১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

নামমাত্র পরিশোধ করে খেলাপি ঋণ কমানো হলো ২২ হাজার কোটি টাকা

-

নামমাত্র পরিশোধ করে তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমানো হলো প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে যেখানে ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এসে তা কমে নেমেছে প্রায় ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিসেম্বরভিত্তিক খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো: সিরাজুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, তিন কারণে খেলাপি ঋণ কমে এসেছে। প্রথমত বছরের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার প্রতি সম্মান রেখেই ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছিল। অপর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। পুনঃতফসিলের বিশেষ সুবিধা ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতি বছরই ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্সশিট স্বচ্ছ রাখতে ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর জোর দেয়ার সাথে নানা উপায়ে কমানো হয়। এসব কারণে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কমতে সহায়ক হয়েছে।
জানা গেছে, বিদায়ী বছরের জানুয়ারিতে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরেই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঘোষণা করেছিলেন খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। যখন তিনি এ ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন (ডিসেম্বর-১৮ প্রান্তিকে) ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা। তখন অনেকেই নানা সমালোচনা করেছিলেন। যেখানে বড় বড় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। এতে পাগলা ঘোড়ার মতো খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এমনি পরিস্থিতিতে অর্থমন্ত্রী এমন কি জাদুর কাঠি এনেছেন যে যার স্পর্শে খেলাপি ঋণ এক টাকাও বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো খেলাপি ঋণ ঠিকই কমেছে। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিসহায়তা দিয়েছিল। নীতিমালায় শিথিলতা আনা হয়। আগে তিন মাস অনাদায়ী থাকলেই তা খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হতো। এটি সংশোধন করে ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ ১২ মাস করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বছরের শুরুতেই ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়। সুদহারেও ছাড় দেয়া হয়। অর্থাৎ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নবায়নের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে এর ওপর কয়েক দফা রিট করায় কার্যকরের সময় পিছিয়ে যায়। গত ২৩ সেপ্টম্বর থেকে মন্দমানের খেলাপি ঋণ বিশেষ এ সুবিধায় নবায়ন করা শুরু হয়। এ বিশেষ সুবিধায় ঋণ নবায়ন করতে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও বেশ সাড়া পড়ে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘ দিনের মন্দমানের খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে বেশি আগ্রহী হন ব্যবসায়ীরা । গণছাড়ের আওতায় ১৫ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছে ব্যাংকগুলো। এর বেশির ভাগই সরকারি ব্যাংকগুলোর। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েও গত বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো। তবে অবলোপনকৃত ঋণের প্রকৃত তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। এসব কারণেই খেলাপি ঋণের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা গেছে। এতে বছর শেষে ব্যাংকগুলোর আয়ের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যদিও ব্যাংকগুলো মুনাফা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ঋণ অবলোপন বাদে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে এসে তা আরো বেড়ে হয় এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। কিন্তু বিশেষ সুবিধায় ব্যাপক ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ নবায়ন হওয়ায় খেলাপি ঋণ এখন এক লাখ কোটি টাকার নিচে নেমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৮৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪৩ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা বা ২৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের এক লাখ ৬২ হাজার ৫২০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণ ছিল ৪৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ৪৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণকৃত সাত লাখ ৬৩ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা ঋণের ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আগের বছর খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। দীর্ঘ দিন সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেশি ছিল। কিন্তু গত বছর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। বিদেশী ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দুই হাজার ১০৩ কোটি টাকা। বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ চার হাজার ৫৯ কোটি টাকা; আগের বছর যা ছিল চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা।
তবে, ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অতীতেও বিকল্প উপায়ে খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছিল। কিন্তু তার সুফল ব্যবসায়ীরা পেলেও ব্যাংকগুলো পায়নি। যেমন, ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর বর্তমান সরকারের তৎকালীন গভর্নর খেলাপি ঋণ কমানোর বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। ওইবারের নির্বাচনের আগে টানা হরতাল ও অবরোধের কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষাতে খেলাপি ঋণ নবায়নে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। ৫০০ ও ১ হাজার কোটি টাকার ওপরের ঋণখেলাপিদের জন্য এ ছাড় দেয়া হয়েছিল। ৫০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ এবং এক হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণের বিপরীতে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তখন এর নাম দেয়া হয়েছিল ‘ঋণ পুনর্গঠন’। এ ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা নিয়ে ১৪টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছিল। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হিসেব থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা কমে গিয়েছিল। কিন্তু এর কিছু দিন পরেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়। কিন্তু মাঝ খান থেকে উদ্যোক্তারা এ সুবিধা নিয়ে ব্যাংক থেকে আবার নতুন করে ঋণ নিয়েছিলেন। তেমনিভাবে এবারো এর সুফল ব্যাংকের চেয়ে ব্যবসায়ীরাই বেশি পাবেন। কারণ, এবার এক বছরের গ্রেস পিড়িয়ড দিয়ে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টর বিপরীতে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই এক বছরে ঋণখেলাপিদের তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। কিন্তু গ্রেস পিড়িয়ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে আবারো এসব ঋণ খেলাপি ঋণে পরিণত হবে। ফলে ব্যাংক খুব লাভবান হবে না, বরং এক বছরে ঋণ আদায় কমে যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement