২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজনীতিতে কবিতার প্রভাব

-

সৃষ্টির আদি থেকে রাজনীতির অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়, তবে তার ধরন আজকের মতো ছিল না। বিভিন্ন আঙ্গিকে রাজনীতি তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। এটি একসময় রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রকটভাবে ধরা দিয়েছিল। রাজপ্রাসাদের রাজনীতির কদর্য রূপ আমরা দেখতে পাই মোগল আমলে। এর আগে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের অগ্নিগর্ভ ইতিহাস, সম্রাট অশোকের ভ্রাতৃহত্যার ইতিহাস পড়লে সত্যিই অশ্রুসজল হতে হয়। বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভিলাষে ঘোসেটি বেগমের কূটনীতি ইত্যকার বহু ঘটনা ইতিহাস সুবিদিত। রাজনীতি যখন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে সৈকত ছেড়ে আমজনতার মধ্যে আর আমজনতা যখন রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ল তখন থেকেই কবিরা আস্তে আস্তে সরব হতে থাকে। এর পূর্বেও যে কবিরা সরব ছিলেন না তা নয়। তখন কবিরা রূপকের আশ্রয় নেয়ায় এর মধ্যে রাজনীতি প্রত্যক্ষ সংশ্রব সাধারণের নজরে আসেনি।
বাংলা সাহিত্যে কবিতার মধ্যে রাজনীতিটা সরব হয় মূলত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সামান্য একটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসা করতে এসে পুরো ভারতবর্ষ গিলে খাওয়ার ঘটনা সত্যিই বিরল। একসময় এটিকে ব্রিটিশ সরকার উপনিবেশ হিসেবে পাকাপোক্ত করার পরেই গোরা সৈন্যরা আর নীলকর সাহেবরা এ দেশের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ প্রকাশিত হয়। ইরেজদের দ্বৈতশাসনের ফলে একশ্রেণী জমিদার প্রজানিপীড়ন করতে থাকলে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ এ প্রহসন দু’টো রচনা করেন। এভাবেই কবি-সাহিত্যিকরা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন। অহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে যখন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দাঁড়িয়ে যান তখন গান্ধীজীর সহকর্মীদের মধ্যেও একরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ সময় মহাত্মা গান্ধীকে সাহস জোগাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়ে উঠলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখার ক্ষেত্রে বেশ কৌশলী ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের সুবিধাভোগী জমিদার হয়ে তার পক্ষে কাজী নজরুল ইসলামের মতো কঠিন কঠোর আঘাত হানা সম্ভব হয়নি। নজরুল স্বদেশীদের উদ্বুদ্ধ করতে যখন লিখলেন, ‘লাথি মার ভাঙরে তালা, যত সব বন্দিশালা, আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা।’ রবীন্দ্রনাথের ভাষার শৈলী যখন ছিল, ‘ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ বাক্য বিন্যাস যাই হোক না কেন কিশোর-যুবকদের জন্য এটির প্রভাব মোটেও কম ছিল না। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে যারা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পছন্দ করতেন তাদেরকে ঘা মেরে বাঁচানোর তাগিদ ছিল এ কবিতাটিতে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতাগুলো স্বদেশীদের মনে প্রভুত সাহস এনে দিত। সামান্য উনিশ-কুড়ি বছরের এক বালক কী বারুদ ছড়িয়েছিলেন তার কবিতায়। দুর্ভীক্ষপীড়িত ভারতের কাছে চাঁদের সৌন্দর্যের চেয়ে ওর মতো একটা ঝলসানো রুটির প্রয়োজনীয়তাকে তার কাছে বড় বেশি মনে হয়েছে। এর মাধ্যমে তখনকার রাজনীতিবিদদেরকে তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কোনটা তাদের কাছে মুখ্য হওয়া উচিত। রাজনীতি হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য। মানুষের পেটে ভাত আসলেই কেবল অন্য কিছুর চিন্তা আসে। স্বাধীনতা সংগ্রাম তখনই সফল হয় যখন আমজনতা সংগ্রামে শামিল হয়। তাদের দাবিকে সামনে তুলে আনলেই তারা বুঝবে এ সংগ্রামের সাফল্য