২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লাল সবুজের নতুন সূর্য

-

আসাদ ছিল গ্রামের একমাত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্য, আসাদ রাতের আঁধারে চুপিচুপি গ্রামবাসীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিত, সারা দেশে তখন অবিরাম যুদ্ধ চলছে, তাই স্কুল কলেজ সব বন্ধ থাকায় আসাদ কলেজেই বন্ধুদের নিয়ে একটি ক্যাম্প তৈরি করল।
বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে বাংলার কোলে জন্মানো রাজাকারের সহযোগিতায় পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ধরে নির্মমভাবে হত্যা করছে, বর্ষার জলে ভাসছে লাশের বহর, পুড়িয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম, সারা দেশজুড়ে চলছে পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার, নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালি জাতি নিজের মাতৃভূমি রক্ষা করতে ৭ মার্চের সেই ঝাঁজালো কণ্ঠের আহ্বানে লাঠি-বইঠা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির ক্ষুধায়।
সেদিন রাতে আসাদ গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে পেছনের জানালা দিয়ে কলেজ ক্যাম্পে ঢুকতেই সবাই দাঁড়িয়ে গেল, আসাদ খুব ঘামছে, মোমবাতির আলোতে আসাদের কপালে ঘামের বিন্দুগুলো মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে, মুনিব এগিয়ে এসে বলল, তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আসাদ বলল, আমরা যে পাকবাহিনীর ক্যাম্প পুড়িয়ে দিয়েছি গোপন সূত্রে ওরা জেনে গেছে, আমি রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে কিছুটা আভাস পেয়েছি, তার মানে আমাদের আশপাশেও রাজাকার রয়েছে, শুনলাম আমাদের পাশের গ্রামের মুক্তিবাহিনীর ওপর রাজাকারদের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়েছে, কয়েকজন ধরাও পড়েছে। হয়তো জানতে চাইবে লিডারের নাম, তাই বলছি সবাই সতর্ক থাকতে হবে। যেকোনো সময় আমরাও মারা যেতে পারি। তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই করতে হবে।

হঠাৎ চার দিকে ফাঁকাগুলির শব্দে সবাই চমকে ওঠে, সবার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা গেল, আসাদ জানালার ফাঁকে দেখতে পেল পুরো কলেজ ঘেরাও করে রেখেছে, বাঁচার কোনো পথ নেই, পাকবাহিনীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে পাশের গ্রামের মুরাদ, আসাদ চোখ বন্ধ করে বসে পড়ল, মুনিব বলল, আমরা যে এখানে ওরা কী করে জানল?
আসাদ বলল মুরাদ নিয়ে এসেছে...।
মুনিব চোখ বড় করে বলল, রাজাকার। তাহলে মুরাদ শালাকে শেষ করে তবেই মরব। আসাদ বলল এখন পাগলামির সময় নয়, ওরা সংখ্যায় অনেক বেশি, আমি যা বলি সবাই মন দিয়ে শোনো, এক এক করে পেছনের জানালা দিয়ে বের হয়ে খালে ঝাঁপিয়ে জীবন বাঁচাও, যদি মাতৃভূমি রক্ষা করতে চাও প্রথমে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।
মুনিব বলল, এটি হয় না, আমরা লড়াই করে মরব।
রফিক বলল আসাদ ভাই ঠিক কথা বলেছে আমরা এখন নিরস্ত্র তাদের সাথে কী করে লড়াই করব, এবার বাইরে থেকে হ্যান্ডমাইকে এক ক্যাপ্টেন উর্দুতে বলল, যদি এখনি তোমরা আত্মসমর্পণ না করো তবে ভেতরে ঢুকে সবাইকে জ্বালিয়ে দেবো তোমাদের হাতে মাত্র দুই মিনিট সময় তারপর আমি কাউন্ট শুরু করব।
আসাদ বলল, সময় কম জীবন বাঁচাও কেউ সময় নষ্ট করো না।
আসাদের কথামতো, এক এক করে জানালা দিয়ে সবাই বের হতে লাগল।
আবার হ্যান্ডমাইকে ভেসে এলো কাউন্ট শুরু- এক, দুই, তিন, ফায়ার। মেইন গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে, দরজা ভেঙে দেখে আসাদ পালাচ্ছে। অমনি এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া শুরু হয়, একটি গুলি আসাদের পায়ে লাগে। আসাদ গড়িয়ে খালে পড়ে কচুরিপানার নিচে নিজেকে লুকিয়ে নেয়। পাকবাহিনী জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মতো গুলি চালায়, গুলির শব্দে পুরো গ্রাম কেঁপে ওঠে...

রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই দরজার ঠকঠক শব্দে কাঁপা কাঁপা গলায় নজরুল সাহেব বলল কে?
আসাদ আস্তে করে বলল স্যার ভয় পাবেন না আমি আসাদ দরজাটা একটু খুলুন।
নজরুল সাহেব হ্যারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দরজা খুলে দেখে আসাদ শীতে থর থর করে কাঁপছে, সারা শরীর ভিজে চপচপ...।
নজরুল সাহেব বলল জলদি ভেতরে এসো।
মেয়েকে ডেকে বলল, মা মুক্তি আমার চাদরটি এনে দে, এমনি আসাদ ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়।
আসাদ বলল স্যার আমার পায়ে গুলি লেগেছে, যেমন করে হোক গুলিটা বের করুন না হয় রক্তক্ষরণে মারা যাবো। নজরুল সাহেব বলল, এত রাতে ডাক্তার পাবো কোথায়। তা ছাড়া চার দিকে পাকবাহিনীর টহল।
মুক্তি বলল, বাবা যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ওনার শরীর রক্তশূন্যতায় সাদা হয়ে যাচ্ছে।
নজরুল সাহেব কলেজের প্রিন্সিপাল। আসাদ হলো নজরুল সাহেবের প্রিয় একজন ছাত্র, মুক্তিও বেশ পছন্দ করে আসাদকে, আসাদের এ অবস্থা দেখে চোখজুড়ে কান্না থৈথৈ করছে।
আসাদ বলল, ঘরে চাকু থাকলে গরম করে গুলিটা বের করো। পুরো শরীর ব্যথায় অস্থির।
মুক্তি গুলি বের করে ব্যান্ডেজ করে দিলো।
খবর পেয়ে পাকবাহিনী খুব ভোরে হামলা চালায় নজরুল সাহেবের বাড়িতে, আসাদ তখন ঘুমে অচেতন, বেয়নেটের খোঁচায় আসাদ চোখ মেলে দেখে আসাদের বুকের উপর কয়েকজন পাক সেনার রাইফেল তাক করা। একজন এসে আগুনরাঙা চোখে আসাদকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে বুটের আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে তুলল। গুলিবিদ্ধ পায়ে মোচড় দিতেই আসাদ মা মা বলে চিৎকার করে, আসাদের চিৎকারে পরিবেশটাও যেন থমকে যায়। এক ক্যাপ্টেন এসে বলল, বল শালা, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, আসাদ একটু মৃদু হেসে থুথু ফেলে বলল, জয় বাংলা। কথা শেষ না হতেই চার পাশ থেকে অজস্র গুলিতে আসাদের বুকটা ঝাঁজরা করে দেয়। আসাদ চিরতরে ঘুমে পড়ে মাটির বুকে।
দীর্ঘ ৯টি মাস যুদ্ধের পর ৩০ লাখ আসাদের রক্তের বিনিময়ে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ নামক লাল সবুজের নতুন সূর্য উদিত হয়।
লাখো সালাম সব শহীদের প্রতি।


আরো সংবাদ



premium cement