২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
অর্থ পাচার করে কর ফাঁকি

এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে

-

দেশে বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার কর ফাঁকি দিচ্ছে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও ব্যক্তি পর্যায়ের করদাতারা। কর ফাঁকির এ পরিমাণ মোট কর রাজস্বের সাড়ে ৩ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের ৬২ শতাংশ ও শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ১৪ শতাংশের সমান। এ পরিমাণ অর্থ চিকিৎসা খাতে নিয়োজিত প্রায় চার লাখ নার্সের বার্ষিক বেতনের সমান। ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক (টিজেএন) নামে কর ফাঁকিবিরোধী একটি আন্তর্জাতিক ফোরামের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘দ্য স্টেট অব ট্যাক্স জাস্টিস-২০২০ : ট্যাক্স জাস্টিস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ নামে গত শুক্রবার প্রকাশিত টিজেএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশে অর্জিত মুনাফা ও সম্পদ বিদেশে স্থানান্তর করে ওই পরিমাণ কর ফাঁকি দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলো।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বহুজাতিক কোম্পানি ও ব্যক্তি করদাতাদের মাধ্যমে বছরে ৭০ কোটি ৩৩ লাখ ৯৭ হাজার ১৯৫ ডলার কর ফাঁকির মাধ্যমে মুনাফা ও সম্পদ স্থানান্তর হয়েছে বিভিন্ন দেশে। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে সরিয়ে নেয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানির অংশ পাঁচ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা এবং ব্যক্তির অংশ ২৫০ কোটি টাকা। কর ফাঁকির পরিমাণ বাংলাদেশের মোট কর আয় দুই হাজার কোটি ডলারের সাড়ে ৩ শতাংশ।
বহুজাতিক কোম্পানির কর ফাঁকি প্রতিরোধে বেশ কয়েক বছর আগেই দেশে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে এনবিআরের একটি সেল কাজ করছে। কিন্তু এতে করে মুনাফা ও সম্পদ স্থানান্তর যে কার্যকরভাবে রোধ করা যায়নি; টিজেএনের প্রতিবেদন এর প্রমাণ। কর বিষয়ক বিশেষজ্ঞরাও বলেছেন, কর ফাঁকি দিয়েও সেই অর্থ বা সম্পদ দেশে থাকলে যে ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বিদেশে পাচার করলে। শুধু ট্রান্সফার প্রাইসিং আইন করে এ প্রবণতা ঠেকানো যাবে না সে কথাও বলেছেন তারা। তাদের পরামর্শ হলোÑ মুনাফা ও সম্পদ স্থানান্তর রোধের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা এবং তার ভিত্তিতে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেয়া।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে এর আগে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে। ২০১৩ সালে সংস্থাটি অফশোর কোম্পানির উদ্যোক্তা এমন ৩২ বাংলাদেশীর নাম প্রকাশ করে। ২০১৬ সালে আইসিআইজের পানামা পেপারসের ডাটাবেজে ৫৬ বাংলাদেশীর নাম পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে প্যারাডাইস পেপারসে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। ২০১৮ সালে একই পেপারসের সংযোজনীতে ২২ বাংলাদেশীর নাম পাওয়া যায়। অন্য দিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রাক্কলন অনুযায়ী কর ফাঁকি দিতে, অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করতে, কোম্পানির মুনাফা লুকোতে এবং অন্যান্য কারণে পণ্য আমদানি ও রফতানির সময় প্রায়ই পণ্যের প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে বছরে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। উল্লিখিত প্রতিবেদনগুলো যখন জনসমক্ষে আসে তখন দেশজুড়ে কিছু আলোড়ন ওঠে, কিছু আলোচনা হয়। কিন্তু কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
এই ব্যবস্থা না নেয়ার পেছনেও বিভিন্ন কারণ থাকে। কর ফাঁকি দেয়া ব্যক্তি ও কোম্পানির সাথে একশ্রেণীর অসাধু কর কর্মকর্তার যোগসাজশ থাকে বলে অভিযোগ অনেক পুরনো। কর প্রশাসনের দক্ষতার অভাবের বিষয়টিও বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় এসেছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও অন্যতম কারণ বলে আমাদের ধারণা। বাস্তবে বাংলাদেশে কর আদায় পরিস্থিতি খুবই নাজুক। কর দেয়ার যোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক শতাংশেরও কম করের আওতায় আছে। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, দেশে আদায়যোগ্য করের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশই আদায় হয় না। এ পরিস্থিতি কোনো দেশের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না। তার ওপর প্রতি বছর বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে ধস নামা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। আমরা বলব, এসব বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।


আরো সংবাদ



premium cement