২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


গাজায় ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দিতে ইসরাইলকে আইসিজের নির্দেশ

-

- গাজায় আরো এক সাংবাদিক নিহত, মোট ১৩৭
- ফিলিস্তিনি শনাক্তে গুগল ফটোস ব্যবহার ইসরাইলি বাহিনীর
- যুদ্ধবিরতির আলোচনা শেষ ছাড়া রাফাতে অভিযান স্থগিত থাকবে

আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) সর্বসম্মতভাবে ইসরাইলকে দুর্ভিক্ষ এড়াতে ফিলিস্তিনের ছিটমহল গাজায় বাধাহীন ত্রাণ প্রবাহ সক্রিয় করার নির্দেশ দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ এ আদালত বলেছে, ইসরাইলকে অবশ্যই ‘অবিলম্বে জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক পরিষেবা ও মানবিক সহায়তার বিধান’ অনুমোদন করতে হবে। গাজায় কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যেতে পারে পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করার পর আইসিজের এমন আদেশ এলো। বিবিসি, আলজাজিরা, সিনহুয়া, ভয়েস অব আমেরিকা ও নিউ ইয়র্ক টাইমস।

তারা গাজায় ত্রাণ প্রবেশ আটকে দিচ্ছে, এমন অভিযোগগুলোকে ‘পুরোপুরি ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছে ইসরাইল। গাজায় গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানুয়ারিতে ইসরাইলকে আদেশ দিয়েছিল দ্যা হেগের এই আন্তর্জাতিক আদালত। আদালতের কাছে এ আদেশকে আরো জোরদার করার আর্জি জানিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তার পরই সর্বশেষ এ আদেশ জারি করেছে আইসিজে।
আইসিজের আদেশ মানায় আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করার কোনো ক্ষমতা এ আদালতের নেই। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও অন্যদের মাধ্যমে পরিচালিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ গত সপ্তাহে সতর্ক করে বলেছে, গাজায় একটি ‘বিপর্যয়কর’ পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার সবাই ‘উচ্চ মাত্রার তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন’ আর মে মাস শেষ হওয়ার আগেই ভূখণ্ডটির উত্তরাংশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যাবে বলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

আদেশে আইসিজে বলেছে, গাজা ‘এখন আর শুধু দুর্ভিক্ষের ঝুঁকির সম্মুখীন না’ বরং ‘দুর্ভিক্ষ জেঁকে বসছে’ আর জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য অনুযায়ী অপুষ্টি ও পানি শূন্যতায় ভুগে ইতোমধ্যে ২৭ শিশুসহ ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনরা ভলকার তুর্ক গত সপ্তাহে বলেছিলেন, ‘গাজায় ক্ষুধা, অনাহার ও দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি মানবিক ত্রাণ ও বাণিজ্যিক পণ্য প্রবেশের বিষয়ে ইসরাইলের ব্যাপক বিধিনিষেধ, জনসংখ্যার অধিকাংশের বাস্তুচ্যুতি আর এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করার ফল।’
আন্তর্জাতিক আদালত তুর্কের এসব মন্তব্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। আদালত বলেছে, ‘ইসরাইলকে অবশ্যই জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজনীয় মৌলিক পরিষেবাগুলো ও মানবিক ত্রাণ সহায়তার বাধাহীন প্রবাহ নিশ্চিত করতে অবিলম্বে জাতিসঙ্ঘের সাথে পূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর সব পদক্ষেপ নিতে হবে।’ যেসব সহায়তা সবচেয়ে বেশি দরকার তার মধ্যে খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, আশ্রয় ও পোশাকের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি পণ্য ও ওষুধ আছে বলে জানিয়েছে আইসিজে। রায়ে আরো বলা হয়েছে, ‘ইসরাইলকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে তাদের সামরিক বাহিনী গণহত্যা ঘোষণার অধীনে গাজায় ফিলিস্তিনিদের কোনো অধিকার লঙ্ঘন করে এমন কোনো কাজ করবে না।’

নিহত সাংবাদিক ১৩৭ :
অবরুদ্ধ গাজার আল শিফা হাসপাতালের কাছে ইসরাইলি হামলায় সাংবাদিক মোহাম্মদ আবু শাকিল নিহত হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার তার নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩৭ জন। আলজাজিরার আরব প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আল শিফা হাসপাতালের কাছে শাকিলকে গুলি করে হত্যা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। স্থানীয় রেডিও আল কুদস-এ কাজ করতেন তিনি।
গাজা কর্তৃপক্ষের মিডিয়া কার্যালয়ের তথ্য বলছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সাথে ইসরাইলের চলমান সঙ্ঘাতে এ পর্যন্ত ১৩৭ সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আলজাজিরা আরবির ক্যামেরাম্যান সামের আবুদাকাও রয়েছেন। এ ছাড়া এ সময় ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় ৫০টির বেশি মিডিয়া কার্যালয় সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।

