২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবিতার উপমা

-

হৃদয়ের গভীর অনুভূতি শব্দ-ছন্দ-অলঙ্কার এবং চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করাই হলো কবিতা। মনের ভিতর থেকে যে চিন্তাচেতনা বেরিয়ে আসে তা সোজাসুজি লিখলেই কবিতা হয় না। একটি সার্থক কবিতা লেখার পিছনে লুকিয়ে থাকে একজন কবির অফুরন্ত শ্রমের গল্প। একজন বোদ্ধা পাঠকের সামনে কোনো বিখ্যাত কবির উৎকৃষ্ট কবিতা এলেই তিনি সে-কবিতা পাঠ করতে করতে তৃপ্তির সমুদ্রে ডুবে যান। অথচ কবিতা লেখার পিছনে কবির প্রচণ্ড শ্রমের কথা কখনো ভেবেও দেখেন না। একজন প্রকৃত কবি কবিতা লেখার জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। তবে পরিশ্রমহীন কবির সংখ্যাই বেশি। যারা সারা জীবন লিখেও একটি উৎকৃষ্ট কবিতার জন্ম দিতে পারে না। কিন্তু কল্পনার জগতে তারা নিজেদের অনেক বড় কবি ভেবে থাকে। নিজেকে বড় কবি ভাবলেই তো বড় কবি হওয়া যায় না! বড় কবি হওয়ার জন্য অগাধ পরিশ্রম এবং সাধনার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কবিতার বিভিন্ন উপাদান সম্বন্ধেও থাকতে হয় ওয়াকিবহাল। অনেকেই কবিতা লিখলেও কবিতার উপাদান সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। বিশেষ করে অধিকাংশ তরুণ কবির ধারণা- লিখলেই কবিতা হয়। তারা কবিতার অনুষঙ্গ মানতে নারাজ। লিখলেই যদি কবিতা হতো, তবে সবাই কবিতার জন্ম দিতে পারত। সবাই কবি হতো। কিন্তু সবাই তো কবিতার জন্মদাতা হতে পারে না।
কবিতা এক অনন্য শিল্প। যিনি কবিতাকে ধারণ করেন তিনিই কেবল এই শিল্পের সুষমায় বিমূর্তকে মূর্তরূপে বিকশিত করেন। কবিতাকে যথার্থ অর্থেই শিল্প করে তোলে উপমা। জীবনানন্দের চিত্রকল্পগুলো শিল্প ও জীবনের সৌন্দর্যকে চিত্রিত করে তুলেছিল বলেই তা চিত্ররূপময়। উপমার সযতন বিন্যাসে নজরুলের কবিতার চরণগুলো হয়ে উঠেছে অপার্থিব। অন্যান্য লেখকও প্রচুর লিখেছেন উপমা নিয়ে। এখনো তাঁদের কলম ভীষণ রকম সচল। তাঁদের অনায়াস সৃজনশিল্পে বিশেষ একটি স্থান দখল করে আছে উপমা।
‘আয়ুর বয়স আলোর সমান’। আলো এখানে জীবনের প্রতীক হয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। আলো চমৎকারভাবে এখানে চিত্রিত করেছে জীবনের অনন্য ব্যাপ্তিকে। যত দিন আলো আছে জীবনে তত দিন আয়ুও আছে জীবনের দীপ হয়ে। তারই বিপরীতে তিনি রাতকে আবিষ্কার করেছেন অতৃপ্তির অপূর্ণতায়। আলোর আগমনে রাতের আয়ু ক্ষয় হয়। রাত তাই অতৃপ্ত থাকে ব্যাপ্তিতে, প্রাপ্তিতে। রাতের অতৃপ্তির সঙ্গে কবিও অতৃপ্ত।
মায়ের ক্রন্দন থেকে গর্জে ওঠে যে নদী
কোন তটরেখায় তা আছড়ে পড়ে মিছিল বিকেলে?
