২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এক বছর পিছিয়ে গেল নতুন শিক্ষাক্রম

এক বছর পিছিয়ে গেল নতুন শিক্ষাক্রম - ছবি - সংগৃহীত

প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ আরো এক বছর পিছিয়ে গেল। এর ফলে আগামী বছরো নতুন শিক্ষাক্রমে বই পাবে না শিক্ষার্থীরা। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রমে ২০২২ সালে মাধ্যমিক স্তরের ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রমের কাজ হবে। এরপর ২০২৩ সালে গিয়ে এই দু’টি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেয়া হবে।

বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনসহ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর এবং শিক্ষা বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে, প্রাথমিকে আগামী বছর কেবল প্রথম শ্রেণীতে ১০০টি প্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষামূলক কাজ হবে এবং পরের বছর এই শ্রেণীর সব শিক্ষার্থীর হাতে বই দেয়া হবে। কিন্তু অন্যান্য শ্রেণীতে কী হবে, সেটি তারা আগামী বছর গিয়ে ঠিক করবে।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে আগামী বছর পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে কার্যক্রম চালানোর আলোচনা হয়েছে।

প্রথমে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল চলতি বছর থেকে কয়েকটি শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমে বই পাবে। কিন্তু করোনার কারণে তা এক বছর পিছিয়ে দেয়া হয়। এরপর ঘোষণা দেয়া হয়, আগামী বছর থেকে তা বাস্তবায়ন করা হবে। এর মধ্যে আগামী বছরের জানুয়ারিতে প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী; মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বই পাওয়ার কথা ছিল। আর ২০২৩ সালে অষ্টম শ্রেণী ও ২০২৪ সালে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেয়ার কথা। এরপর উচ্চমাধ্যমিকের বই দেয়ার কথা।

শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তনের কথা বলে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের এই কাজ শুরু করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কথা ছিল, এ মাসে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করে তার আলোকে জুনের মধ্যে নতুন বই লেখার কাজ শেষ করা হবে। এরপর বই ছাপিয়ে আগামী বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই দেয়া হবে। কিন্তু এপ্রিল মাস শেষ হতে চললেও এখনো শিক্ষাক্রমের রূপরেখাই অনুমোদন করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ গত নভেম্বরে রূপরেখাটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল এনসিটিবি। কিন্তু অনুমোদন না করে উল্টো কিছু দিন আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পুরনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরের বই ছাপতে এনসিটিবিকে নির্দেশ দেয়। এ অবস্থায় আগামী বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের বই দেয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে যায়। আর শেষ পর্যন্ত গতকালের সভায় বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে পিছিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

অভিযোগ উঠেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং এনসিটিবির মাধ্যমিক ও প্রাথমিক অধিশাখার কর্মকর্তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য সমন্বিতভাবে শিক্ষাক্রম তৈরির কাজ শুরু হলেও প্রাথমিকের প্রশাসন মনে করেছে, এতে তাদের মতামতকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের কর্তৃত্বও থাকছে না। এখানে বাইরের কিছু লোকের মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেভাবে শিক্ষাক্রমের খসড়া রূপরেখাটি তৈরি করা হয়েছে, তা বর্তমান বাস্তবতায় মাঠপর্যায়ে প্রাথমিকের জন্য বাস্তবায়ন করাও কঠিন। এগুলো নিয়ে প্রাথমিকের প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে না বললেও ভেতরে ভেতরে নতুন শিক্ষাক্রমের বিপক্ষে কাজ করেছেন। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কাজটি ঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারেনি। সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়েছিল। সাধারণত পাঁচ বছর পরপর শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হয়।

২০২১ সাল থেকে ধাপে ধাপে নতুন কারিকুলামে বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়ার লক্ষ্যে শ্রেণিকক্ষে পরীক্ষা নির্ভরতা কমাতে কারিকুলাম যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে আগামী ২০২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রাথমিকে ১ম, ২য় এবং মাধ্যমিকে ৬ষ্ঠ, ৭ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নতুন কারিকুলামে বই তুলে দেয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নতুন কারিকুলাম তৈরি করতে গিয়ে বিদেশী সংস্থা ও এনজিওকে বেশি প্রাধান্য, অতিমাত্রায় লার্নিং এডুকেশন (অভিজ্ঞতাভিত্তিক) করায় কারিকুলাম কমিটির ওপর ক্ষুব্ধ হয় শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা। এ নিয়ে এনসিটিবির ভেতরে চলে চরম দ্বন্দ্ব। এর মধ্যে কারিকুলামের সাথে যুক্তদের তালিকা চেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব। আর গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অপেক্ষায় থাকে ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটির (এনসিসি) বৈঠকের অপেক্ষায়। এই দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া আর সামনে এগোতে পারেনি।

অভিযোগ উঠেছে, এনসিটিবি ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশীয় কারিকুলাম বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে দেশী-বিদেশী বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে নতুন কারিকুলাম তৈরি করা হচ্ছে। তিন বছর ধরে দেশের বাস্তবতা যাচাই ও চাহিদা বিবেচনা করে এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের তৈরি করা যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফল (লার্নিং আউট কাম) বাদ দিয়ে অতিমাত্রায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে, যা বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে যায় না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, এনসিটিবির বিভিন্ন কর্মশালায় প্রস্তাবিত কারিকুলাম এখনই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে একাধিক বিশেষজ্ঞ মতামত দেন। তারা বলেন, পশ্চিমা দেশের সাথে তাল মিলিয়ে এখনই অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম (এক্সপিরিয়েন্স লার্নিং) চালু হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব হবে না। এ কারিকুলাম চালু হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা আরো বেশি কোচিং এবং সহায়ক বই নির্ভর হয়ে পড়বে।

প্রস্তাবিত প্রাক-প্রাথমিক স্তরের একটি বইয়ে চারটি ধর্মের বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। আর ইসলাম শিক্ষা বইয়ে যোগ্যতার গল্প বলা হয়েছে। এর ফলে সারা দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর রূপরেখায় কারিগরি শিক্ষা যুক্তই করা হয়নি।

নতুন কারিকুলাম প্রণয়নে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে কারিকুলাম তৈরিতে একটি কমিটি করে দেয় গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটি কারিকুলাম বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রায় চূড়ান্ত করে। কিন্তু হঠাৎ আগের রূপরেখায় যোগ্যতা ও শিখনফল বাদ দিয়ে জটিল একটি যোগ্যতার ছক (মেট্রিক্স) জুড়ে দেয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয় অনুমোদিত প্রাথমিক স্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত উপেক্ষা করে ইউনিসেফ, প্ল্যান বাংলাদেশ ও ব্র্যাকের কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় সমন্বিত শিক্ষাক্রম রূপরেখাটি তৈরি করা হয়েছে। আর এনসিটিবির প্রাথমিকের উইং প্রধানকে বাদ দিয়ে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মশিউজ্জামানকে।

অভিযোগকারী বিশেষজ্ঞদের মতে, শিক্ষাক্রমের নতুন রূপরেখায় যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফল বাদ দেয়া হয়েছে। আর অভিজ্ঞতাভিত্তিক যোগ্যতা যুক্ত করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের সব পাঠই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দিতে হবে। সব কিছু অভিজ্ঞতা দিয়ে হয় না। অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ ছাড়াই অগোছালোভাবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক যোগ্যতাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। কারিকুলামের রূপরেখার টেম্পলেটে যোগ্যতাভিত্তিক শিখনফল বাদ দিয়ে সরাসরি বইয়ের কন্টেন্ট লেখার কথা বলা হয়েছে। এভাবে বইয়ের বিষয়বস্তু লিখলে বই ভারসাম্যহীন হয়ে বড় ধরনের গ্যাপ তৈরি হবে। ওই ঘাটতি পূরণে সহায়ক বই (নোট গাইড), কোচিং-প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে শিক্ষার্থীরা। তাদের একাধিক সহায়ক বই কিনতে হবে। অথচ শিখনফল প্রাথমিক শিক্ষায় বহু বছর ধরে চর্চা হচ্ছে। শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তোলা হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে নতুন রূপ রেখা বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরের বিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement