২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


পণবন্দী বাংলাদেশী জাহাজের অদূরে ইইউ নেভাল ফোর্সের যুদ্ধজাহাজ

সঙ্কটের দ্রুত সুরাহায় দস্যুদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়াবে?
এম ভি আবদুল্লাহর (ইনসেটে) অদূরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন : ইন্টারনেট -


সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে পণবন্দী বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর অদূরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্সের যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের একটি ভিডিও ও তিনটি স্থিরচিত্র প্রকাশ করেছে আটলান্টা অপারেশন। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১৮মিনিটে ইইউ নেভাল ফোর্স আটলান্টার এক্স বার্তায় এসব ছবি ও ভিডিওচিত্র প্রকাশ করা হয়। উপরে লেখা আটলান্টা ওয়ারশিপ এনগেজড ইন দ্য এরিয়া। বাংলাদেশী বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ দস্যুদের হাতে পণবন্দী হওয়ার ৯ দিনের মাথায় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে মালিকপক্ষের সাথে দস্যুদের যোগাযোগ শুরুর পরদিনই এমন তথ্য সামনে এলো। শিপিং সংশ্লিষ্টরা এতে দস্যুদের ওপর চাপ বাড়বে এবং সঙ্কটের সুরাহা দ্রুত হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
ইইউ নেভাল ফোর্সের আটলান্টা অপারেশনের এক্সে প্রকাশ করা ভিডিও ও স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অপারেশন আটলান্টার মোতায়েন করা যুদ্ধজাহাজটি এমভি আবদুল্লাহর অদূরে অবস্থান করছে। যুদ্ধজাহাজটি থেকে নেভাল ফোর্সের দু’জন সদস্য পণবন্দী জাহাজটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে দেখা গেছে। আরেকটি ছবিতে দেখা যায় নেভাল ফোর্সের একটি হেলিকপ্টার পণবন্দী বাংলাদেশী জাহাজের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ভিডিওচিত্রে হেলিকপ্টারটি চক্কর দিতে দেখা যায়। তবে মেরিটাইম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণবন্দী জাহাজটি একেবারের দস্যুদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। এ ছাড়া কেউ কেউ নেভাল ফোর্সের ছবিতে দেখানো জাহাজটি আদৌ বাংলাদেশী জাহাজ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে। তবে সোমালীয় উপকূলে রাষ্ট্রের সার্বভৌম এলাকা এবং কন্টিজিয়াস জোনের বাইরে এই যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন থাকার ব্যাপারে সবাই একমত।

