২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বৃদ্ধাশ্রম

-

কয়েক দিন আগে পুরনো ট্রাঙ্ক ঝাড়তে ঝাড়তে বত্রিশ বছর আগের একটি চিঠি পেলাম। মোহাম্মদ আলী ও আমি তখন একসাথে রাজশাহীতে বিএড করেছিলাম। একই রুমে থাকাই দু’জনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়। আমার নাম শুক্কুর আলী হওয়ায় তিনি আমাকে মিতা বলে ডাকতেন। ঠিকানা হারিয়ে ফেলার কারণে দুজনের মধ্যে আর যোগাযোগ হয়নি।
ঠিকানা পেয়ে মোহাম্মদ আলীকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করতে লাগল।
শিক্ষকতা চাকরিতে রিটায়ার্ড হওয়ায় বিয়েশাদি না করার কারণে, সংসার জীবনে ঝামেলা না থাকায়, আজ এখানে কাল ওখানে এভাবে ঘুরে বেড়াতে আমার ভালোই লাগে। আল্লাহর অশেষ রহমতে বাষট্টি বছর বয়স, স্বাস্থ্য এখানো ভালো। অসুখ-বিসুখ ধরেনি।
পরের দিন মোহাম্মদ আলীর ঠিকানায় মোল্লাপাড়ায় তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। তিন ঘণ্টা লোকাল বাসে লক্কড়-ঝক্কড় করে দুপুর ১টার সময় পৌঁছলাম মোল্লাপাড়া তিন মাথা মোড়। বাসের হেলপার চিৎকার করে উঠল। মোল্লাপাড়া তিন মাথার মোড়-
যাত্রী থাকলে নামেন। আমি সবার পেছনের সিটে বসে ঘুমে টুপছিলাম। লোকাল বাস ভিড়ও ছিল খুব। মোল্লাপাড়ার নাম শোনার সাথে সাথে আমিও উঠলাম।

এই গাড়ি দাঁড়াও
নামব।
আমিসহ তিন চারজনের মতো লোক বাস থেকে নামলাম।
ঘুমের ঘোর কাটানোর জন্য একটি চায়ের স্টলে বসে চা চাইলাম। দোকানদার বলল কী চা খাবেন?
আদা চা।
জিজ্ঞেস করলাম মোল্লাপাড়া মোহাম্মদ আলী বাড়ি এখান থেকে কতদূর?
দোকানদার বলল, ভাই আপনি কোন আলীর কথা বলছেন?
মোল্লাপাড়ায় দু’জন মোহাম্মদ আলী আছেন, একজন কসাই আলী আর অন্যজন ধবল আলী নামে পরিচিত।
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বললাম মোহাম্মদ আলী মাস্টার।
ও ঠিক আছে,
তিনি হলেন ধবল আলী, পূর্ব দিকে প্রায় দুই কিলো গেলেই রাস্তার পার্শ্বে ভদ্রলোকের বাড়ি।
খুব ভালো মানুষ। আত্মকেন্দ্রিক
বাইরে তেমন দেখা যায় না। একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনিয়ার দেশের বাইরে আছে শুনে খুব ভালো লাগল। সামনের যেকোনো অটোর ড্রাইভারকে বললে পৌঁছায়ে দেবে।
তার বাড়ির সামনে পৌঁছলে একজন পনেরো-ষোলো বছরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, মোহাম¥দ আলীর বাড়িতে আছে কি না?
ডাকতে বললাম। ছেলেটি মোহাম্মদ আলীর বাড়ির ভিতরে গেল। কিছুক্ষণ পর মোহাম্মদ আলী বের হয়ে আসলেন। ঠোঁট দুটো ও নাকের ওপর কপাল পর্যন্ত ধবল হয়ে গেছে, সাদা দাড়ি প্রথমে চিনতে পারিনি। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