তাদের সংসারে সুখ বয়ে আনবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা সংগ্রামী রাজনীতিকদের জীবনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার দৃঢ় উচ্চারণ ‘আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেদিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না। ‘এভাবে আধুনিক বাংলা কবিতার রূপকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন মেঘনাদের মুখ থেকে বলেন, ‘হায় তাত, উচিত কি তব কাজ, নিকষা সতী তোমার জননী, সহোদর রক্ষ শ্রেষ্ঠ, নিজকুল দেখাও তাতঃ দেখাও তষ্করে, চণ্ডালে আনিয়া পশিলে রাজার আলয়ে’ তখন আমাদের পরাশক্তির মুখোমুখি হওয়ার সাহস জোগায়। আবার যখন বিভীষণের মুখ থেকে বলেন, ‘রাঘবের দাস আমি, কি প্রকারে করি এ কাজ রক্ষিতে অনুরোধ’ তখন আপোষকামীদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়।
কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’ কবিতায় বলেন, ‘আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার। /অতএব রণভূমে চল ত্বরা যাই হে, চল ত্বরা যাই। /দেশহীতে মরে যেই তুল্য তার নাই হে, তুল্য তার নাই।’ তখন রাজনীতিক বা সংগ্রামীদের আর পিছুটান থাকে না।
কাজী নজরুল ইসলাম কিশোরদের উদ্জীবিত করতে আমি হব সকাল বেলার পাখি কবিতায় দুটো অমর লাইন লিখে যুবকিশোরদের চোখ খুলে দিয়েছেন। এ লাইন দুটো হলো, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে। /তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে’ ঘুমে থাকা ভারতভূমির যুবকিশোররা না জাগলে অন্ধকার পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে যে বেরোনো যাবে না তা এখানে সুস্পষ্ট।
কবি জীবনানন্দ দাশকে নির্জনের কবি বলা হয়। তার কবিতা যে রাজনীতে প্রভাব বিস্তার করেনি এমনটা নয়। তার নীলিমা কবিতাটি পড়লে আমরা দেখতে পাই পরাধীন এক নগরীর করুণ রূপ। যখন তিনি লেখেন, ‘অগণন যান্ত্রিকের প্রাণ/খুঁজে মরে অনিবার, পায়নাকো পথের সন্ধান,/ চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল: ‘অথবা, ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,/ লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,/ এই ধূলি-ধুম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার’ একজন রাজনীতি স্বচেতন মানুষের চোখ খুলে দেয়ার জন্য এ লাইনগুলোই যথেষ্ট।
জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতার নাম উল্লেøøখ করতে বললে যে কেউ বলে উঠবেন বনলতা সেন। এ কবিতার প্রথম লাইনে তিনি এই স্বদেশভূমি হাজার বছর ধরে যে আমাদের ছিল এবং এটি আমদেরই এটা স্পষ্ট করেছেন প্রথম লাইনটিতে, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’। এই পথ আমাদের, কিন্তু এখন আর আমাদের নেই। আমাদের পূর্বপুরুষ থেকে আজ পর্যন্ত আমরা হেঁটেই চলছি কিন্তু আমাদের মাটি আমাদের করতে পারছি না। এভাবে একসময় কবির কল্পিত স্বাধীনতা নাম্নী এক নারীর (বনলতা সেন) সাহ্নিধ্যে এসে তিনি দুদণ্ড শান্তি পেয়েছেন। এই প্রেম একজন প্রেমিকের যেমন একজন সংগ্রামীরও তেমন। এই জীবনবোধ থেকেই হাজার হাজার যুবকিশোর বাপ-মার অজান্তে গৃহ ছেড়ে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার পিছু ছোটার ফলেই আমরা আজ স্বাধীন।
এভাবেই রচিত হয়েছে, ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ নামক কবিতাটি। ছোট্ট এ কবিতাটির তাৎপর্য এমনই যেমন ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:/ চারিদিকে পিরামিড-কাফনের ঘ্রাণ,’। হত্যা খুন, গুমের ঘটনায় ব্যথিত কবির এক আপ্তবাক্য উচ্চারণ। কবিরা কলম সৈনিক, তারা সংগ্রামীদের জাগিয়ে তোলেন, দাবি আদায়ের সংগ্রামে উদ্দীপক হয়ে আগুন জ্বালান। কেউ সরাসরি কেউবা অন্য কোনো ভাষায়। নজরুল ছিলেন বিপ্লবী, তাই তার ভাষা ছিল একরৈখিক এবং সরল। কোনো ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে না গিয়েই তিনি তার ‘আগ্নেয়গিরি বাংলার যৌবন’ কবিতায় বলে উঠেন,

