৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণের রেকর্ড

বায়ু দূষণে সিটি করপোরেশনের ব্যাখ্যায় অসন্তুষ্ট হাইকোর্ট
-

উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কার্বনডাই অক্সাইড এ বছর রেকর্ড পরিমাণ নিঃসরণ হয়েছে। এল নিনুর এ বছরে কার্বনডাই অক্সাইডের বেশি নিঃসরণে তাপ বৃদ্ধি পাবে। কারণ কার্বনডাই অক্সাইড তাপ ধরে রাখতে পারে প্রচুর। এর আগে তিন মিলিয়ন (৩০ লাখ) বছর আগে বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাই অক্সাইডের লেবেল সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। তখন বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এখনকার চেয়ে ছিল কয়েক মিটার বেশি। কার্বনডাই অক্সাইডের লেবেল বৃদ্ধির আগে অ্যান্টার্কটিকার কিছু অঞ্চল বনভূমিতে পূর্ণ ছিল এখন সেখানকার পুরোটাই বরফে ঢাকা।
এদিকে ঢাকায় বায়ুদূষণ রোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে যথাযথভাবে উঠে না আসায়, আবারো অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। একই সাথে আগামী ২৬ জুনের মধ্যে এ বিষয়ে ফের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান দুই নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি কার্বনডাই অক্সাইডের প্রমাণ পেয়েছেন বায়ুমণ্ডলে এ বছর। হাওয়াইয়ের মওনা লুয়া পর্যবেক্ষণ সেন্টারে ১৯৫০ সাল থেকে কার্বনডাই অক্সাইডের লেবেল পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। গত শনিবার এই পর্যবেক্ষণ সেন্টার প্রতি মিলিয়নে ৪১৫.২৬ পার্টস কার্বনডাই অক্সাইড পেয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ সেন্টারে এই প্রথম দৈনিক ভিত্তিতে কার্বনডাই অক্সাইডের লেবেল মাপা হচ্ছে। জলবায়ুকে সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না ফলে বছরের পর বছর ধরে জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিমাণটা স্থিতিশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
ফসিল থেকে প্রাপ্ত জ্বালানি পোড়ালে বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাই অক্সাইড বাড়ে তিনগুণ।
স্ক্রিপস ইনস্টিটিউট অব অশেনোগ্রাফির পরিচালক রালফ কিলিং বলেন, কার্বনডাই অক্সাইড বৃদ্ধির সাম্প্রতিক গড় ছিল ২.৫ পিপিএম। ২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে শিল্প যুগের পূর্বের তাপমাত্রার সাথে তুলনা করে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৩.৬ ফারেনহাট) নিচে রাখার চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু গত চারটি বছর ছিল পর পর চারটি উষ্ণতম বছর। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির পরও নিঃসরণের পূর্ব ইতিহাস ভেঙে গেছে।
মনুষ্যসৃষ্ট কার্বন নিঃসরণের কারণে ভূপৃষ্ঠের ওপরের তাপমাত্রা শিল্প যুগের পূর্বাবস্থা থেকে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। মানুষের ইতিহাসের পূর্বের সব রেকর্ড ছিল এখনকার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি ঠাণ্ডার ইতিহাস। ইঞ্জিন চালালেই আমরা কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ করতে থাকি। এই নিঃসরণ অদৃশ্য হয়ে যায় না, এটা থেকে যায় বায়ুমণ্ডলে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিসহ সব বক্তৃৃতা বিবৃতি সত্ত্বেও উষ্ণতা বৃদ্ধির গ্রাফ কার্ভকে নিচের দিকে নামানো যায়নি। মানুষ বিশেষ করে শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলো কার্বনডাই অক্সাইড কমিয়ে রাখার উদ্যোগে সাড়া দেয়নি।
বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাই অক্সাইডের নিরাপদ লেবেল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবু একটি ঐকমত্য রয়েছে কার্বনডাই অক্সাইডের নিরাপদ লেবেল ৩৫০ পিপিএম। এই লেবেল ১৯৮০ সালেই অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এ মাসেই ৪১৫ পিপিএম অতিক্রম করেছে এবং ইতোমধ্যে ৪১৫ পিপিএমও অতিক্রম করেছে। দুই বছর আগে প্রথম ৪১০ পিপিএমে পৌঁছেছে। এখন ৪১৫ এবং এখান থেকেও বেড়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কয়লা পোড়ালে পেট্রলের চেয়ে দ্বিগুণ কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ হয়। বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ৮৫ শতাংশের চেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহার হচ্ছে। চীন ও ইন্ডিয়ার অব্যাহত শিল্পায়নের কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র বাড়বে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ৪১ শতাংশ কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
