২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মালিকপক্ষকে বাদ দিয়ে মামলা

ডিপোতে আরো দুই লাশ উদ্ধার, চমেকে মৃত্যু ১
-

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনার তিন দিন পর মালিক পক্ষকে বাদ দিয়ে আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। গত মঙ্গলবার রাতে সীতাকুণ্ড থানার এসআই আশরাফ সিদ্দিকী বাদি হয়ে মামলাটি রুজু করেন। মামলায় ডিপো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছে। এ দিকে ঘটনার প্রায় ৮৬ ঘণ্টা পর আগুন নেভার তথ্য জানিয়ে কনটেইনার সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। তবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে বিভিন্ন কনটেইনার থেকে। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরো একজন মারা গেছেন। এ ছাড়া গতকাল সন্ধ্যার দিকে ডিপোটির ধ্বংসাবশেষ থেকে কনটেইনার সরানোর সময় দুইজনের লাশ উদ্ধারের তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৬ জনে।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় আটজনকে আসামি করে মামলা রুজু হয়েছে। মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪/ ৩৩৭/ ৩৩৮ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
আসামিরা হলেনÑ বিএম কনটেইনার ডিপো লিমিটেডের জিএম নাজমুল আক্তার খান, ডিজিএম নুরুল আক্তার, ম্যানেজার অ্যাডমিন খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুল আজিজ, কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ও নজরুল ইসলাম। যদিও মালিক পক্ষের কাউকে আসামি করা হয়নি।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত কারণ উল্লেখ করে পুলিশের পক্ষ থেকে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে তিনি জানান।
এ দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম জানিয়েছেন, ডিপোতে অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির অভিযোগ আনা হয়েছে মামলায়। সেখানে আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরো অনেককে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় ডিপোর কর্মকর্তারা থাকলেও প্রাথমিকভাবে মালিক পক্ষের কাউকে রাখা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত চলছে, তদন্তে যদি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়, মালিকদেরও আসামি করা হবে।
এ দিকে গতকাল বুধবার ধ্বংসস্তূপ থেকে কনটেইনার সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১৮-বীর এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আমরা সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছি নিরাপত্তার বিষয়টি। তাই সব কিছু নিশ্চিত হওয়ার পরই আমরা অপসারণ কাজ শুরু করি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭০ শতাংশ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হই। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও এখনো ধোঁয়া উড়ছে। কনটেইনার সরানোর কাজ চলছে।
সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপো থেকে বুধবার দু’জনের দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে একজনের মাথার খুলি এবং এক ব্যক্তির পায়ের অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়। পরে সেগুলো দু’টি আলাদা প্যাকেটে ভরে অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এ নিয়ে সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৬ জনে।
চমেকে দগ্ধ আরো একজনের মৃত্যু : এ দিকে ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মাসুদ রানা নামের ৩৭ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি ডিপোতে কনটেইনার ওঠানামার কাজ করতেন। তার বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলায়। হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বুধবার ভোর পৌনে ৪টার দিকে তার মৃত্যু হয় বলে মেডিক্যাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার নিশ্চিত করেন।
ওই ঘটনায় রোববার পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ৯ কর্মীসহ ৪১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন। গত মঙ্গলবার আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে দু’জনের লাশ উদ্ধার করার কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। এর বাইরে নতুন করে মাসুদ রানার মৃত্যু হলো এবং ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে দুইজনের পুড়ে অঙ্গার হওয়া লাশ উদ্ধার হলো।
বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তিদের কেউই শঙ্কামুক্ত নন
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে যারা শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন, তারা এখনো পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নন। তবে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকে হওয়ায় ভালো হয়ে যাওয়ার আশা করা হচ্ছে। গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন প্রতিষ্ঠানটির সমন্বয়ক ডা: সামন্ত লাল সেন।
এ দিকে গতকাল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি রোগীদের দেখতে গিয়েছিলেন ডা: সামন্ত লাল সেনসহ বার্ন ইনস্টিটিউটের তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল। সেখানকার দুইজন রোগীকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলনে ডা: সামন্ত লাল সেন বলেন, এখানে চিকিৎসাধীন ১৬ জন রোগীর সাথে গত মঙ্গলবার রাতে একজন নতুন করে যুক্ত হয়েছেন। ফলে মোট ১৭ জন রোগী বর্তমানে বার্ন ইনস্টিটিউটে আছেন। চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে তিনজন আইসিইউতে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, একজন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন, সেটিও উইথড্র করা হয়েছে। আইসিইউতে থাকাদের শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো, পুরোপুরি সুস্থ নন। বাকি রোগীরাও ভালো আছেন। তবে ডিসচার্জ হওয়ার আগ পর্যন্ত সুস্থ বলা যায় না।
চোখের সমস্যা নিয়ে আরো ছয়জন রোগী জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন উল্লেখ করে ডা: সামন্ত লাল সেন বলেন, ওই ছয়জনের মধ্যে দু’জনের চোখের সমস্যার পাশাপাশি বার্ন থাকায় বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন রোগীদের শারীরিক অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল বলে জানানো হয়েছে। তবে সেখানে আইসিইউতে থাকা রোগীরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছেন।
এ সময় বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা: আবুল কালাম বলেন, যাদের চোখে সমস্যা রয়েছে, তা রিকভারেবল। চোখ লাল থাকা এবং পাতা দগ্ধ হলেও দেখতে পারছেন তারা। দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা সুস্থ হয়ে যেতে পারেন। সবধরনের চিকিৎসা চলছে।
চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেয়া দগ্ধ দু’জন হলেন, শিল্পাঞ্চল থানার কনস্টেবল ইমরুল কায়েস (২২) ও বিএম কনটেইনার ডিপোর ডেপুটি ম্যানেজার জসিম উদ্দিন (৫০)। শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা: আইউব হোসেন বলেন, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে দু’জন রোগীকে এখানে আনা হয়েছে। তাদের পা দগ্ধ হয়ছে। পাশাপাশি চোখে সমস্যা আছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ বিনিয়োগে বেসরকারি এই ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটি গড়ে তোলা হয় ২০১১ সালে। এর মালিকানায় আছেন বাংলাদেশের স্মার্ট গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান এবং তার ছোট ভাই চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুর রহমান। স্মার্ট গ্রুপের আরেক কোম্পানি আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডে উৎপাদিত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রফতানির জন্য রাখা ছিল কনটেইনার ডিপোতে। অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে ওই রাসায়নিকই দায়ী বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা।


আরো সংবাদ



premium cement