২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


গরমকাল বেশি লম্বা হওয়ায় বাংলাদেশে যা ঘটছে

গরমকাল বেশি লম্বা হওয়ায় বাংলাদেশে যা ঘটছে - ছবি : নয়া দিগন্ত

গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সাল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এবার ২০২৪ সালও সেই ধারাবাহিকতার দিকেই এগোচ্ছে, অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো বটেই।

বলা হচ্ছে ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে গ্রীষ্ম, অর্থাৎ গরমকালের দৈর্ঘ্য বেড়েছে। আগে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও এখন সবঋতুতেই তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি থাকছে।

শুধু তাই নয়, গরমের সময়সীমার তারতম্যের পাশাপাশি বর্ষাকালের ক্ষেত্রেও বড়সড় পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ, মৌসুমি বায়ু দেরিতে প্রবেশ করায় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্ষাকাল পিছিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু বর্ষাকাল দেরিতে শুরু হওয়া মানে বাংলাদেশের কৃষিখাতের জন্য তা জোরালো এক ধাক্কা।

এসব চিত্র ও সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে ‘বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল জলবায়ু : আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের প্রবণতা এবং পরিবর্তন’ শীর্ষক জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক এক গবেষণায়।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ মো: বজলুর রশীদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও নরওয়ের আরো পাঁচজন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ এই গবেষণাটি করেছেন।

গবেষক দলের বাকিরা হলেন বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা, এস এম কামরুল হাসান এবং নরওয়ের আবহাওয়াবিদ এলিনা কোয়া, কাজসা পারিং ও হ্যান্স ওলাভ হাইজেন।

গত ৪৩ বছর অর্থাৎ চার দশকেরও বেশি সময়কালের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত, মোট তিন বছর ধরে তারা এই গবেষণাটি করেছেন।

তাপপ্রবাহ বাড়ছে
গবেষণাটি করার জন্য তারা একটি বছরকে চারটি সময়ে ভাগ করেছেন এবং আবহাওয়া অধিদফতরের ৩৫টি স্টেশনের ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের প্রতিদিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করেছেন।

ভাগ করা সময়গুলো হলো শীতকাল (ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি), প্রাক-বর্ষা (মার্চ, এপ্রিল ও মে), বর্ষা (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) এবং বর্ষা-পরবর্তী (অক্টোবর ও নভেম্বর)।

এখন বিশ্লেষণে বছরের ওই চার সময়েই তাপমাত্রা পরিবর্তনের দিকটি উঠে এসেছে।

এতে দেখা যাচ্ছে, বছরের প্রতি ঋতুতেই তাপমাত্রা আগের তুলনায় বাড়ছে। বিশেষ করে গত ১০ থেকে ১২ বছর ধরে তাপপ্রবাহের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বাংলাকে বলেন, ‘এখন সিজনাল প্যাটার্ন চেঞ্জ হচ্ছে। আগে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে তাপদাহ হতো। কিন্তু ইদানীং সেটা বেড়ে অক্টোবর পর্যন্ত চলছে। গত ১০ থেকে ১২ বছরে তাপদাহ-র সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে।’

তিনি বলেন, যে ২০২৩ সালের মতো এ বছরও তাপপ্রবাহ আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি প্রকট। ২০২৩ সাল ছিল উষ্ণতম বছর, গত বছর দীর্ঘ সময় হিটওয়েভ ছিল। জুন মাসে দুই সপ্তাহ ধরে হিটওয়েভ ছিল। ওই সময় দেশের কয়েক জায়গায় ৪০ ডিগ্রির ওপরে তাপমাত্রা ছিল। এই ধরনের হিট ওয়েভ কন্ডিশন ২০২৪ সালেও আসার সম্ভাবনা প্রকট। মার্চের মাঝামাঝি থেকে একটা বড় ধরনের হিটওয়েভের সম্মুখীন হতে পারি আমরা।’

এই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে ঢাকায় মার্চের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তাপপ্রবাহ শুরু হলেও ১৯৯৭ সালের পর থেকে এতে ভিন্নতা দেখা গেছে।

এখন রংপুর, খুলনাসহ প্রায় সব বিভাগে বর্ষা মৌসুমেও তাপপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে।

বর্ষাকাল পিছিয়ে যাচ্ছে
বিভিন্ন ঋতুতে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার বর্ষাকাল পিছিয়ে যাচ্ছে এবং বৃষ্টিপ্রবণতা কমে যাচ্ছে।

সাধারণত মে মাসের শেষের দিক থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহের মাঝে বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে এবং সেপ্টেম্বরের মাঝে তা চলে যাওয়ার কথা।

কিন্তু এই গবেষণা অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকে বর্ষা আসতে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর বর্ষা এসেছে আটই জুন।

এ দিকে বর্ষা যেমন দেরিতে আসছে, তেমনি যাচ্ছেও তা দেরি করে।

গবেষণা বলছে, গত ১০ বছরে কখনও কখনো ২৩ অক্টোবর পর্যন্তও মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ছিল।

গত বছর বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেছিলেন, ‘বর্ষাকালের এই পরিবর্তন ২০০৩ সাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি। কারণ যে অ্যাকসিসে মনসুন সিস্টেম থাকে, সেটা দক্ষিণ দিকে এক থেকে দুই ডিগ্রি সরে গেছে। এর ফলে আমাদের এলাকায় বর্ষাকালে বৃষ্টির হার কমে গেছে।’