‘কই রে কই রে স্বৈরাচারীরা বৈরী এ বাংলার?
দৈন্য দেখেছ ক্ষুদ্রের, দেখনিকো প্রবলের মার!
দেখেছ বাঙালি দাস, দেখনিকো বাঙালির যৌবন,
অগ্নিগিরির বক্ষে বেঁধেছে যক্ষ তব ভবন!
হেরো, হেরো, কুণ্ডলী-পাক-খুলি আগ্নেয় অজগর
বিশাল জিহ্বা মেলিয়া নামিছে ক্রোধনেত্র প্রখর।’
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার উদাহরণ দিলে শেষ হবার নয়। কারণ তার কবিতা যুগে যুগে নিপীড়িত নিষ্পেষিত জনগণের এগিয়ে যাবার সাহস জোগাবে।
আল মাহমুদের কবিতাও রাজনীতিকদের নীতি নির্ধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে সন্দেহ নেই। তার ঊনসত্তরের ছড়ার মধ্যে আমরা এর অনেক উদাহরণ খুঁজে পাই। যেমন :
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দোর জানালা
তুলবো কেন খিল?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কবিতা যখন লিখেন :
তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত
করলো তার মুখ।
থ্যাঁতলালো ঠোঁটজোড়া লালা-
রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত
ঝরে পড়লো কংক্রিটে।
মা.. মাগো.. চেঁচিয়ে উঠলো সে।

অথবা কবি শামসুর রাহমানের অভিশাপ দিচ্ছি কবিতায় যা বলেছেন-
তারা গণহত্যা করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে নিমিষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে যাবে তা আমি মানি না।
কবির ক্রোধের বহ্নিশিখার এভাবেই কাব্যিক প্রকাশ।
এ কবিতাগুলো পড়লে আধুনিক প্রজন্মের যেকোনো সন্তানের সামনে একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর নৃশংসতার চিত্র ফুটে উঠবে। এই নৃশংস দৃশ্যপটের রক্তাক্ত সরণি পেরিয়েই এসেছে বাংলার স্বাধীনতা। যে সন্তান এই কবিতা পড়বে তার ধমনীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের তৎপরতার বিরুদ্ধে ঘৃণা না জন্মিয়ে উপায় নেই। এভাবে কবিতার সেøাগানে রাজনীতির মাঠ সরগরম হয়ে ওঠে।
কবি শামসুর রাহমান লিখলেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ আর রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখলেন তার বিখ্যাত কবিতা, ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ যার বিখ্যাত লাইন, ‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরোনো শকুন।’
এভাবে তার আরো কবিতা আছে।
অন্যায় অত্যাচারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে যে কবিতা যুবসমাজকে অসম্ভব নাড়া দিয়েছিল সেটি হচ্ছে কবি হেলাল হাফিজের কালজয়ী কাব্যিক সেøাগান ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে দেওয়ালে এ পংক্তি দু’টো আত্মপ্রকাশ করে তারপর সবার মুখে মুখে। কবিতাবিমুখ কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও সে বলতে পারবে এ লাইন দুটো।

চুয়াত্তরের মনন্তরের সময় রাজনৈতিক চেতনার বিরুদ্ধে গিয়ে কবি রফিক আজাদ যখন লিখেন ‘ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাব’ তখন কবিও রাজনৈতিক পোস্টার হয়ে যান। এ কবিতা লিখে কাজী নজরুল ইসলামের মতো তাকেও অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদ যখন কবি হবার ছলনায় লিপ্ত তখন মোহাম্মদ রফিকের দীপ্ত উচ্চারণ ‘সব শালা কবি হতে চায়’। এভাবেই রাজনীতিতে যেমন কবিতার প্রভাব এসেছে তেমনি কবিতায়ও রাজনীতি চলে এসে একাকার হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক সাফল্যের গুণগাথা গাইতেও কবিতা স্বমহিমায় উচ্চারিত হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রয়াশই তার ভাষণ শেষ করেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে :
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান,
----
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের সেøাগান নিয়ে একটি দলের আবির্ভাব ঘটে। তখন তাদের পোস্টারে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার এ চারটি লাইন কোট করা হতো :
আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন ধ্বনি আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।

রাজনীতি কখন কার স্বার্থে ব্যবহৃত হয় তা সময় ঠিক করে দেয়, তবে এর উদ্ভবের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় গণমানুষের একাংশের হলেও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। ক্ষমতাশীনদের সব সিদ্ধান্তই যে সবার অনুকূলে যাবে তা নয় এবং তা হবারও নয়। যে শ্রেণীর প্রতিকূলে যায় তারাই বিরুদ্ধাচারিতায় মাঠে নামে। যার যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন মৌলিক বিষয় হলো বিরুদ্ধাচরণ করা। কোনো কোনো কবিতার ভাষা এই বিরুদ্ধাচারিতাকে উৎসাহিত করে। এরকম ভাষা ইংরেজি সাহিত্যেও বহু পাওয়া যাবে, তবে বক্ষমাণ বিষয়কে ভারতবর্ষের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করায় বিশ্বসাহিত্যের উদাহরণ টানা হলো না।
মোদ্দা কথা পৃথিবীর সব রাজনীতিকের উৎসাহ উদ্দীপনায় সবসময় কবিতার একটা প্রভাব লক্ষ করা যায়, যার ফলে কবিতাও তার ধরন পাল্টে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। পঁচাত্তরের পরবর্তী কবিতাগুলোর চেহারা এভাবেই বদলে গিয়েছিল। অনেক সমালোচকের ধারণা কালজয়ী কবিতা হবে রাজনীতির সংশ্রবমুক্ত। তাদের উদ্দেশে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা তুলে ধরলেই সব ধারণা পাল্টে যাবে। সুতরাং আবহমান কাল থেকে রাজনীতিতে যেমন কবিতার প্রভাব ছিল তেমনি কবিতাতেও রাজনীতির প্রভাব ছিল। আমাদের জীবনটাই হলো রাজনীতি যা পরিবার থেকে শুরু হয়ে ব্যবসাবাণিজ্য অফিস আদালত হয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে মিলে মিশে একাকার। কবিতা যেহেতু মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি তাই তাকে দূরে কোনো নির্জন স্থানে বসে গান গাইলে চলবে না। তাকেও মানবের চাওয়া পাওয়ার সাথে মিল রেখে চলতে হবে। এই চাওয়া পাওয়ার রাজনীতি যখন জনগণের মঙ্গল কামনায় আবর্তিত হয় তখন কবিতা তার স্বরূপ উন্মোচনের দিক খুঁজে পায় এবং তখনই কবিতা মানবজাতির কল্যাণকর এক অনুষঙ্গ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাইতো কবিতা বহমান নদীর মতো চলছে এবং চলবে।


আরো সংবাদ



premium cement