রাজধানী ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ভূমি জালিয়াত চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এলাকার সাধারণ মানুষ। তারা ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ঘুরছে বিভিন্ন মহলে। শাসক দলের পদবি, দলীয় শক্তি ও কালো টাকার প্রভাব খাটিয়ে সরকারি সম্পত্তি, ডোবা নালা খাল, জলাশয়সহ সাধারণ মানুষের সম্পদ দখল করা হচ্ছে। দখলের পর ভূমি অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় দখলকৃত জমির জাল দলিল তৈরি করে তা আবার বিক্রি করে দিচ্ছে অন্য কারো কাছে। এই জালিয়াত চক্রের সাথে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ওয়ার্ড পর্যায়ে নেতাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন দফতরে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন সময় অভিযোগ দেয়া হলেও কোনো কাজ হয়নি। আর এই সুযোগে চক্রটি গত কয়েক দশকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। অন্য দিকে সম্পদ হারিয়ে পথে বসেছে চর এলাকার শতাধিক মানুষ।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে জানা যায়, বুুয়েটের সিনিয়র টেকনিশিয়ান আব্দুল করিমের স্ত্রী বানু বিবির চার কাঠা জমি দখল করে নেন ৫৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল দেওয়ান। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে সিটি জরিপের সময় আব্দুল করিম পরিবারের সদস্যরা সেখানে না থাকায় বানু বিবি সিটি জরিপে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ৫৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা জামাল দেওয়ান আগের সিএস রেকর্ডীয় মালিকের মেয়ে গোলবনকে মালিক সাজিয়ে তার কাছ থেকে ভুয়া আমমোক্তারনামা নিয়ে সিটি জরিপে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে বানু বিবির জমি চার কাঠা দখল করে নেন। এ ব্যাপারে বানু বিবি প্রথমে শরণাপন্ন হন লালবাগের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের কাছে, সেখান থেকে রায় জামাল দেওয়ানের বিপক্ষে গেলেও তিনি জমি ছাড়েনি। পরে বানু বিবি তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশারোফ হোসেনের শরণাপন্ন হলে তিনি তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ও ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে বিষয়টি মীমাংসার জন্য দায়িত্ব প্রদান করেন। অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম দুই পক্ষের অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে কাগজপত্র দেখে ও স্থানীয় ডিড রাইটার দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বানু বিবির পক্ষে রায় দেন। জামাল দেওয়ান এই রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গোপনে জমিটি অন্য কারো কাছে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্য ধরে মৌখিক ১০ লাখ টাকা বায়না গ্রহণ করে বিক্রি দেন। এ ঘটনা বানু বিবির সন্তান মো: রহমত উল্লাহ জানার পর তাদের সম্পদ যাতে কেউ কিনতে না আসে সে লক্ষ্যে বাড়ির সামনে মালিকানার সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেন। এতে জামাল দেওয়ান ক্ষিপ্ত হয়ে দলবল নিয়ে জমিটি দখল করে নেন।
নাম না বলার শর্তে কামরাঙ্গীরচরের একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, ৫৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল দেওয়ান ও তার ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বসতবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন শতাধিক নিরীহ মানুষ। তার কাছে দলীয় কর্মীরা পর্যন্ত নিগৃহীত। অবৈধ টাকায় কামরাঙ্গীরচর থানার পশ্চিম রসুলপুরস্থ ট্যানারির পুকুর পাড় এলাকায় লাকী মঞ্জিল নামে চার কাঠা জমির ওপর আটতলা ভবন, একই এলাকায় দেওয়ান মঞ্জিল নামে দুই কাঠা জমির ওপর ৬ তলা ভবন, চার কাঠা জমির ওপর দেওয়ান সুপার মার্কেট রসুলপুরস্থ ট্যানারির মেইন রোড রহমত আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে দুই কাঠা জমির ওপর সাততলা ভবন, মধ্য রসুলপুরে সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর একতলা ভবন এবং লালবাগ থানার শহীদ নগর ৭ নং গলিতে রয়েছে দুইতলা পাকা ভবন। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জে রয়েছে তার নামে-বেনামে শতাধিক বিঘা সম্পত্তি।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল দেওয়ানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কথা অস্বীকার করে বলেন, আমার কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী নেই। আমি কোনো দখলের সাথেও জড়িত নই। আমি জমির মৃত মূল মালিকের মেয়ে গোলবনের কাছ থেকে ২০১৬ সালে জমি ক্রয়ের ভোগ দখলে আছি। আমার নামে হোল্ডিং খাজনা, বিদ্যুৎ বিল আছে। জাল দলিলের মাধ্যমে জমি দখলের পর তিনি বলেন, আদালতে মামলা চলছে। যদি আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন, তাহলে জমির দখলদারিত্ব তাদের বুঝিয়ে দেয়া হবে।