যানবাহন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বৃহৎ পরিমাণে কার্বনডাই অক্সাইড ছাড়ে বায়ুমণ্ডলে। আন্তর্জাতিক যাতাযাতও বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড বৃদ্ধির জন্য দায়ী। ছুটির দিনে সমুদ্রে প্রমোদ ভ্রমণে আনন্দ করায় যে পরিমাণ কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরিত হয় তা ভূমিতে একই সময়ে ছোটাছুটি করা যানবাহনের কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণের চেয়ে ১২ গুণ বেশি।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, কোপেনহেগেনে ১১ দিনব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনে যে জ্বালানি পোড়ানো হয়েছে তাতে ৪১ হাজার টন কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরিত হয়েছে। এ ছাড়া লৌহ, স্টিল ও সিমেন্ট উৎপাদনে ও অন্যান্য শিল্প উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্রে ২ শতাংশ কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। বনভূমি পরিষ্কার করে ফেলায় গাছ কমে যায়। বিশ্বব্যাপী কেবল গাছ কেটে ফেলায় কার্বনডাই অক্সাইড নিঃসরণ হচ্ছে ২০ শতাংশ।
সিটি করপোরেশনের ব্যাখ্যায় অসন্তুষ্ট হাইকোর্ট
রাজধানীতে বায়ুদূষণ রোধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনে যথাযথভাবে উঠে না আসায়, আবারো অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। একই সাথে আগামী ২৬ জুনের মধ্যে এ বিষয়ে ফের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান দুই নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বায়ুদূষণ রোধে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান দুই নির্বাহীর ব্যাখ্যা শেষে গতকাল বুধবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান এবং বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতের তলব আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার ব্যাখ্যা দিতে হাজির হয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী মো: আবদুল হাই এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী মোস্তাফিজুর রহমান।
আদালত দুই নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন, আপনাদের অনেক অবহেলা রয়েছে। জনগণের কাছ থেকে যে পরিমাণ কর নেন সেই সেবা আপনারা জনগণকে দেন না। আপনারা এ দেশের সন্তান। পাকিস্তান আমলের নয়, সবাই বাংলাদেশের কর্মকর্তা। দেশের প্রতি আপনাদের মায়া থাকা উচিত। মায়া না থাকলে পুরান এই শহর ঢাকাকে বসবাস যোগ্য করে গড়ে তোলা যাবে না।
আদালত আরো বলেন, মশা নিধনে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি ব্যবস্থা না নেন, তাহলে নগরবাসী ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হবে। আইন ও আদালতের আদেশ আপনাদের মানতে হবে। কেউই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। আপনাদের আমাদের সবার বেতন হয় জনগণের করের টাকায়। অতএব জনগণকে সঠিক সেবাটা দিতে হবে।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। অন্য দিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। নির্বাহী কর্মকর্তাদের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী ড. নুরুন্নাহার নূপুর।
উল্লেখ্য, গত ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে রিট আবেদনটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। সেই রিটের শুনানি শেষে গত ২৮ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ বন্ধে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুল জারির পাশাপাশি বায়ুদূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশও দেন। ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে আদালতকে অবহিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ ছাড়াও পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তাদেরকে ওই আদেশ পালন করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। যার ধারাবাহিকতায় মামলাটি আবার শুনানিকালে আদালত রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং এ বিষয়ে আদেশ দেন। এরপর গত ১৩ মার্চ ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপ করে এবং দূষণরোধে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা প্রতিবেদন আকারে দাখিল করতে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।


আরো সংবাদ



premium cement