২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জাহানমনির অভিজ্ঞতায় এগোচ্ছে মালিকপক্ষ

ঈদের আগেই পণবন্দী জাহাজ ও নাবিক উদ্ধারে দরকষাকষি চলছে

-


গত ১২ মার্চ থেকে সোমালীয় উপকূলে পণবন্দী বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিককে উদ্ধারে জলদস্যুদের সাথে দরকষাকষি চালিয়ে যাচ্ছে জাহাজ মালিকপক্ষ। আলোচনায় অগ্রগতি আছে জানিয়ে সূত্র বলছে, আসছে ঈদের আগেই নাবিকদের দেশে ফেরানোর লক্ষ্যে কাজ করছে জাহাজ মালিকপক্ষ। এ ক্ষেত্রে ২০১০ সালে সোমালীয় দস্যুদের হাতে পণবন্দী হওয়া একই মালিকপক্ষের জাহাজ জাহানমনি ও এর ২৫ নাবিকসহ ২৬ জনকে উদ্ধারের অভিজ্ঞতার আলোকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নাবিকদের মুক্তি ও জাহাজ উদ্ধারের বিষয়ে জলদস্যুদের সাথে দফায় দফায় দরকষাকষি চলছে। একটা সম্মতিতে পৌঁছার পর আনুষ্ঠানিক আলোচনা হতে পারে বলে সূত্র জানায়। জাহাজ মালিকপক্ষের পক্ষ থেকে রমজানের ঈদের আগেই নাবিকদের মুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা চালিয়ে নেয়া হচ্ছে।
ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশী এই জাহাজ ও এর নাবিকরা সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে পণবন্দী হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীর তৎপরতা নানা আলোচনায় আসে। একপর্যায়ে গত ১৪ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্সের আটলান্টা অপারেশন জাহাজ ও পণবন্দীদের উদ্ধারে সামরিক অভিযানের প্রস্তাব দিলে বাংলাদেশ তাতে সম্মতি দেয়নি। জাহাজটির মালিকপক্ষও আলোচনার মাধ্যমে নাবিকদের নিরাপদে উদ্ধারের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ ইউ নেভাল ফোর্স আটলান্টা পণবন্দী জাহাজের অদূরে তাদের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের স্থিরচিত্র ও ভিডিও এক্স বার্তায় শেয়ার করে। কিন্তু ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অন ল অব দ্য সি (আনক্লজ নামে পরিচিত) অনুসারে যেকোনো উপকূলীয় রাষ্ট্রের উপকূল রেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) বা ২২.২২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত সাগরের তলদেশ (সি বেড), একই দূরত্বের আকাশ ও সাবসয়েলের ওপর ওই রাষ্ট্রের একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব থাকবে। এ ছাড়া আরো ১২ নটিক্যাল মাইল সন্নিহিত এলাকাসহ (কন্টিজিয়াস জোন) মোট ২৪ নটিক্যাল মাইলের ওপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব থাকে। কোনো সার্বভৌম এলাকায় কোনো অভিযান চালাতে হলে সেই রাষ্ট্রের অনুমতি যেমনি নিতে হবে, একই সাথে আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী জাহাজটির পতাকা রাষ্ট্রের (ফ্ল্যাগ স্টেট)ও অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু যেকোনো ধরনের সামরিক অভিযানে নাবিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে সেই বিবেচনায় কোনো সামরিক অভিযানে বাংলাদেশ সম্মতি দেয়নি। তবে জাহাজটির অদূরে ইউ নেভাল ফোর্সের যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েনের ফলে এবং যেখানে জাহাজটি নোঙর করে রাখা আছে সেখানকার স্থানীয় পুলিশ দস্যুবিরোধী অভিযান পরিচালনার ফলে পণবন্দী উদ্ধারে গতি আনবে, দস্যুদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করবে- এমনটিই বলে আসছিলেন মেরিটাইম বিশেষজ্ঞরা।

মেরিটাইম বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথমত টেরিটরিয়াল সির ১২ নটিক্যাল মাইল এবং কন্টিজিয়াস জোনসহ ২৪ নটিক্যাল মাইল এলাকায় উপকূলীয় রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া কোনো যুদ্ধজাহাজ সেখানে প্রবেশের সুযোগ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে আটলান্টা অপারেশন জাহাজটির অদূরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে দু’টি বার্তা দিচ্ছে। একটি হচ্ছে দস্যুদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা যে আমরা আছি, তোমরা চাইলেই যা খুশি করতে পারবা না। এতে পণবন্দী সমস্যার দ্রুত সমাধানে দস্যুদের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া নতুন করে দস্যুরা যাতে কোনো ফিশিং ট্রলার নিয়ে পাইরেসি তৎপরতা চালাতে না পারে।
এ দিকে জাহাজে খাদ্য ও পানীয় ফুরিয়ে এসেছে বলে জানা গেছে। তবে দস্যুরা খাবারের জোগান দিলেও সুপেয় পানির জোগান দিতে পারছে না বলে জানা গেছে। জাহাজ মালিকপক্ষ ও নাবিকদের কয়েকজন স্বজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে কয়েক দফায় নাবিকদেরকে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলতে দেয় জলদস্যুরা। ওই কথাবার্তায় জাহাজে খাবার ফুরিয়ে আসায় দস্যুরা ছাগল ও দুম্বা সরবরাহ করার তথ্য মিলেছে। তবে দস্যুরা সুপেয় পানির জোগান দিতে না পারায় নাবিকদের পানির ব্যবহার সীমিত করে দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নাবিকরা এখন সপ্তাহে মাত্র দুই দিন এক ঘণ্টা করে সুপেয় পানি ব্যবহার করতে পারছেন।
এ দিকে এমভি আবদুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিংয়ের মাদার অর্গানাইজেশন কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো পণবন্দী নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা। আমরা সে লক্ষ্যে কাজ করছি। দস্যুদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। তবে এখনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। আমাদের চেষ্টা হলো যত দ্রুত সম্ভব নাবিকদের ফিরিয়ে আনা। ঈদের আগেই তাদের ফেরানো যায় কি না আমরা সে চেষ্টা করছি।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ প্রায় ৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই করে মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে ২৩ নাবিকসহ নিজেদের জিম্মায় নেয় সোমালীয় জলদস্যুরা। সে সময় জাহাজটি ২৫ দিনের খাবার এবং ২০০ টন সুপেয় পানির মজুদ ছিল। জাহাজটি কয়েক দফায় স্থান পরিবর্তন করে এখন সোমালিয়ার গদভজিরান অঞ্চলের জিফল উপকূলের কাছে নোঙর করা আছে। এর আগে একই গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহানমনি ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে পণবন্দী হয়েছিল ২৫ নাবিক ও চিফ ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীসহ। সে সময় প্রায় ১০০ দিনের দরকষাকষিতে নাবিক ও জাহাজটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল কবির গ্রুপ।


আরো সংবাদ



premium cement