অর্থাৎ যে মৌসুমি বায়ুর কারণে বৃষ্টি হয়ে থাকে, সেটা অনেক সময় উত্তর বা দক্ষিণে অবস্থান নিয়ে থাকে। এটা যদি দক্ষিণ দিকে বেশি সময় থাকে, তাহলে বাংলাদেশ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়।

রশীদও এ বিষয়ে বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মুনসুন অনসেটের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ, বর্ষাকালে বৃষ্টিপ্রবণতা কমে গেছে।’

কিন্তু অসময়ে ভারি বা কম বৃষ্টিপাত হলে তাতে একটা দেশের কৃষিখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কারণ ফসলের মৌসুমে বৃষ্টি না হলে ফসল বাঁচবে না, তখন সেচের প্রয়োজন হবে। আর সেচ দিতে গেলে প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়বে।

তিনি বলেন, ‘এর বড় প্রভাব পড়বে কৃষি খাতে। কারণ এ সময় সেচের প্রয়োজন হবে। তাই পাওয়ার সেক্টরে এর বড় একটা ইম্প্যাক্ট আসবে। কারণ যদি হিট ওয়েভ বেড়ে যায়, পাওয়ার কনজাম্পশন বেড়ে যাবে।’

অস্বাভাবিক শৈত্যপ্রবাহ
গত ৪৩ বছরে শীতের ক্ষেত্রেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগে ডিসেম্বরের আগে থেকেই ঢাকায় শীত পড়ত।

কিন্তু ২০২৩-২০২৪ সালের শীত মৌসুমে মধ্য ডিসেম্বরেও ঢাকায় শীত অনুভূত হয়নি।

অথচ, এই গবেষণা অনুযায়ী আগে ঢাকায় জানুয়ারিতে শৈত্যপ্রবাহ হত। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকেই জানুয়ারি মাসে ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহের পরিমাণ কমে গেছে।

আবার জানুয়ারিতে শৈত্যপ্রবাহ হলেও তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামছে না। অথচ, মানুষের শীত শীত অনুভূতি বেশি হচ্ছে।

অন্য বছরের তুলনায় এ বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালেও খাতায় কলমে তাপমাত্রা খুব একটা নিচে নামেনি। কিন্তু পুরো জানুয়ারি মাস জুড়েই শীতের তীব্র অনুভূতির কথা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিল মানুষ।

শীতের এই অস্বাভাবিক আচরণ প্রসঙ্গে আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলেন, ‘শীতেরও বড় ধরনের প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে শৈত্যপ্রবাহ ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে যাচ্ছে না। দিনের তাপমাত্রা যেখানে ২৫ থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামার কথা না, সেখানে সেটি ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, দিনের তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। অথচ রাতের তাপমাত্রা আবার বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে শীত বেশি লাগছে।’

এছাড়া ডিসেম্বর মাসে যেখানে শীত পড়ার কথা, সেখানে এই সময়ে সাইক্লোন হওয়ার বিষয়টিও নেতিবাচক মনে করছেন এই আবহাওয়াবিদ।

তিনি বলেন,‘গত ডিসেম্বরে সাগরে সাইক্লোন সৃষ্টি হয়েছে, এর প্রভাবে বৃষ্টি হয়েছে। গত বছর চারটা সাইক্লোন আঘাত করেছে। অথচ বছরে সাইক্লোন সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনটা হয়।’

আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিকতা কেন
২০১০ সালের পর ঢাকা বিভাগে অক্টোবর মাস পর্যন্ত অস্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকার মূল কারণ হিসেবে দূষণকে চিহ্নিত করেন আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ।

তিনি বলেন, ‘তাপমাত্রা পরিবর্তনের অনেকগুলো প্যারামিটার আমরা বিশ্লেষণ করেছি। যেমন, সূর্যের কিরণকাল কমে যাচ্ছে, ক্লাউডিনেস বেড়ে যাচ্ছে, দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাচ্ছে, ফগি কন্ডিশন বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মূল কারণ হলো দূষণ। দূষণ বেড়ে গেলে ক্লাউড ফরমেশনও বেড়ে যায়। এখানে ট্রান্স-বাউন্ডারি পলিউশান যুক্ত হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দেখেছি, এ বছর জানুয়ারিতে দিনের তাপমাত্রা অনেক কম ছিল, আবার রাতের তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু দিনের তাপমাত্রা কম থাকার কারণে দিন ও রাতের তাপমাত্রার ব্যবধান কমেছে। এক্ষেত্রে শীতের যে তীব্রতা, তা আমরা টের পেয়েছি। এটি গত কয়েক বছর ধরেই চলছে।’

এই ধরনের আবহাওয়া ঠিক করার জন্য তিনি দূষণ কমানোকে প্রাথমিক করণীয় বলে মনে করেন।

ঢাকা-সহ সারাদেশের দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস হলো ইটের ভাঁটা ও নির্মাণ সাইট থেকে সৃষ্ট ধুলাবালি ও বায়ু দূষণ। এটি নিরসনে তিনি গাছ লাগানোসহ অন্য কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দেন।

একইসাথে শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য জলাধার খনন করাও জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement