংগঠন। সংগঠনটির গবেষণা সেলের প্রধান আব্দুল আলীম বলেন, একটা বৈরি পরিস্থিতির মধ্যে থাকে হাওরের লোকজন। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসব অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। তার মধ্যে এবার করোনাভাইরাস বোরো ফসলের তুলতে মারাত্মক সমস্যা হবে। তিনি বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধান কাটতে না পারলে পানিতে তলিয়ে যাবে। হাওরে পানি প্রবেশ করতে সময় লাগে ১০ থেকে ১২ দিন। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এই সময়ের মধ্যেই ধান কেটে ফেলা সম্ভব। সহজ শর্তে কৃষককে ধান কাটার মেশিন কিনতে সহায়তা করতে সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বলেন, হাওরাঞ্চলের কৃষকের প্রধান সমস্যা দু’টি। প্রথমত তারা সময় মতো বন্যার সঠিক পূর্বাভাস পায় না। দ্বিতীয়ত উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার না করায় বন্যার সময় দ্রুত ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারে না।


আরো সংবাদ



premium cement