২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কাঁদছেন ওদের মা-বাবাও

নারায়ণগঞ্জ
সুমাইয়া-খাদিজা-মাহমুদা-মরজিনা - ছবি: সংগৃহীত

দুর্বৃত্তের আগুনে দগ্ধ হয়ে পাঁচ দিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগের পর মারা গেছেন ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। তার বাবা-মায়ের কান্না দেখেছে দেশবাসী। ব্যাথিত হয়েছে সবাই। এ কান্নায় যুক্ত হয়েছে সুমাইয়া, খাদিজা, মাহমুদা ও মরজিনার বাবা-মায়ের কান্না। তবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নয়, ওরা মারা গেছে সংসারজীবনের অশান্তি আর নির্যাতনের আগুনে। এদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে স্বামীর ঘর থেকে।

টিভি কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নুসরাতে জন্য যখন তার বাবা-মায়ের আর্তনাদ দেখেছেন তখন এদের বাবা-মাও অকালে প্রাণ হারানো নুসরাতের সমবয়সী সন্তানের জন্য অঝোরধারায় কাঁদছেন।

ঝরা
হাতে বিয়ের মেহেদী রং মুছতে না মুছতেই ২৬ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জ শহরের ছোট ভগবানগঞ্জের (খোয়ারপট্টি) স্বামীর ঘর থেকে লাশ হয়ে বের হলো গৃহবধূ সুমাইয়া। বিয়ের মাত্র এক মাসের মাথায় দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হলো। ২২ ফেব্রুয়ারি রঙিন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল সুমাইয়া। আমেরিকা প্রবাসী ফায়াদ আহামেদ বাবুর সাথে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর বিদেশ চলে যায় বাবু।

খোয়ারপট্টির জামান ডাক্তারের বাড়ির তৃতীয় তলার চিলেকোঠা থেকে ২৬ মার্চ রাত একটায় গৃহবধূ সুমাইয়ার লাশ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার দারোগা আমিনুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

এমন ঘটনার খবর পেয়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার রামপাল থেকে ছুটে আসেন পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেয়ার মাত্র এক মাসের মধ্যে লাশ হতে হওয়ার ঘটনায় নিহতের বাবা-মা, ভাইয়ের কান্নায় ছোট ভগবানগঞ্জের বাতাস ভারী হয়ে উঠে।

নিহতের বাবা আবদুর রহিম রাঢ়ী ওরফে সেন্টু জানান, ফায়াদ আহমেদ বাবুর সাথে বিয়ে দিতে নানাভাবে চেষ্টা চালানোর পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়। এক মাসের মধ্যেই বিদেশ চলে যায়। এরপর থেকেই ফায়াদ আহামেদ বাবুর বাবা ফারুক হোসেন ও মা আজমিরী বেগম, বোন ও বোনজামাই শোলক আহমেদ নানাভাবে ঝরাকে নির্যাতন শুরু করে। সুমাইয়ার ননদের স্বামী শোলক আহমেদ নানাভাবে অত্যাচার চালিয়ে আসছিলো বলেও মায়ের কাছে অভিযোগ করেছিলো ঝরা।

অগ্নিদগ্ধ নুসরাতের মৃত্যুর খবরে তাদের মেয়ে সুমাইয়ার কথা মনে পড়ে বাবা আবদুর রহিম রাঢ়ী, মা নাজমা বেগম, একমাত্র ভাই রিংকুসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের। সুমাইয়ার কথা মনে করে তারা চোখের পানিতে বুক ভাসায়।

আবদুর রহিম রাঢ়ী ওরফে সেন্টু জানান, আমার মেয়ের মতোই নুসরাত। ও আগুনে পুড়ে নির্মমভাবে মারা গেছে পত্রপত্রিকায় টিভিতে ছবি দেখেছি। ওকে দেখে আমার মেয়ের কথা মনে যায়। বিয়ের মাত্র এক মাসে আমার মেয়েটা মারা গেলো। মানতে পারছি না।

খাদিজা
১২ দিন মুমূর্ষ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকার পর ১৪ মার্চ সকালে মারা যায় ফতুল্লা কাশিপুর হাটখোলা এলাকার গৃহবধূ খাদিজা আক্তার। স্বামী ও শ^শুরবাড়ির লোকজনের নির্মম নির্যাতনের পর মারা যায় খাদিজা। নির্যাতনে খাদিজার গলার হাড় ভেঙ্গে যায়। মুমূর্ষ অবস্থায় খাইয়ে দেয়া হয় হারপিক। খাদিজাকে হত্যার অভিযোগে স্বামী ফরহাদ ও ভাসুর রাব্বীকে ৫এপ্রিল গ্রেফতার করে পুলিশ।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ফতুল্লা থানার এস আই আরিফুর রহমান জানান, খাদিজাকে হত্যার পর থেকে পলাতক ছিল স্বামী ফরহাদ ও ভাসুর রাব্বী।

খাদিজার মা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আমার মেয়েকে ওরা অনেক কষ্ট দিয়েছে। কত না ছটফট করেছে আমার মা! গলাটিপে গলার হাড় ভেঙ্গে ফেলেছে। তারপরও যখন মরেনি, তখন হারপিক খাইয়ে দেয়। শেষবারের মতো কথাও বলতে পারেনি।’

নুসরাতের কথা তুলতেই খাদিজার মা বলে উঠেন, ছবি দেখলাম মেয়েটা আমার মেয়ে খাদিজার মতোই। আর কোনো মেয়েকে যেন এভাবে অকালে মারা যেতে না হয়।

মাহমুদা
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার গোগনগর এলাকার একটি ফ্ল্যাট বাসা থেকে মাহমুদা আক্তার নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে অবস্থিত ‘টপটেন’ নামক তৈরি পোশাক বিক্রির চেইন শপের বিক্রয় কর্মকর্তা ছিলো সে।

স্থানীয়রা জানায়, মাহমুদার স্বামী তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে বাসার বাইরে থেকে তালা দিয়ে মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। স্বামী ও সন্তানের খোঁজে মাঠে নেমেছে পুলিশ।

নুসরাতের মতোই একই বয়সের মাহমুদা গোগনগর আলামিন নগর এলাকার মোহাম্মদ আলী আকবরের তিন তলার ভবনের নিচ তলার ফ্ল্যাট বাসায় থাকাতো।

মরজিনা
নারায়ণগঞ্জর সোনারগাঁ পৌরসভার টিপুরদী এলাকায় ৭ এপ্রিল সকালে মরজিনা আক্তার (১৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মরজিনা আক্তারের মা আছমা বেগম জানান, উপজেলার টিপুরদী এলাকায় জাহের আলীর বাড়িতে বাসা ভাড়া নিয়ে মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন। রোববার সকালে তিনি রান্না করার সময় মরজিনা আক্তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করে। মরজিনার অকালে মরে যাওয়া মেনে নিতে পারেনি মা আছমা আক্তার। নুসরাতের কথা শুনে আছমা বেগম তার মেয়ের জন্য এসময় তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।

নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন মানবাধিকার নেত্রী সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, প্রতিটা হত্যার উপযুক্ত বিচার হওয়া উচিত। নুরসাতের নির্মম খুনের সাথে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত বিচার করা রাষ্টের দায়িত্ব। তেমনি নারায়ণগঞ্জের সুমাইয়া, খাদিজা, মাহমুদা, মরজিনাদের মুত্যৃর জন্য যারাই দায়ী তাদেরও বিচার হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কাউন্সিল (বামাকা) বন্দর থানা সেক্রেটারি সাব্বির আহমেদ সেন্টু নয়া দিগন্তকে জানান, অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নুসরাতের ক্ষেত্রে যেমন তেমনি সুমাইয়া, খাদিজা, মাহমুদা, মরজিনাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসা দরকার।


আরো সংবাদ



premium cement