২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
নদীভাঙন রোধ

গতানুগতিকতার বাইরে ভাবতে হবে

-

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বর্ষ গ্রন্থে ৩১০টি নদীর উল্লেখ আছে। নদীই এ দেশের প্রাণ। আবার এ নদীই অনেক সময় সর্বনাশ ডেকে আনে। এ জন্যই পদ্মার আরেক নাম কীর্তিনাশা। দেশে প্রতি বছরই বিস্তীর্ণ এলাকা নদীতে ভাঙে। পানি বাড়ার সাথে সাথে ভাঙনের তীব্রতা বাড়তে দেখা যায়। আমাদের দেশের নদীগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই আঁকাবাঁকা। সে জন্য ভাঙনের প্রকোপও বেশি। যে জমি ভাঙে, তার কিছু অংশ নদীর অন্য পাড়ে জড়ো করে, তৈরি করে চর। কিছুটা থেকে যায় নদীতে। এতে নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যায়। বাকি অংশ স্রোতের তোড়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। ফলে মোহনায় জাগে চর বা দ্বীপ। ২০১৫ সালে প্রকাশিত সিজিইআইএসের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ১৯৭৩ থেকে ২০১৩ সাল, অর্থাৎ এই চার দশকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৩৮ হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এটা শুধু গঙ্গা, পদ্মা ও যমুনা নদীর ভাঙনের হিসাব। এই তিন নদীর পারে নতুন জমি জেগেছে ৫২ হাজার ৯৯৮ হেক্টর। অর্থাৎ এক লাখ হেক্টরের বেশি জমি হারিয়ে গেছে। এই পরিমাণ ঢাকা শহরের আয়তনকেও ছাড়িয়ে যায়।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ লোক নদীভাঙনের শিকার। বর্তমানে প্রতি বছর নদী ভাঙনে গৃহহীন উদ্বাস্তু লোকের সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ হারে বাড়ছে। এতে বছরে ৩শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। নদীভাঙন এ দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে যেকোনো দুর্যোগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে। নদীভাঙন একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ নিয়ে নদীকে দুষে লাভ নেই। ভাঙন রোধে আমরা এখনো কার্যকর কোনো উপায় বের করতে না পারায় প্রতি বছরই ভাঙনের শিকার বিপুল মানুষ। এটি আমাদের ব্যর্থতা।
করোনার মহামারীর মধ্যেই বৃষ্টি ও উজানের পানির তোড়ে দেশের সব নদ-নদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ফলে লাখ লাখ লোক পানিবন্দী হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। বন্যার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এবারের বন্যা ১৯৮৮ সালের মতো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বন্যার সাথে সাথে এবারো নদীভাঙন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ বছর নদীভাঙনে দুই হাজার ৩৬৫ হেক্টর এলাকা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে ১৬টি এলাকার প্রায় ২৩ হাজার মানুষ গৃহহীন হবে। পাঁচ হাজার ৪০০ মিটার সড়ক, ৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তিনটি হাটবাজার, ২৯টি মসজিদ, দুটি সরকারি ভবন, একটি বেসরকারি সংস্থার কার্যালয় ও তিনটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নদীভাঙনের শিকার হবে। নদীর ভাঙন ঠেকাতে কংক্রিটের তৈরি ব্লক বাঁধের ধারে বা নদীর পানিতে ফেলার চল আছে আমাদের দেশে। ব্লক তৈরি ও ফেলার ঠিকাদারি এ দেশে বেশ লাভজনক। এত বছর হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত আমরা এর একটি যথোপযুক্ত সমাধান খুঁজে পেলাম না। শুধু নদীর পাড়ে মাটির বাঁধ তৈরি করে দুর্যোগ মোকাবেলার চেষ্টা করছি। অভিজ্ঞতায় বলে, বাঁধ বানের পানি ঠেকাতে যত কার্যকর, নদীভাঙন ঠেকাতে ততটা নয়। তবু প্রতি বছরই আমরা নদীভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ করে পানিতে শত শত কোটি টাকা ঢালছি। জনগণের কষ্টে জোগাড় করা টাকার এমন অপচয় আমাদের মতো একটি গরিব দেশে আর কত দিন চলবে? বর্তমান প্রযুক্তি, অর্থাৎ মাটির বাঁধ দিয়ে নদীর ভাঙন অনেকাংশে বন্ধ করা যাবে না। যদিও এক যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশে নদীভাঙন কমেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে নদীর তীর রক্ষায় ও বাঁধ নির্মাণে প্রচুর অবকাঠামো গড়ে তোলায় এটি হয়েছে। তবে বিনিয়োগ অনুপাতে সাফল্য আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল।
বাংলাদেশের মাটির ধরন অনুযায়ী নদীর তীরে ভাঙন একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ঘটনা। গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ভাঙনরোধে অবকাঠামো তৈরি করলে ভাঙন আরো কমানো সম্ভব। এ ছাড়া ভাঙনের আশঙ্কায় থাকা এলাকাগুলোর সামনের নদীর ডুবোচরগুলো খনন করা ও বাঁধ মজবুত করে বানালে ভাঙনের মাত্রা আরো অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব।


আরো সংবাদ



premium cement