এসব ছবি ও ভিডিওচিত্রের সাথে দেয়া বার্তায় ইউনেভাল ফোর্স আটলান্টা উল্লেখ করেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর হতে তাদের অপারেশন এলাকায় বেশ কিছু পাইরেসি সংশ্লিষ্ট ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনটি বাণিজ্যিক জাহাজ আক্রান্ত হয় এবং একটি এখনো দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে- সেটি এমভি আবদুল্লাহ বলে উল্লেখ করা হয় এক্স বার্তায়।
ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অন ল অব দ্য সি (আনক্লজ নামে পরিচিত) অনুসারে যেকোনো উপকূলীয় রাষ্ট্রের উপকূল রেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল (১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) বা ২২.২২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত সি বেড, একই দূরত্বের আকাশ ও সাবসয়েলের ওপর ওই রাষ্ট্রের একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব থাকবে। কাজেই কোনো সার্বভৌম এলাকায় কোনো অভিযান চালাতে হলে সেই রাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হবে। একই সাথে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী জাহাজটির পতাকা রাষ্ট্রের (ফ্ল্যাগ স্টেট)ও অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু যেকোনো ধরনের অভিযানে নাবিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে সেই বিবেচনায় কোনো সামরিক অভিযানে বাংলাদেশ সম্মতি দেয়নি। জাহাজটির মালিকপক্ষও আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নাবিকদের ফেরাতে চায়।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএমএমএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রথমত টেরিটরিয়াল সি’র ১২ নটিক্যাল মাইল এবং কন্টিজিয়াস জোনের ২৪ নটিক্যাল মাইল এলাকায় উপকূলীয় রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া কোনো যুদ্ধজাহাজ সেখানে প্রবেশের সুযোগ নেই। যে স্থিরচিত্রগুলো দেখা হচ্ছে তা অবশ্যই ওই নির্দিষ্ট সীমানার বাইরের। তবে এ ক্ষেত্রে আটলান্টা অপারেশন দু’টি বার্তা দিচ্ছে। একটি হচ্ছে দস্যুদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করা যে আমরা আছি, তোমরা চাইলেই যা খুশি করতে পারবা না। এতে পণবন্দী সমস্যার দ্রুত সমাধানে দস্যুদের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করবে। এ ছাড়া নতুন করে দস্যুরা যাতে কোনো ফিশিং ট্রলার নিয়ে পাইরেসি তৎপরতা চালাতে না পারে। ইইউ নেভাল ফোর্স যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করলেও পতাকা রাষ্ট্র বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া বাংলাদেশী জাহাজে অভিযান চালানোর সুযোগ নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে পণবন্দী জাহাজ মুক্ত করতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজার কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, সাগরের মাঝখানে হয়তো দস্যুরা দুর্বল, কিন্তু উপকূলে তারা অনেক শক্তিশালী। তাই সেখানে অভিযান চালালে জাহাজ ও নাবিকদের ব্যাপক ডেমেজ হতে পারে। জাহাজে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ কার্গোর কথাও মাথায় রাখতে হবে। ইতোপূর্বে গত ১৪ মার্চ ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৌবাহিনী অপারেশন আটলান্টা এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার তাতে সম্মতি দেয়নি বলে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনায় জানান।
এ দিকে এমভি আবদুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মাদার অর্গানাইজেশন কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম গতকাল বিকেলে এ প্রতিবেদককে বলেন, যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নিজস্ব ব্যাপার। সে বিষয়ে আমরা অবগত নই। তবে নাবিকদের জীবন বিপন্ন হতে পারে, এমন কোনো সামরিক পদক্ষেপকে আমাদের কোম্পানি সমর্থন করে না। কাজেই আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো পণবন্দী নাবিকদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনা। আমরা আলোচনার মাধ্যমে এই সঙ্কটের সুরাহা করতে চাই।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ প্রায় ৮০ কোটি টাকা মূল্যের ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা বোঝাই করে মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে ২৩ নাবিকসহ নিজেদের জিম্মায় নেয় সোমালিয়ার জলদস্যুরা। জাহাজটি কয়েক দফায় স্থান পরিবর্তন করে এখন সোমালিয়ার গদভজিরান উপকূলের কাছে নোঙর করা আছে। ইতোমধ্যে দস্যুরা তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে জাহাজ মালিকপক্ষের সাথে যোগাযোগও স্থাপন করেছে। ইতোপূর্বে একই গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি জাহান মনি ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে পণবন্দী হয়েছিল ২৫ নাবিক ও চিফ ইঞ্জিনিয়ারের স্ত্রীসহ। সে সময় প্রায় ১০০ দিনের দরকষাকষিতে পণবন্দী নাবিক ও জাহাজটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেছিল কবির গ্রুপ।

এমভি আবদুল্লাহর কাছাকাছি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি কোনো সুবিধা দেবে?
বিবিসি জানায়, ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের হাতে পণবন্দী এমভি আবদুল্লাহকে নজরদারিতে রাখতে ইউরোপিয়ান যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের খবরে কোনো উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে বাংলাদেশী গণমাধ্যমগুলো। অভিযান পরিচালনা না হলেও যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন পরিস্থিতি উত্তরণে প্রভাব রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ দিকে ইইউ নেভাল ফোর্সের তরফেও কেবল অবস্থান নেয়ার কথাই জানানো হয়েছে, অভিযানের বিষয়ে কোনো কিছু জানায়নি তারা।
জাহাজের মালিকপক্ষ বলেছে, কোনো অবস্থাতেই তারা সশস্ত্র অভিযানের পক্ষে নন। তবে ওই উপকূলে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন এই পরিস্থিতিতে কিছু ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী।

