২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নব যৌবনা বসন্ত

-


আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।
তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সঙ্গীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহিরভুবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।

(রবি ঠাকুর)
শীতের কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে এলো নব যৌবনা বসন্ত। সবুজ কিশলয়ে ভরে ওঠল চার দিক। দক্ষিণের মিষ্টি হাওয়া আনমনে বয়ে গেল সবুজ ধানক্ষেতে। সবুজ ধানের চারা আনন্দে আন্দোলিত হলো। নীল আকাশে বলাকার ঝাঁক উড়ে সুদূরে। ফুলে ওঠল নৌকার পাল। বৃক্ষের বাকল চিরে বেরিয়ে এলো নতুন পাতারা। ডালে ডালে আমের মুকুল মনে করিয়ে দিলো ফাগুনের কবিতা-

ফাল্গুনে বিকশিত
কাঞ্চন ফুল
ডালে ডালে পুঞ্জিত
আম্রমুকুল।
চঞ্চল মৌমাছি
গুঞ্জরি গায়,
বেণুবনে মর্মরে
দক্ষিণবায়।-

বসন্তের আগমনে প্রকৃতি মুছেছে জীর্ণতা। শীতের পাতাঝরা বৃক্ষগুলো এত দিন যেন বিগত যৌবনা বৃদ্ধার মতো দাঁড়িয়ে ছিল রিক্ত বেশে। বসন্ত এসে তাকে দান করেছে যৌবনের উন্মাদনা। মৃতপ্রায় নগ্ন ডালগুলোতে এলো নতুন পাতা। শুকনো মাটির বুক ফেটে বেরিয়ে এলো সবুজ ঘাস। বসন্ত এলো পাখির কলকাকলী আর অপার সবুজের সমাহার নিয়ে। গাছে গাছে নতুন কচি পাতা আর পুষ্প মঞ্জরির সমারোহ। চার দিকে সবুজের ছড়াছড়ি। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের খেতে সবুজের ঢেউ খেলে গেল। পাতায় পাতায় আলোর নাচন। প্রকৃতি ভরে উঠেছে, এক অনুপম সৌন্দর্যে। রঙ-বেরঙের ফুলে ফলে ভরে গেল গাছগাছালি।
এ ঋতুতে ভ্রমরের গুঞ্জনে, কোকিলের কুহুতানে আর পাপিয়ার পিউ পিউ ডাকে চার দিক হলো মুখরিত ।
শেষ বিকেলের গোলাপি আলো মিলিয়ে যেতে না যেতেই দূর আকাশে চোখ মেলে সন্ধ্যাতারা। রাত নামে। আকাশে তখন লক্ষ তারার মেলা। তাই দেখে জোনাকিরাও বুঝি তারা হতে চায়। আশ্চর্য সুন্দর বসন্ত রাতের দৃশ্য শুধু চোখই জুড়ায় না, মনও কাড়ে। প্রকৃতি যেন নববধূর সাজে সজ্জিত হয়। প্রকৃতির এরূপ লাবণ্য মানব মনকে দোলা দেয়। বসন্তের রূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ কবির কণ্ঠে শুনি- ‘মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে/নয়ন ভোলানো রূপে কে তুমি এলে।’

সত্যিই প্রকৃতি অপেক্ষায় ছিল এই বসন্ত ঋতুর জন্য। তার বিরহী মন নিয়ে রাতভর চোখের পানি ফেলে অপেক্ষা করছিল প্রিয় বসন্তের জন্য। কবির ভাষায় বলতে হয়-
কঠোর হিমের বিরহী পাথার একাকিনী নিশি জাগি।
গুনিয়াছে দিন নিরজনে বসি নয়ন বসনে ঢাকি।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর জেগে উঠেছে বসন্ত। শীত শেষে দক্ষিণা হাওয়া আর ফুল পাখিদের কলরবে পরিবেশ মুখরিত হলো। নানা জাতের, নানা বর্ণের, নানা সুবাসের ফুল ফোটেছে এই বসন্তে। চার দিক হলো সুরভিত।
ফাল্গুন চৈত্রে বসন্ত বিরাজিত। সে প্রকৃতিতে নিয়ে এলো নব ছন্দের ব্যাকুল শিহরণ। পুরাতন জীর্ণ সব মুছে দিয়ে বসন্তের নবীন পাতায় জেগে উঠল সবুজের আভা।

