২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সেলফি নেশার মহামারী

বাড়ছে দুর্ঘটনা আতঙ্ক আর বিব্রত মানুষ
মহামারী আকার ধারণ করছে সেলফি প্রযুক্তি। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। বিতর্কিত ও বিপজ্জনক কিছু সেলফির দৃশ্য : সংগৃহীত -

মানিকগঞ্জের মাঝারি ধরনের নাম ডাকওয়ালা একনেতা সম্প্রতি মৃত্যু বরণ করেছেন, নিকটাত্মীয় ও স্বজনরা লাশ খাটিয়ায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কবর স্থানে, চার পাশে লোকজনের কান্না আর দুরুদ শরিফ পাঠের আওয়াজ। হৃদয়বিদারক আর আহাজারিতে পুরো পরিবেশটাই ভারী। এরই মাঝে ক্লিক ক্লিক...দেখা গেল, খাটিয়া বহনকারী সামনের ভদ্রলোক স্মিত হাসিতে লাশ কাঁধে নিয়ে সেলফির বীরত্বের অমর গাঁথা ধারণ করছেন; ক্লিক...ক্লিক...।
সম্প্রতি ঘিওর উপজেলায় বাল্যবিয়ের কুফল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মাদক প্রতিহতসহ সামাজিক নানা জরুরি বিষয়ে মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মিডিয়া কর্মী, সুশীলসমাজ, শিক্ষক, ইমাম, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। বাল্যবিয়ের কুফল ও মাদক প্রতিহত করণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বিষয়ক জরুরি কথাবার্তা ও মত বিনিময় চলছে। হঠাৎ আলোর ঝলকানি আর সেই চিরচেনা শব্দ ক্লিক... ক্লিক... সেলফি। সাথে সাথেই আবার তা পোস্ট করা হয় ফেসবুক টাইমলাইনে। কিছু ব্যক্তির এই সেলফিপ্রীতির কারণে ভাটা পড়ে পুরো আলোচনায়। সমালোচনাও করেন অনেকে। অনেককেই বলতে শোনা গেছে, তারা কি শুধু সেলফি তোলার জন্যই জনগুরুত্বপূর্ণ এই সমাবেশস্থলে এসেছিল?
দরিদ্র মানুষের মধ্যে সহায়তা প্রদান করতে ঢাকা থেকে এসেছেন একটি বড় রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতা। নেতার আগমনে তার পাশে দাঁড়িয়ে, বসে, জড়িয়ে ধরে শুরু হয়ে যায় সেলফি তোলার মহা হুলস্থুল কাণ্ড। সময় গড়িয়ে যায় অনেক। সাহায্য নিতে আসা দরিদ্র মানুষগুলোর ক্লিষ্ট মুখাবয়বে ভেসে বেড়ায় কেবলই দীর্ঘশ্বাস।
হালের ক্রেজ এক সঙ্গীতশিল্পী সম্প্রতি একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছেন জেলার মফস্বল এলাকায়। শিল্পী মঞ্চে ওঠা মাত্রই নিরাপত্তাকর্মীদের উপেক্ষা করে শুরু হয়ে যায় সেলফি তোলার হিড়িক। শত শত মানুষের ভিড় আর ঠেলাঠেলিতে ইলেক্ট্রিক তার ছিঁড়ে বিকল হয়ে যায় সাউন্ড সিস্টেম। ভিআইপি ওই শিল্পীও কিছুটা ভড়কে যান। বেঁধে যায় হুলস্থুল কাণ্ড। পরে বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ সঙ্গীতানুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে।
শুধু এ দুই-চারটি ঘটনাই নয়, সেলফি জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশ। সেলফি তোলা দোষ কিংবা আইন বিরুদ্ধ নয়। যুবসমাজের কাছে হয়ে উঠেছে একরকম নেশা। আনন্দ-উল্লাস আর হৈ-হুল্লোড়ে সেলফির হিড়িক কারো কারো জীবনকে করে তুলেছে বিষাদময়। আবার অনেকে সেলফির কারণে আজীবনের জন্য কেবলই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছেন পরিবারের কাছে।
নির্বাচন কেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সেলফি মাধ্যম। লাশ পাশে, উঁকি দিয়ে কবরখোদকদের সেলফি, রোগী দেখা হোক অথবা কোনো দুর্ঘটনা কিংবা অফিসে মিটিং চলাকালীন, কোরবানির পশুর সাথে, মাছ ধরে, কোথাও কিছু দান করতে গেলে সবচেয়ে আগে দরকার একটা সেলফি, পরে জিনিস দান হোক বা না হোক সেলফিটা আগে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে দিয়ে নিজের ফায়দা আদায় করতে কার্পণ্য করেন না অনেকেই। চলন্ত বাইকে, ট্রেনের ছাদে, পাহাড়ের চূড়ায়, ঝরনার পানিতে, হাঁটতে, চলতে এখন সেলফি তোলার নেশা। আর কোনো পিকনিক, ঐতিহাসিক স্থান, জনসভা, প্রাচীন স্থাপনার কাছে গেলে তো কথাই নেই, শত শত সেলফির বাহারি মেলা বসে যায়। সেলফি নেশা কখনো কখনো ডেকে আনছে ভয়াবহ বিপদ। অনেকের কাছে তাই সেলফি এখন আতঙ্ক।
বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ আজকাল স্মার্টফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেসবুকে ব্যস্ত সময় কাটান এবং এটি দিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকেন। প্রতিদিন দুই-চারটা সেলফি তোলা এখন আর ফ্যাশন নয়, রুটিন। নতুন চাকরি থেকে শুরু করে বিয়ে বাড়ি, মন খারাপ থেকে শুরু করে মন ভালো, নতুন জামা কেনা থেকে শুরু করে স্কুবা ডাইভিং সবখানেই সেলফি! শুরুতে সেলফি ব্যাপারটা মেয়েদের থাকলেও এখন ছেলেরাও পিছিয়ে নেই। কিন্তু মূলত এক ধরনের অবসেসিভ ডিসঅর্ডারের জেরেই এই সেলফি তোলেন মানুষ। এবং তা এমন পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যে, বিপজ্জনক সেলফি তোলা থেকেও বিরত হচ্ছে না মানুষ। তাতে প্রাণও যাচ্ছে, তবু হুঁশ ফেরে না। এই সেলফি তোলার প্রবণতাকে অসুস্থতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের একদল গবেষক তাদের গবেষণা শেষে প্রকাশ করেছেন, সেলফি তোলা একটি মানসিক রোগ। এ গবেষক দল সেলফিতে আক্রান্ত হওয়া রোগের নাম দিয়েছেন সেলফাইটিস।
সম্প্রতি চলন্ত মোটরসাইকেলে সেলফি তুলতে গিয়ে একসাথে প্রাণ হারিয়েছেন তিন বন্ধু। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া দীঘির পাড়ে মোটরসাইকেলে সেলফি তুলতে গিয়েই তিন বন্ধুর করুণ মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাদেরই একটি মোবাইল ফোন থেকে সেলফি উদ্ধার হয়। এতে দেখা যায় চার বন্ধু চলন্ত মোটরসাইকেলে। চারজনের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এর মিনিট খানেকের মধ্যে অন্য একটি ছোট ট্রাকের সাথে তাদের মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। অন্যজন পঙ্গু।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তানজিলা নওশিন বলেন, কোথাও গেলে সেলফি তুলে রাখি। এগুলো আসলে স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্যই করি। অন্য কিছু নয়। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সোহেল তানভীর জানান, সেলফি তুলে স্মৃতিগুলো ধারণ করি, যা অনেক, অনেক দিন পর পুরনো সেই স্মৃতিগুলো দেখার সৌভাগ্য হয়।
আপাতদৃষ্টিতে সেলফি তোলা দোষ কিংবা আইন বিরুদ্ধ নয়। তবে এই সেলফির কারণেই প্রতিদিনই ঘটছে অগণিত বড় বড় দুর্ঘটনা। কিছু কিছু অদ্ভুদ ও ভয়ঙ্কর সেলফি আপলোড করেন অনেকেই, যা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু ও বিরক্তির কারণ। আবার সেলফি শিকারিদের কবলে অনেক রাজনৈতিক নেতা, এমপি-মন্ত্রী কিংবা সেলিব্রেটিরাও মাঝে মাঝে পরে যান বিব্রতকর অবস্থায়। দেশের বড় বড় রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে সেলফি তোলা যেন দিন দিন নিয়মে পরিণত হচ্ছে। অসাধু ব্যক্তিরা। নেতাদের সাথে সেলফি হলে পরে সেই ছবি দেয়ালে সাঁটিয়ে নিজেকে ঘনিষ্ঠজন পরিচয় দিয়ে হরহামেশাই নানাবিধ অপকর্ম ও দুর্নীতি করে যাচ্ছে। আর এ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয় সেই সব নামকরা রাজনীতিবিদ, আমলা ও প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাসিনো অভিযান, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে পরিচালিত অভিযানে এমনটি লক্ষ করা গেছে। এসবের দায় নেবে কে?
নাম প্রকাশ না বরার শর্তে কলেজ পড়–য়া এক ছাত্রী জানান, কিছুদিন আগে পরিবারের সাথে এক সামাজিক দাওয়াতে যান তিনি। সেখানে খাবার খেতে বসে দেখতে পান, পাশের টেবিলে বসা তিন-চার যুবক বিভিন্ন ভঙ্গিতে তাদের সেলফি তুলছে আর হাসাহাসি করছে। আমরা ঘুনাক্ষরেও জানতাম না যে, তাদের ধারণ করা সেলফিতে আমাদেরও ছবি ধারণ করেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে বাড়ি ফেরার পথে এক বান্ধবী ফোন করে বলল যে, আমাদের ছবি নাকি ফেসবুকে আপলোড করা হয়েছে। এটা তো রীতিমতো অন্যায়, বিব্রত ও দৃষ্টিকটু।
দেশের ছোট পর্দার নাট্যজগতের অতি জনপ্রিয় অভিনেতা সোহেল খান অনেকটা আক্ষেপের সুরে বললেন, আগে নিজ এলাকায় গেলে লোকজনের সাথে বেশ সময় নিয়ে কুশল বিনিময়, বর্তমান অবস্থাসহ নানা বিষয়ে কথাবার্তা হতো। আর বছর দুই ধরে শুধু সেলফি তুলতে চায়। ৫ সেকেন্ডে সেলফি তুলে হাওয়া। আন্তরিকতার ঘাটতিতে মন খারাপ হয়ে যায় আমার।
সেলফি বিষয়ে শিল্প, সাহিত্য ও মননের কাগজ ‘মানুষ’ পত্রিকার সম্পাদক কবি শফিক সেলিম বলেন, সেলফি হলো মানুষের নিঃসঙ্গতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতার নিদর্শন। কারণ নিজের চেহারা নিজে দেখে শান্তি নেই। অপরে দেখুক, প্রশংসা করুক, লাইক দিক, কমেন্ট করুক। তবেই না শান্তি। মুঠোফোনের ভেতর নিজেকে কেন্দ্রীভূত না করে আশপাশের মানুষের দিকে চোখ মেলে তাকাতে হবে। তাহলেই সম্প্রীতি টিকে থাকবে জোরালো হয়ে।


আরো সংবাদ



premium cement