কামরাঙ্গীরচরে ভূমি জালিয়াত চক্রের আরেক হোতা শেখ আনোয়ার হোসেন আনু। তার বিরুদ্ধে সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আশরাফ আলী আজম ও তার ভাই মীর নেওয়াজ আলীর ওপর হামলা ও হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার অভিযোগসহ লালবাগ-চকবাজার ও কামরাঙ্গীচর থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
ভুক্তভোগী একজন বাড়ির মালিক জানান, ১৯৫২ সালে আনোয়ার হোসেন আনুর দাদা, পিতা ও চাচা মিলে তাদের ৪৬ শতাংশ জমি বিক্রির করে। কিন্তু আনু ভয়ভীতি দেখিয়ে ২০ বছর ধরে দফায় দফায় অসহায় বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি এই চক্রটি পরিকল্পিতভাবে দলবল নিয়ে রাতে আপন বৃদ্ধা মা সখিনা বেগম ও স্ত্রীকে কৌশলে কামরাঙ্গীরচরের স্থানীয় ডা: ওয়াহিদুজ্জামানের বাড়িতে জোরপূর্বক ঢুকিয়ে তার বাড়ি দখলে নেন এবং ডা: ওয়াহিদুজ্জামানের সাইন বোর্ড ও বৈদ্যুতিক মিটার খুলে নিয়ে যায়। দখলের খবর কামরাঙ্গীরচর থানায় জানানো হলে থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন পুলিশের উপস্থিতিতে আনোয়ার হোসেন আনুর মা এবং স্ত্রীকে তাদের দখলকৃত বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনার আনুর বিরুদ্ধে কামরাঙ্গীরচর থানায় মামলা হয়েছে। তবে আনোয়ার হোসেন আনুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিলি বলেন, ঘটনাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। স্থানীয় ৫৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন ও তার বাহিনী তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তাকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেন। সত্যতা প্রমাণের জন্য তার কাছে ভিডিও ফুটেজ রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। এ ছাড়া তিনি কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) দফতরে অভিযোগ এবং গত বুধবার ঢাকা ম্যাজিস্ট্রেট ৪ নম্বর কোর্টে মামলা করেছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৬ নং কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে নয়া দিগন্তকে বলেন, আনোয়ার হোসেন আনু একজন সন্ত্রাসী। তার রয়েছে জালাল দেওয়ান, আলী আহমদ, আমিনুল আলী ও নিজ নামে বাহিনী। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে পশ্চিম আশ্রাফাবাদ এলাকায় প্রায় ২০টি বাড়িওয়ালাকে প্রায় ২০ বছর যাবৎ জিম্মি করে রাখার অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া কামরাঙ্গীচরের ম্যাচ ফ্যাক্টরি, ব্যাটারিঘাট, বড়গ্রাম, রুপনগর এবং কামরাঙ্গীরচর সরকারি হাসপাতাল সংলগ্ন ও কামরাঙ্গীরচর নতুন বিদ্যুৎ অফিস এলাকায় চরকামরাঙ্গী মৌজার ১১৮১ ও ৭২৯ এসএ দাগের প্রায় ১০ একর সরকারি খাস জমি দখল হয়ে গেছে। দখলের পর জেলা প্রশাসক ও ভূমি জরিপ অফিসের এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জমির ভুয়া মালিকানা তৈরি করে শতাধিক মানুষের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই দখলের সাথে কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন সরকার, সাধারণ সম্পাদক সোলেমান মাদবরসহ ওয়ার্ড পর্যায়ে নেতাদের নাম জড়িত রয়েছে।
তবে দখলের ব্যাপারে কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন সরকার বলেন, আমি কোনো দখল রাজনীতির সাথে জড়িত নই। আমি ক্লিন ইমেজের লোক। এসব দখলের সাথে জড়িত রয়েছে নতুন আওয়ামী লীগ করা নেতারা। কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলেমান মাদবরও দখলের কথা অস্বীকার করে বলেন, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় অনেক খাস জমি দখল হয়ে গেছে। বর্তমানে দখলের সাথে অনেক আওয়ামী লীগের নেতা জড়িত থাকলেও তিনি দখলের সাথে জড়িত নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা