২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বলিউডের অনেক তারকাদের মধ্যে অবসাদ ও আত্মহত্যার প্রবণতা কেন?

- ছবি - ইন্টারনেট

সম্প্রতি আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় ছিল, ‘আধ্যাত্মিকতা আর জীবন’। বিশেষ অতিথি ছিলেন অস্কার জয়ী সঙ্গীতকার এআর রহমান। ছেলেবেলায় সম্মুখীন হওয়া লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন এক সময় তিনি নিজেকে শেষ করে দিতে ছেয়েছিলেন।

অক্সফোর্ড ইউনিয়ন ডিবেটিং সোসাইটির ওই অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সাথে ‘আধ্যাত্মিকতা এবং জীবন’ নিয়ে কথোপকথনের সময় তিনি জানিয়েছেন, মায়ের বলা কয়েকটা কথা নিজেকে শেষ করে দেয়ার চিন্তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে তাকে শক্তি জুগিয়েছিল। রসদ দিয়েছিল বেঁচে থাকার।

এআর রহমান একা নন, মানসিক অবসাদ এবং আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে নিজেদের লড়াইয়ের কথা বলতে শোনা গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তারকারাদের।

এই তালিকায় রয়েছেন অভিনেতা ডোয়েন জনসন এবং লেডি গাগা, বিয়ান্সে, অ্যাডেল-এর মতো গায়িকারা, হ্যানামন্টানা খ্যাত মাইলি সাইরাস-সহ অনেক হলিউড তারকারাই। রয়েছেন, বলিউডের একাধিক সেলেব্রেটিও।

‘যে সময়টাতে আত্মহত্যার চিন্তা আসত…’
চরাই উতরাইয়ের কথা বলতে গিয়ে খ্যাতির শীর্ষে দাঁড়িয়ে থাকা এআর রহমান যে হতাশা, অবসাদ বা আত্মহত্যার চিন্তা কথা অকপটে বলবেন তা হয়তো আশা করেননি অনুষ্ঠানে উপস্থিত কেউই।

বাবাকে অল্প বয়সে হারানোর পর তাকে আর তার পরিবারকে আর্থিক সমস্যা-সহ একাধিক বাধা বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

ছোটবেলা থেকে চলে আসা নিজের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে এআর রহমান বলেন, ‘যে সময়ে আমার আত্মহত্যার কথা মনে হতো… যে সময়ে আমার বয়স কম। তখন মা বলতেন, যদি তুমি অন্যের জন্য বাঁচো, তাহলে এই সব চিন্তা আর মাথায় আসবে না। এটা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আমার জীবনের অন্যতম সবচেয়ে সেরা উপদেশ।’

অক্সফোর্ড শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ এআর রহমানকে প্রশ্ন করেছিল আধ্যাত্মিক বিষয়ে। সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জীবনযুদ্ধের আরো একটা পাতা উল্টে দেখেন তিনি।

এ আর রহমান বলেন, ‘আমরা সবাই অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে যাই। আমরা এই পৃথিবীতে ছোট সফরে এসেছি এবং এটাই একটা ধ্রুব সত্য। আমরা জন্মেছি, আমরা চলেও যাব। এটা আমাদের স্থায়ী জায়গা নয়।’

মানসিক অবসাদ নিয়ে কথা বলেছেন যারা
বলিউড অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোন বছরখানেক আগে মানসিক অবসাদ নিয়ে প্রথমবার কথা বলেছিলেন।

একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটা শুরু হয়েছিল। একদিন সকালে উঠে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। এমন একটা অনুভূতি যা আগে কখনো হয়নি। এরপর বেশ কয়েকদিন ভেতরা শূন্য মনে হচ্ছিল, দিশাহীন, কোনো লক্ষ্য নেই।’

‘সবকিছুই অর্থহীন যেন। শারীরিক বা মানসিকভাবে কিছুই যেন অনুভব করতে পারছিলাম না। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। যার এই অনুভূতি হয়নি, তাকে বুঝিয়ে বলাটা কঠিন পুরো বিষয়টা,’ বলেছিলেন দীপিকা।

অভিনেত্রীর মা প্রথমে লক্ষ্য করেন বিষয়টা।

‘মা সবার আগে বুঝতে পারেন এই কান্নাটা অন্যরকম। এটা কিন্তু কাজ বা প্রেমিক সংক্রান্ত বিষয় নয়। মা ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করতে থাকেন আমায়। আমি কোনো নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারিনি। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেয়ার কথা বলেন তিনি।’

তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও ছিল। তিনি বলেন, ‘এক এক সময় আত্মহত্যার কথাও মাথায় আসতো।’

এছাড়াও ম্রুণাল ঠাকুর, মিত সাধের মতো একাধিক তারকারাও আত্মহত্যার প্রবণতার কথা জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খানের মতো একাধিক বিখ্যাত বলিউড তারকারা তাদের জীবনযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে হতাশা, অবসাদের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

তার সংস্থা এবিসিএল-এর ভরাডুবির পর আর্থিকভাবে অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সে সময়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তবে হাল ছেড়ে দেননি। আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।

বলিউডের বাদশাহ হিসেবে পরিচিত শাহরুখ খানও হতাশার সম্মুখীন হন। কাঁধে চোট লাগার পর আগের মত পারফর্মেন্স করতে পারবেন কি না এই আশঙ্কা তাকে গ্রাস করেছিল।

অবসাদের সাথে লড়াই করতে হয়েছিল শাহরুখ খানকেও। তিনিও কিন্তু শারীরিক ও মানসিক বল জুটিয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়ান।

তবে সবার ক্ষেত্রে তা হয়নি। আত্মহত্যার কারণে একাধিক প্রতিভাময় তারকাকে হারিয়েছে বলিউড।

অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর বলিউডের অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।

কিন্তু কেন এই অবসাদ, আর কেনই বা তারকাদের মধ্যে দেখা যায় আত্মহত্যার প্রবণতা?