নিয়ে এলো পুষ্পারতির পরম লগ্ন। মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাসের জাদুস্পর্শে বর্ণ বিরল পৃথিবীর সর্বাঙ্গে লেগেছে অপূর্ব পুলক প্রবাহ।
বন বিথীর রিক্ত শাখায় জেগেছে কচি কিশলয়ের অফুরন্ত উল্লাস। বাতাসের মর্মর ধ্বনি, দূর বনান্তরাল থেকে ভেসে এলো কোকিলের কুহুগীত। অশোক পলাশের বিহব্বলতায়, শিমুলের বিপুল উল্লাসে, বিকশিত মধু মালতী আর মাধবী মঞ্জরীর গন্ধ মদীর উচ্ছলতায় সারা আকাশ হলো সুরভিত। তাই তো কবি লিখেছেন-
‘হিম কুহেলীর অন্তরতলে আজিকে পুলক জাগে
রাঙ্গিয়া উঠেছে পলাশ কলিকা মধুর রঙ্গিন রাগে।
আজকের বসন্ত আর কয়েক যুগ আগের বসন্তের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। আগের বসন্ত আরো সুন্দর আরো প্রাণবন্ত ছিল। সবুজের আয়োজনে চার দিক ছিল আরো সবুজ। ফুলের সুরভিতে পাখির কূজনে ভরপুর ছিল। মানুষের অনৈতিক চলনে অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। হারিয়ে যেতে বসেছে প্রিয় সবকিছু।

বসন্ত ঋতু আল্লাহর এক মহান নিয়ামত এবং রহমতের বীজ বপনের ঋতু। এই সময় ফুল পাখি, কীটপতঙ্গ আরো নানা প্রাণী করুণাময়ের নির্দেশে এক মহান দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়। মানুষের কল্যাণে সৃষ্টিকর্তার এক মহা উদ্দেশ্য রয়েছে এই দু’টি মাসে। গাছ ফুল পাখি আর কীটপতঙ্গ নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার।
গাছ অধিকাংশ পাখির বাসস্থান। গাছেই ফুল হয়। বৃক্ষের সবুজে পৃথিবী হয় সবুজ। গাছ থেকে পাই অক্সিজেন যা বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। গাছ তার শিকর দিয়ে আঁকড়ে রাখে মাটি। গাছের ফুল থেকে হয় ফল, শস্য দানা, মধু, আরো অনেক কিছু। গাছ থেকে এবং কোন কোন ফুল থেকেও ওষুধ তৈরি হয়। এসব জিনিস আমাদের বেঁচে থাকার জন্য কতটা দরকার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বসন্তকালেই ফুলের সবচেয়ে বেশি সমাগম হয়।
যে বৃক্ষের এত প্রয়োজন তা আমরা অমানবিকভাবে নিধন করে থাকি। আজ অনেক বৃক্ষের অনেক প্রজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজারো ফুলের অপচয় করে আমরা বসন্ত বরণ উৎসব পালন করি।
সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুলের ব্যাপক ব্যবহার হয়। অনুষ্ঠান শেষে শত শত ফুল ডাস্টবিনে ফেলা হয়। যে ফুল জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় রসদ জোগায়। এই অমানবিক কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। তা না হলে আমরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবো। তার গজবে পতিত হবো। বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি দুর্যোগের কবলে আমাদের পড়তে হবে। অবশ্য এসব দুর্যোগ অনেক আগে থাকেই আমাদের জীবনে শুরু হয়ে গেছে। তবুও আমরা সতর্ক হইনি।