নিহত আরো অর্ধশতাধিক :
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বর্বর হামলায় বৃহস্পতিবার থেকে ২৪ ঘণ্টায় আরো ৭১ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১১২ জন আহত হয়েছেন। এতে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা পৌঁছেছে ৩২ হাজার ৬২৩ জনে। এ ছাড়া গত অক্টোবর থেকে চলা এ হামলায় আহত হয়েছেন আরো ৭৫ হাজার ৯২ ফিলিস্তিনি। গতকাল শুক্রবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিবৃতিতে এসব তথ্য জানা গেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৭১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আরো ১১২ জন আহত হয়েছেন।

রাফাতে অভিযান স্থগিত :
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজার রাফায় স্থল অভিযানের পরিকল্পনা স্থগিত করেছে ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এটি স্থগিত করা হয়েছে বলে মার্কিন রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ভয়েস অব আমেরিকার খবরে জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা জন কিরবি বলেন, বাইডেন প্রশাসনের আশা, এ বৈঠক শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্তত রাফাতে কোনো হামলা হবে না। তিনি বলেন, এ আলোচনার তারিখ ধার্য হয়নি।

রাফাতে প্রবেশের প্রস্তুতি :
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ঘনবসতিপূর্ণ রাফা শহরে ইসরাইলের সেনাবাহিনী ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হাতে বন্দী ইসরাইলি সেনাদের মুক্ত করা প্রসঙ্গে তাদের স্বজনদের এ কথা জানান নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ‘একমাত্র সামরিক চাপই তাদের মুক্তি নিশ্চিত করবে।’ এক বিবৃতিতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চল ও খান ইউনিস জয় করেছি। এবার দক্ষিণের রাফায় স্থল অভিযান শুরু হচ্ছে।’ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) অভিযোগ করেছে, গাজায় সামরিক অভিযান চালানোর মাধ্যমে সেখানে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে ইসরাইল। পাশাপাশি দু’টি নতুন পদক্ষেপ নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের এ সর্বোচ্চ আদালত।

ফিলিস্তিনি শনাক্তে গুগল ফটোস :
হামাসের সাথে সম্পৃক্ত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের শনাক্ত করতে একটি পরীক্ষামূলক ফেইশল রিকগনিশন পদ্ধতি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর বিরুদ্ধে। মার্কিন দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে গুগল ফটোস। তবে কোম্পানিটির সাথে সরাসরি কাজ করার কোনো নজির মেলেনি এতে।
নজরদারি প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল গাজায় ইসরাইলের বন্দী নাগরিকদের খোঁজার উপায় হিসেবে। তবে এটি শিগগিরই রূপ নেয় ‘হামাস বা অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ততা আছে, এমন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ হিসেবে’, সাধারণত বিভিন্ন নতুন যুদ্ধভিত্তিক প্রকল্পে যেমনটি ঘটে থাকে। এ প্রযুক্তি ত্রুটিপূর্ণ হলেও সিস্টেমটির ফ্ল্যাগ করা নাগরিকদের আটক করার ক্ষেত্রে ইসরাইলের সৈন্যরা সে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি বলে লিখেছে প্রযুক্তিবিষয়ক সাইট এনগ্যাজেট।
টাইমসের সাথে কথা বলা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, প্রকল্পটিতে ইসরাইলভিত্তিক কোম্পানি ‘কোরসাইট’-এর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যার সদর দফতর ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবে অবস্থিত। কোম্পানিটির দাবি, ছবিতে চেহারার অর্ধেকের কম অংশ থাকলেও তাদের নজরদারি ব্যবস্থা নির্ভুলভাবে মানুষ শনাক্ত করতে পারে। এমনকি ‘খুবই দুর্বোধ্য অ্যাংগেল (এমনকি ড্রোন থেকে), অন্ধকারাচ্ছান্ন ও বাজে রেজুলিউশন থাকা ছবির’ ক্ষেত্রেও এটি কার্যকরী।
তবে ইসরাইল সামরিক বাহিনীর ‘ইউনিট ৮২০০’র এক কর্মকর্তার দাবি, বাস্তবে এটি অস্পষ্ট, বিকৃত বা ক্ষতের চেহারাওয়ালা ছবি শনাক্তে বাধার মুখে পড়েছে এ প্রযুক্তি। তিনি আরও যোগ করেন, কোরসাইটের প্রযুক্তিকে বিভিন্ন ভুল ব্যক্তি ও ঘটনাও শনাক্ত করতে দেখা গেছে, যেখানে একজন ফিলিস্তিনি নাগরিকের হামাসের সাথে সম্পৃক্ততা নিয়েও ভুল তথ্য দেখা গেছে।


আরো সংবাদ



premium cement