২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সামাজিক শৃঙ্খলায় ধস

প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর করুন

-

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। একের পর এক এমন সব অপরাধের ঘটনা ঘটছে যা আগে কল্পনারও বাইরে ছিল। মারামারি-হানাহানি, সংঘর্ষ থেকে শুরু করে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা, পরিবারের সদস্যের হাতেই অন্য সদস্যদের খুন করে ফেলা, ধর্মীয় অনুভূতি রক্ষার নামে হত্যা এমনকি লাশ পুড়িয়ে দেয়া এমন সব ঘটনা ঘটছে যা সামাজিক শৃঙ্খলায় সার্বিক ধসের আলামত স্পষ্ট করে তোলে। এসবের জন্য বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে চিহ্নিত করে এসেছেন। সমাজে, রাষ্ট্রে ও শিক্ষাকার্যক্রমে নৈতিক শিক্ষার অভাবকেও তারা এসব অনাচারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে পুরনো ওই সব গৎবাঁধা বিশ্লেষণে আর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে এবং এগুলোকে ক্রমাগত আঘাত হেনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সবার জানা, সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সৃষ্টি করেছে। বিয়ে, পরিবার, সম্পত্তি, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, এতিমখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা এক দিকে মানুষের বহুমুখী প্রয়োজন পূরণ করে অন্য দিকে নানাবিধ সমস্যা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলোর মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি হয়, ব্যক্তি তার অবস্থান, দায়িত্ব-কর্তব্য বুঝে নিতে পারে এবং তারই ভিত্তিতে সে তার সামাজিক ভূমিকা পালন করে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা, মানসিক আনন্দ, ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপন এবং জ্ঞানচর্চা সংক্রান্ত যাবতীয় প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে পরিবারের ভূমিকা অনেকটাই শিথিল। বয়োজ্যেষ্ঠ তো দূরের কথা, বাবা-মায়েরও নিয়ন্ত্রণ থাকছে না সন্তানের ওপর। চোখের সামনে তাদের সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ছে। পারিবারিক কলহ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এর ফলে সামাজিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা গড়ে ওঠার পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতাবোধ গ্রাস করছে প্রতিটি মানুষকে। মানসিক বৈকল্য দেখা দিচ্ছে যুবসমাজের মধ্যে। তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে, কাউকে তোয়াক্কা না করার মনোভাব প্রবল হচ্ছে এবং তারই পরিণতিতে সমাজে গড়ে উঠতে শুরু করেছে একের পর কিশোর গ্যাং। তারা নিজেদের মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিরোধে জড়াচ্ছে এবং তুচ্ছ বিষয়েও খুন করছে বন্ধুকে। মাদকের বিস্তার এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে তাতে সন্দেহ নেই।
পরিবারের বাইরে প্রধান সামাজিক প্রতিষ্ঠান হলো ধর্ম ও রাষ্ট্র। আধুনিকতা ও তথাকথিত প্রগতিশীলতার জোয়ারে ধর্মকে এমনভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে যে, সেটি এখন আর সামাজিক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় নেই। তার পরও ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলবিশেষ থেকে উপর্যুপরি আঘাত হানা হচ্ছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র অবাধে চলছে। পরিণতিতে মানুষের প্রতি মানুষের আচরণ, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত বোধগুলো লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই সমাজ হয়ে উঠছে পারস্পরিক সহমর্মিতার সম্পর্কবিহীন একটি বিচ্ছিন্ন সত্তার শিথিল সমাবেশের মতো। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ সুরক্ষা ও কার্যকর রাখার ব্যবস্থা করা। তা না হলে সামাজিক শৃঙ্খলায় যে ধস নেমেছে তা জাতিকে ধ্বংসের অতলে ঠেলে দেবে। নীতিনির্ধারকরা যত তাড়াতাড়ি এ বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন, ততই জাতির জন্য মঙ্গল।


আরো সংবাদ



premium cement