পাখি কীট-পতঙ্গ বিভিন্ন প্রাণী আমাদের জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় রসদ তৈরিতে নিয়োজিত থাকে। এরা শীতকালে শীতনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকে। বসন্তের ছোঁয়া পেয়ে তারা জেগে ওঠে । ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বসন্ত। তারপর ফলে ভরা গ্রীষ্মকাল। বসন্ত কালে ফুলে ফুলে পরাগায়ণ হয়। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ফুল থেকে ফল হয়। আল্লাহর নির্দেশে এই পরাগায়ণের কাজটি কীট-পতঙ্গরাই করে থাকে। পাখিরা বীজের বিস্তারণ ঘটায়। রাব্বুল আলামিনের কী অপূর্ব নিয়ম আর তার কাজের ধারাবাহিকতা। আমরা বসন্তে পাই ফুলের আচ্ছাদন আর গ্রীষ্মে পাই ফল।
পশু পাখি কীট-পতঙ্গ আমাদের খাদ্যশস্য, শাক-সবজি, ফল ইত্যাদি উৎপাদনে সাহায্য করে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে পরিবেশ সুন্দর রাখে। অতীতে গাছপালা, ফুল-পাখি, পিক-পাপিয়া, প্রজাপতির ঝাঁক ছিল অফুরন্ত। খুবই দুঃখের বিষয় আজ মানুষের অসাধু আচরণে অনেক গাছসহ কীট-পতঙ্গের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি প্রজাপতি আজ মহা সঙ্কটাপন্ন। আমরা বন কেটে পাখির বাসস্থান ধ্বংস করছি। তেমনি ভয়ঙ্কর কীটনাশক দিয়ে কীট-পতঙ্গ মেরে ফেলছি। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বিষ খেয়ে মারা যাচ্ছে।
মানুষের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। নচেৎ হারিয়ে যাবে সব কিছু। আর বসন্ত আসবে না। আসুন আমরা নিজেদের প্রয়োজনেই আল্লাহর সৃষ্ট জীবের প্রতি দায়িত্বশীল হই। বন্ধ করি সব অমানবিক কাজ কর্ম। রক্ষা পাক সৃষ্টিকুল। মানুষ বাঁচুক, সুন্দর হোক পৃথিবী। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করি। তিনি যেমন সুন্দর, আমরাও যেন পাপমুক্ত হয়ে সুন্দর থাকতে পারি। পরিবেশকে সুন্দর রাখতে পারি।
যাহোক বসন্ত বেঁচে আছে আজো মনে মনে বনে বনে-। বসন্ত আজো আমাদের মনে রঙ ধরায়।
তাইতো কবির ভাষায় বলতে হয়-

এলো বনান্তে পাগল বসন্ত।
বনে বনে মনে মনে রঙ সে ছড়ায় রে, চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।
বাঁশিতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,
পাণ্ডু-কপোলে জাগে রঙ নব অনুরাগে
রাঙা হলো ধূসর দিগন্ত।
কিশলয়ে-পর্ণে অশান্ত ওড়ে তা’র অঞ্চল প্রাস্ত।
পলাশ-কলিতে তা’র ফুল-ধনু লঘু-ভার,
ফুলে ফুলে হাসি অফুরন্ত।
এলো মেলো দখিনা মলয় রে প্রলাপ বকিছে বনময় রে।
অকারণ মন মাঝে বিরহের বেণু বাজে।
জেগে ওঠে বেদনা ঘুমন্ত।
(কাজী নজরুল ইসলাম)।


আরো সংবাদ



premium cement
রুশ অগ্রযাত্রার মধ্যেই ভারী হামলা প্রতিহত করল ইউক্রেন কাতার ছাড়তে হলে হামাসের পরবর্তী গন্তব্য কোথায় বগুড়ায় বসতবাড়িতে পটকা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণ, আহত ৪ নগরকান্দায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অগ্নিকাণ্ড মঙ্গলবারও ঢাকাসহ ২৭ জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ নাটোরে গণধর্ষণের দায়ে তিন কিশোরকে ১০ বছরের আটকাদেশ ঘাটাইলে সংরক্ষিত বনে দুর্বৃত্তের আগুন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জন্মদিন ও পতাকা অবমাননা মামলার শুনানি ২১ জুলাই ভালুকায় প্রচণ্ড তাপদাহে ২ শিক্ষার্থী অসুস্থ গাজীপুরে অপহরণের পর স্কুলছাত্রকে হত্যার দায়ে সাতজনের যাবজ্জীবন গাজার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে সৌদিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী

সকল