বললেন-
কাকে খুঁজছেন? আমি বললাম মোহাম্মদ আলীকে, তিনি বললেন, কে আপনি? বললাম আমি শুক্কর আলী প্রায় বত্রিশ বছর আগে একসাথে রাজশাহীতে বিএড করেছিলাম। মোহাম্মদ আলী আমাকে জড়িয়ে ধরেন।
মিতা কেমন আছেন? হাত ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যান।
টিনশেডের দালান। তিনটি রুম। বিছানাপত্তর ময়লা হয়ে গেছে। ঘরের যেখানে সেখানে ঝুল ঝুলে আছে, সোফার উপরে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম ভাবী কই? দু-বছর হলো হঠাৎ ছেড়ে চলে গেল-কোথায়?
কোথায় আবার যেখানে যাবার সেখানে।
ডায়াবেটিস ছিল। হটাৎ এক অদ্ভুত কষ্ট আমাকে আচ্ছন্ন করল! চুপ হয়ে গেলাম। তিনি কাকে যেন মোবাইল করছেন তাড়াতাড়ি আসো আমার মিতা এসেছে। ফ্রিজে মুরগির মাংস ও ডিম আছে। নিয়ে যাও-
তাড়াতাড়ি খাবারের ব্যবস্থা করো। অনেক দূর থেকে এসেছে। কিছুক্ষণ পর একজন মহিলা এসে মুরগির মাংস ও ডিম নিয়ে যায়। আবার জিজ্ঞেস করলাম মিতা ছেলে-মেয়ে কয়জন? কাকেও দেখছি না যে, একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনিয়ার স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় গেল। সাত বছর হলো আসেনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান মেয়েকে সেখানে বিয়ে করেছে।
ওর মা মারা যাওয়ার পর বাড়িতে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করি। বাবা বাড়ি আসো? তোমার মা চলে গেল?
আমার ও স্বাস্থ্য ভালো নেই। মায়ের কবরের পাশে এসে দোয়া করো- কবরটা দেখে যাও-ছেলে প্রত্যুত্তরে বলল বাবা আমরা খুব ব্যস্ত, যাব কোনো এক সময়। তোমার একা খাওয়া-দাওয়া চলা ফেরাতে কষ্ট হচ্ছে তার চেয়ে একটি কাজ করো বাবা-
ভালো একটি বৃদ্ধাশ্রমে ওঠো। যা টাকা লাগে আমি মাসে-মাসে পাঠিয়ে দেব।
ছেলের কথা শুনে কান্না সংবরণ করতে পারিনি। খুব কেঁদেছিলাম। শেষ বয়সে ছেলের কাছে শুনলাম বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা!
সেদিন থেকে ছেলের সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দিয়েছি, ওর মা ছেলের সাথে কথা বলার জন্য শখ করে কিনেছিল এন্ড্রয়েড মোবাইল ঐদিন থেকে বন্ধ করে দিয়েছি।

বুঝলেন মিতা? ছেলে আমার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মানুষ করতে পারিনি।
কথাগুলো বলতে বলতে চোখ তার ভিজে উঠল।
চশমা খুলে চোখ মুছলেন।
মহিলাটি খাবার নিয়ে আসল।
দু-মিতা ভাত খেলাম। জিঞ্জেস করলাম মহিলাটি কে? বলল গ্রামের ভাইস্তি দু-বিঘা জমি দিয়েছি চাষাবাদের জন্য বিনিময়ে আমাকে রান্নাবান্না করে খাওয়ায়।
তিনি আমাকে বললেন মিতা? আপনার ছেলেমেয়ে ক’জন? বললাম বিয়ে আর কই করলাম। বয়স ও শেষ হয়ে আসল।
আমার কথা খুব ভাবলাম- আজ না হয় স্বাস্থ্য ভালো আছে তাই বেশ চলছি- আগামী দিনগুলো কেমন হবে আচমকা এক দুশ্চিন্তায় ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ভারাক্রান্ত-মন নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় ট্রেনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।


আরো সংবাদ



premium cement