এখানে খুব সুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছে বিকেলের পরিচিতি। এই বিকেল গর্ভে ধারণ করে আছে মিছিলের সৃজনসত্তা। বিকেলের আগের মিছিল কথাটি পরিবেশনের মাধ্যমে অযুত-সহস্র মানুষের জমায়েতকে করে গর্জনময়।
‘একটি গোলকে পরম আটকে আছে কোট কোটি আলপিন’। বাস্তবিক পৃথিবীর বুকে মাধ্যাকর্ষণের কল্যাণে সবাই আটকে আছে আলপিনের মতো।
উপমায় কখনো কখনো কবিরা নিয়ে আসেন শ্লেষ, নিয়ে আসেন স্যাটায়ার। এই শ্লেষ ও স্যাটায়ার কবিতার দেহে জড়িয়ে হয়ে ওঠে শিল্প। ‘রক্তস্রোত বন্দনা শিল্পকাব্য’ ধরনের নতুন শব্দ প্রয়াসে শ্লেষ ও উপমা বাঙময় হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে জীবনানন্দের কৌশলও তার উপমার প্রকৌশলে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। একই শব্দের একাধিকবার ব্যবহারে জীবনানন্দ যেমন কখনো কখনো আকাশ ও তার ব্যাপকতাকে তুলে ধরেছেন তেমনি বক্ষ্যমাণ কবিরাও আঁধারের একাধিক ব্যবহারে বলে ওঠেন ‘আঁধার ফেটে যায় আরো দূর আঁধারে’। আঁধার তখন আঁধার না থেকে হয়ে যায় দারুণ এক চিত্রকল্প। একই পঙক্তিতে আঁধারের একাধিক ব্যবহার আঁধারের ব্যাপ্তি বাড়িয়ে নির্মাণ করে উপমার নান্দনিকতা। পাখি হয়েও উড়তে পারে না উটপাখিরা। তাদের ডানা আছে, জানা নাই উড়াল। এই উড়ালের জন্য তাদের সভা আহ্বান কবির দৃষ্টিতে নেহাত জরুরি হয়ে পড়েছে। কবির চোখে উটপাখিদের উড়তে না পারার ঘটনা কোনো নেহাত সাদামাটা ঘটনা নয়। বরং তাদের উড্ডয়ন শিল্প সময়ের হাতে লুট হয়ে গেছে। এখানে ‘লুট’-এর ব্যবহার তৈরি করেছে বিবর্তনবাদের ধারাবাহিকতা। তাই কবিতারা হয়ে উঠেছে চিত্রকল্পময়। ‘ঊনত্রিশে মার্চ বৃত্তান্ত’ কবিতায় কবি দুপুরকে উবে যেতে দেখেন। কর্পূর এর মতোই দুপুর যেন উদ্বায়ী হয়ে যায় ঘটনার পরমার্থে। ‘উদ্বায়ী দুপুর’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই নাকে আসে ন্যাপথালিনের সুঘ্রাণ আর জীবন্ত হয় সফেদ পুণ্যতা। ‘একান্ন দেহ’ কবিতাতে দেহকে একান্নতায় লালন-পালনের ধারণা দিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় লুপ্ত হওয়া আগেকার একান্নবর্তী পরিবারকেও চোখের সামনে হাজির করে। সত্যিকার অর্থেই দেহ একটি একান্নবর্তী পরিবার। সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-কোষ-কলা সবই এখানে একটি মাত্র পরিবার হয়ে মায়া-মমতায় সুশৃঙ্খল হয়ে আছে।
কবিদের উপমারা সবসময় যে গতিকেই ধারণ করে তা নয়। কখনো কখনো উপমারা নস্টালজিক হয়ে যায়। তাদের নস্টালজিয়া ছবির রিঙ্কলস-এ জমে থাকা ধুলো ঝেড়ে জীবন ফিরে পায়। চিত্রকল্প নির্মাণে প্রেমের ব্যবহার কবির হাতে ফুটেছে সাবলীলতায়। তরুণীর প্রেমে মজে ওঠা কবি পঙ্ক্তিতে ফুটিয়ে তোলেন ধাবমান রেল যার বাইরে চারআনা বা সিকিমূল্যের প্রেমিক পৌনে এক টাকার বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রেমিকার বিচ্ছেদে আত্মসমবেদন খুঁজে পান। প্রাণহীন পাথরও প্রাণবন্ত হয়ে যায় উপমার গুণে। আর তাতে যদি নারীর স্পর্শ থাকে তবে পাথরেও ফোটে ফুল।
