২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফের বাড়ছে নদীর পানি বানভাসিরা আতঙ্কে

৭ জেলায় ৯ নদীর পানি বিপদসীমার উপরে : এ পর্যন্ত ৯২ মৃত্যু
-

উজানে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে, পাশাপাশি দেশেও বৃষ্টি বেড়েছে। এতে আবারো বাড়তে শুরু করেছে দেশের অনেক নদ-নদীর পানি। গত চার-পাঁচ দিনে বন্যার পানি নামতে শুরু করায় পানিবন্দী অনেকেই ঘরে ফেরার যে আশা করছিলেন তা পুনরায় শঙ্কার মধ্যে পড়ল। বন্যাকবলিত মানুষ এখন আবারো বিপদের মুখে। এর মধ্যে গতকাল দেশের সাত জেলায় ৯ নদীর ১০ পয়েন্টের পানি বিপদসীমার উপরে ছিল। কয়েকদিন আগে সাত পয়েন্টের পানি বিপদসীমার উপরে ছিল। এ দিকে চলমান বন্যায় দেশে ৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এ দিকে আবহাওয়া অধিদফতরের আগামী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়, রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী, ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারির বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, গতকাল বিকেলের পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে সুনামগঞ্জে ১৮৫ মিলিমিটার। এ ছাড়া সিলেটের ছাতকে ১০০, জাফলংয়ে ৯৩, কানাইঘাটে এবং সুনামগঞ্জের লরেরগড়ে ৮৫, সিলেটের শেওলা ও দক্ষিণবাগে ৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়। এ দিকে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১২১ এবং জলপাইগুড়িতে ৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং ভারতের আসাম, মেঘালয় ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি সিকিমসহ বিভিন্ন স্থানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এর ফলে ওই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী-নদী যেমন, তিস্তা, আত্রাই, ধরলা, দুধকুমার, করতোয়া, টাঙ্গন, পুনর্ভবা ও কুলিখ নদীর পানি সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে, ধরলা নদীর কুড়িগ্রাম পয়েন্টে এবং দুধকুমারের পাটেশ্বরী পয়েন্টে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে। এ দিকে দেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।
সারা দেশে ৯২ জনের মৃত্যু : সারা দেশে চলমান বন্যায় ৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সিলেটেই মারা গেছেন ৫৫ জন এবং ৩১ জন ময়মনসিংহ বিভাগে। গত ১৭ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত তাদের মৃত্যু হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো বন্যাবিষয়ক এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বন্যার কারণে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৪৯৬ জন। এর মধ্যে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছয় হাজার ১৫২ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, উল্লেখিত সময়ে মৃতদের মধ্যে সিলেট জেলায় ১৮ জন, সুনামগঞ্জে ২৭ জন, হবিগঞ্জে পাঁচজন, মৌলভীবাজারে পাঁচজন, ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইলে একজন, ময়মনসিংহে পাঁচজন, নেত্রকোনায় ১০ জন, জামালপুরে ৯ জন, শেরপুরে সাতজন, কুড়িগ্রামে তিনজন এবং লালমনিরহাটে একজন রয়েছেন।
সিলেটে থেমে থেমে বৃষ্টি
সিলেট ব্যুরো জানায়, বন্যার পানি থাকার মধ্যেই আবারো ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ায় সিলেটের বানভাসি মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পাঁচ দিন টানা রোদের পর গত দুই দিন থেকে কখনো মুষলধারে, আবার কখনো থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে দেখা মেলেনি সূর্যের। তবে চলতি সপ্তাহে হালকা ও ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস থাকলেও বড় ধরনের বন্যা হওয়ার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তারা বলছে, বৃষ্টির কারণে সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি কিছুটা বেড়েছে। এ নদীর কানাইঘাট পয়েন্ট এবং কুশিয়ারা নদীতে এর প্রভাব না পড়লেও সারি নদী ও ধলাই নদের পানি বেড়েছে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পানি ছিল ১০ দশমিক ৭৪ সেন্টিমিটার। সেখানে গতকাল সকাল ৯টায় পানি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ সেন্টিমিটার। সারি নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বুধবার ১১ দশমিক ৩৬ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হলেও বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সে পয়েন্টে ১১ দশমিক ৪৯ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ধলাই নদের ইসলামপুর পয়েন্টে বুধবার সন্ধ্যায় ১০ দশমিক শূন্য ৬ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হলেও গতকাল সকালে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে ১০ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বুধবারের তুলনায় গতকাল সকাল ৯টায় পানি দশমিক শূন্য ৮ সেন্টিমিটার কমে ১৩ দশমিক ৫১ সেন্টিমিটার হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে পানি বুধবারের তুলনায় দশমিক ১২ সেন্টিমিটার কমে ১৬ দশমিক ৩৯ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর কাজীর পয়েন্ট এলাকায় আবারো উঠেছে বন্যার পানি।
এ দিকে গতকাল সকালে নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। নগরের মির্জাজাঙ্গাল, তালতলা, যতরপুর, শাহজালাল উপশহর এলাকায় পানি জমতে দেখা গেছে। এ ছাড়া দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর সড়কে জলাবদ্ধতা রয়েছে।
সিলেট পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও এর ফলে বন্যার কোনো পূর্বাভাস নেই। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্যে এমনটি জানা গেছে। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী বৃষ্টি হয়ে অবস্থার উন্নতি হবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: মজিবর রহমান জানান, জেলায় বন্যায় চার লাখ ১৬ হাজার ৯৬৬টি পরিবারের ২১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৬৫ জন মানুষ বন্যাক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩০ হাজার ৯৪০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জে ফের পানিবন্দী মানুষ
সুনামগঞ্জ ও ছাতক সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জে আবারো মুষলধারের বৃষ্টিতে বাড়ছে সুরমা নদীর পানি। জেলার ছাতক পয়েন্টে এই নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ছিল বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপরে। কিন্তু এরপর তা বেড়ে দাঁড়ায় বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ১৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এ দিকে বন্যার পানি ধীর গতিতে কমায় এখনো অনেকের ঘরবাড়ি থেকে পানি নামেনি। ফলে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে পারেনি। এরমধ্যে বুধবার থেকে আবারো পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিচু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন নদীর তীর ও নিচু এলাকার লোকজন।
অন্য দিকে জেলার ছাতকে তৃতীয়বারের মতো বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলার একটি পৌর এলাকা ও ১৩টি ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, হাটবাজার, বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে হাজার হাজার মানুষ। গতকাল দুপুর পর্যন্ত সুরমার পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। পরপর দু’টি ভয়াবহ বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি বন্যা আসার কারণে উপজেলার লাখো বানভাসি মানুষ গবাদিপশু নিয়ে পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বন্যাদুর্গত এলাকায় ফের বিশুদ্ধ পানিসঙ্কট দেখা দিয়েছে। এসব বন্যাদুর্গত এলাকায় সরকারি-বেসরকারি সংগঠনসহ ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। তবুও চাহিদা মিটছে না ত্রাণের। কোনো স্থানে ত্রাণ বিতরণের খবর পেলেই ওই স্থানে শত শত মানুষ ভিড় করছে।
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বাড়ছে
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নামা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি আবার বাড়তে শুরু করেছে। তবে বন্যার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। টানা কয়েকদিন এই নদীর পানি কমছিল; বুধবার থেকে ফের বাড়তে শুরু করেছে।
পাউবো জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ শহরের হার্ডপয়েন্ট এলাকায় যমুনার পানি ২০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮০ সেন্টিমিটার এবং কাজিপুর পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৭০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, টানা এক সপ্তাহ যমুনার নদীর পানি কমার পর বুধবার থেকে আবার বাড়তে শুরু করেছে। আরো দুই-তিন দিন পানি বাড়বে।


আরো সংবাদ



premium cement