এমন অবস্থান পণবন্দী মুক্তিতে প্রভাব রাখতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে জানান তিনি। প্রথমত, এত কাছে ইউরোপিয়ান বাহিনীর মতো শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতি দস্যুদের ওপর একটা চাপ তৈরি করবে। যা সমঝোতার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে বলে মনে করেন তিনি। দ্বিতীয়ত, পূর্ব আফ্রিকার ওই উপকূল থেকে নতুন কোনো দস্যুদল সাগরে প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে দস্যুদের তৎপরতা কমে আসবে। গত দু’দিনে আরো দু’টি সম্ভাব্য দস্যুতার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে ‘ইউ ন্যাভ ফর’। দু’টি জাহাজই লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী। এ নিয়ে গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে গতকাল ২১ মার্চ পর্যন্ত ২৪টি জাহাজ এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি। যার মধ্যে ১২টিকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
নাবিকদের সর্বশেষ অবস্থা : বুধবার সাহরির পরপর ছেলের ফোন পান শাহনুর বেগম। তার ছেলে এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান।
বিবিসি বাংলাকে শাহনুর বেগম জানালেন, কতটা দুঃসহ দিন পার করছেন তার ছেলেসহ অন্য নাবিকরা।
‘ঠিকমতো পানি দেয় না, খাবার দেয় না। হয়তো একবেলা ইফতার করল, আরেক বেলা খাবার নেই।’

ডাকাতরা ৯-১০ দিনে প্রায় সব খাবার শেষ করে ফেলেছে বলে ছেলের কাছে শুনেছেন তিনি।
জিম্মি থাকা ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খানের সাথে তার বড় ভাই ওমর ফারুকের সর্বশেষ কথা হয় এই সপ্তাহের শুরুতে। তিনি মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে জানান, জলদস্যুরা প্রতিদিন খাবার নষ্ট করছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই বড় সঙ্কটে পড়তে হবে তাদের।
তার ওপর, দস্যুদের সংস্পর্শ এবং অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকতে হচ্ছে বলে অ্যালার্জি সমস্যা দেখা দিয়েছে।
দস্যুদের সাথে আলোচনা : দ্রুত নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে চায় জাহাজের মালিক পক্ষও। কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, জলদস্যুরা যোগাযোগের পর প্রাথমিক পর্যায়ের আলাপ শুরু করেছেন তারা। আনুষ্ঠানিক আলোচনা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
‘আমরা কোনোভাবেই সশস্ত্র অভিযানের পক্ষে নই। নাবিকদের জীবন সংশয়ে পড়বে এমন কোনো কিছুর প্রতি আমাদের সমর্থন নাই,’ যোগ করেন তিনি। তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেও আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে একই বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক নৌবাহিনীগুলোর তৎপরতা
এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর থেকে সোমালিয়া উপকূলে প্রবেশের আগ পর্যন্ত অনুসরণ করে আসছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধ জাহাজ। ভারতীয় নৌবাহিনীর এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে চারজন অস্ত্রসহ টহল দিচ্ছে। তাদের সবার অবস্থানই ছিল জাহাজের মাস্টার কেবিনের ছাদে।
ভারতীয় নৌবাহিনী জানায়, গত ১২ মার্চ এমভি আবদুল্লাহ থেকে সাহায্যের সিগন্যাল পেয়ে তারা একটি মেরিটাইম পেট্রোল এয়ারক্র্যাফট-এলআরএমপি পাঠিয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় বিমানটি পরে আর এমভি আবদুল্লাহর সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারেনি। পরে ভারতীয় নৌবাহিনী একটি যুদ্ধ জাহাজ মোতায়েন করে। এই জাহাজটি পরের কয়েকদিন এমভি আবদুল্লাহকে নজরদারি করে।

 


আরো সংবাদ



premium cement