আড্ডা আর আলাপনের কথা উঠলে চায়ের কাপে ঝড়ের উপমা আসে। কিন্তু কবি ঝড় না, চায়ের কাপে বর্ষাকে খুঁজে পান উপমায়। সুদিনগুলোতে চায়ের পিপাসা মেটাতো অবিরল ধারার বর্ষার মতো চা আপ্যায়নে। কিন্তু এখন দিনগুলো ডানাগোটানো, প্রতিকূল। তাই চায়ের কাপে আজ আর বর্ষা আসে না। উপমার অনিন্দ্য প্রয়োগে চা নয়, বর্ষাই বেজে উঠেছে টিপ টিপ বৃষ্টির সুরে পাঠকের শ্রবণে।
উপমায় কবিরা প্রেমের কোমলতা ছেড়ে হয়ে ওঠেন ক্রমশ সাহসী। কবিদের সাহস অঙ্কুরিত হতে হতে এক সময় বলে ওঠে ‘মানুষের জিহ্বায় মেরুদণ্ড গজাতে শুরু করেছে।’ মানুষ আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সাহসী হয়। তখন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। নচেৎ বাঙালি সর্বদা তোয়াজ আর তেলে অভ্যস্ত। কিন্তু জিহ্বায় যদি মেরুদণ্ড গজায় অর্থাৎ মানুষ যদি কথায় তার দৃঢ়তা ও সাহস বজায় রাখে তবে তাতে সার্থক হয়ে ওঠে মনুষ্যত্ব। কবির উপমারা সাহসী হওয়ার পর খুঁজে পায় প্রজ্ঞায়। প্রজ্ঞা-দৃষ্টি পেয়ে উপমারা বলে, ‘সাঁওতাল শিশু রোদের সতীর্থ’। অর্থাৎ রোদ যেমন আঁধার তাড়ায়, হেসে লুটোপুটি খায় ঘাসে, সাঁওতাল শিশুটিও তেমনি রোদের মতোই নির্মল, প্রাণবন্ত। রোদের শিক্ষক প্রকৃতি আর সাঁওতাল শিশুটিকেও বড় করে তোলে নিসর্গবিদ্যালয়ে। কবিরা পাঠ নেন নিসর্গ থেকে। কবিরা দেখতে পান উড়ে যাওয়া যুগল শাবকের মধ্যে যুগল ব্যঞ্জনবর্ণ। সন্ধ্যা যখন কবির কল্পনায় জলজ হয়ে ওঠে তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না এই সন্ধ্যা বিকেল গড়িয়ে আসে বলেই জলের মতো উপমায় মূর্ত হয়।
‘আমি বুড়ো ক্লাউনের মতো পরিত্যক্ত এবং তুষারে ঢাকা
নিষ্পত্র গাছের মতো শীতার্ত।’
(একটি প্রস্থান, তার অনুষঙ্গ, শামসুর রাহমান)।
এখানে একাধিক উপমান- ‘বুড়ো ক্লাউন’, ‘তুষারে ঢাকা নিষ্পত্র গাছ’, উপমেয়- ‘আমি’, সাধারণ ধর্ম- ‘পরিত্যক্ত’, ‘শীতার্ত’, তুলনাবাচক শব্দ- ‘মতো’।
‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়’
(আসাদের শার্ট, শামসুর রাহমান)।
এখানে একাধিক উপমান- ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবী’, ‘সূর্যাস্তের জ্বলন্ত মেঘ’, উপমেয়- ‘আসাদের শার্ট’, সাধারণ ধর্ম- ‘উড়ছে’, সাদৃশ্যবাচক শব্দ- ‘মতো’।
উপমা প্রয়োগে একটি কবিতা সুন্দর ও সার্থক হয়ে ওঠে। উপমা অনেকটা নারীর প্রসাধনীর মতো। উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে একজন কবি তার কবিতাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সক্ষম হন। বয়সের ভারে একজন কবির কবিতা সেরা হয় না। বয়স বিবেচনা করলে সুকান্ত, কীটস, শেলী এবং আবুল হাসান কবি হতে পারতেন না। কবিতার উপাদান থাকলেই কেবল কবিতা ভারী এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে উপমা কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
তাই কবিদের উপমারা কখনো গতিমান, কখনো নস্টালজিক আবার কখনো আধুনিক এবং উড়ালমুখী। কবির কবিতার নির্মাণে তার উপমা ও চিত্রকল্পসমূহ তৈরি করে নিপুণ গাঁথুনি এবং সবশেষে শব্দকে শব্দের অধিক শিল্প করে তোলে।


আরো সংবাদ



premium cement