কেন মানসিক অবসাদ?
বলিউড বা বিনোদন জগতের তারকাদের অবসাদের বা অন্যান্য মানসিক রোগের সাথে লড়াই নতুন নয়। পারভীন ববির মতো অনেকেই এর সাথে লড়াই করেছেন।

সাইকিয়াট্রিস্ট এবং কলকাতা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. শর্মিলা সরকার বলেন, ‘প্রত্যেকটা জীবিকাতেই একটা লড়াই থাকে। তারকাদের ক্ষেত্রে এটা হয়তো একটু বেশি।’

‘অভিনেতা-অভিনেত্রী, গায়ক বা বিনোদন দুনিয়ায় যারা আছেন, তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। চরাই উতরাই অনেকটা বেশি থাকায় বিনোদন জগতে অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশনের সমস্যাও বেশি দেখা যায়,’ বলেন ড. শর্মিলা সরকার।

তার কথায়, ‘অনেকেই অনেক স্বপ্ন দেখেন কিন্তু হাতে গোনা কয়েকজনই খ্যাতি পান। বাকিরা সাফল্য পান না বা লাইম লাইটে পৌঁছানোর আগেই ফিরে আসতে হয়। অথবা নতুন মুখ এলে পুরানোদের জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে- এমন উদাহরণও বিস্তর রয়েছে। এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না।’

‘তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন নেই’
আরজি কর হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. রাজর্ষি নিয়োগী বলেন, ‘যদি ধরে নিই জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশের মানসিক অবসাদ রয়েছে, তাহলে এক শ’ জন তারকার মধ্যে পাঁচ জনের ডিপ্রেশন থাকবে। কিন্তু তাদের বিষয়টা আরও কঠিন।’

বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ডিপ্রেশনের ডিটারমিনেন্টের মধ্যে (যে যে কারণে অবসাদ হতে পারে), সোশ্যাল ডিটারমিনেন্ট (সামাজিক মাপকাঠি), তাদের জীবন শৈলী, তাদের লড়াই, তাদের প্রতিযোগী সুলভ মনোভাব ইত্যাদি রয়েছে।

‘প্রতিনিয়ত তাদের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। তারা চায়ের দোকানে গিয়ে চা খেতে পারেন না বা মন খুলে আড্ডা দিতে পারেন না, এই ভয়ে যে সাধারণ মানুষ কী বলবে, যদি গণমাধ্যমে তার ব্যক্তিগত জীবন ফাঁস হয়ে যায়। তারা মন খুলে বাঁচতেও পারেন না।’

এছাড়াও মাদক সেবন বা অন্য নেশার কথাও উল্লেখ করেন ড. নিয়োগী।

তার কথায়, ‘তারকাদের অর্থ আছে একইসাথে মাদকও তারা সহজেই পেতে পারেন। এটা কিন্তু একটা বড় সমস্যা। দু’একজন উঠতি গায়ক গায়িকাদের মুখে শুনেছি মাদক সেবন না করলে নাকি গানই করা যায়না! মাদক সেবন কিন্তু মানসিক সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে। হয়তো ভাবে মাদক সেবন করলে ভালো লাগবে, তারপর সেটা আর মজার বিষয় থাকে না। নেশার পর্যায় চলে যায়।’

টিকে থাকার লড়াই সহজ নয়
বিনোদন জগতে বিশেষত বলিউডে টিকে থাকার লড়াইটা সহজ নয়। বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন একই কথা।

ড. শর্মিলা সরকার বলেন, কর্মজীবনে শুরুর দিকে লড়াইটা হয়তো বেশি থাকে। কিন্তু কষ্ট করে শক্ত মাটি তৈরি করার পর যদি তাকে ফিরে আসতে হয়, তাহলে সেটা মেনে নেয়া বেশ কঠিন। তখন মনের মধ্যে ঝড় চলতে থাকে। পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের তার প্রতি উচ্চাশা থাকে।

‘এই অবস্থায় ফিরে আসাটা খুব মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি তারা মনে করেছে, ‘এত কষ্ট করে এসেছি, কী মুখে ফিরব। এর থেকে নিজেকে শেষ করে দেয়া বোধ হয় সহজ।’ শুধু মানসিক অবসাদ নয়, ইম্পালসিভ হয়েও অনেকে এই চরমতম পদক্ষেপ নিয়েছেন এমনটাও আমরা দেখেছি। এই জগতে থাকতে গেলে ধৈর্য ধরাটা খুব দরকার।’

সমস্যার কথা বলাটা কঠিন?
বিশেষজ্ঞদের মতে তারকাদের অনেকেই সাহায্য চাইতে দ্বিধা বোধ করেন।

‘আমি দেখেছি, মুম্বাইয়ের তারকারা তাদের বাড়িতে বসে মনোবিদদের সাথে কথা বলতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্টের বা সাইকোলজিস্টের অফিসে কাউন্সিলিং সবচাইতে ভালো হয়। কিন্তু তারকারা চাচ্ছেন তার বাড়িতে বসে কথা বলতে যাতে পাঁচকান না হয়। এবং সাইকোলোজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট চুপিচুপি তার বাড়িতে যাচ্ছেন কাউন্সেলিং করতে,’ বলেছেন ড. নিয়োগী।

গোপনীয়তার কথা ভেবে কেউ কেউ অবশ্য টেলিফোন মারফত বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী।

তবে মাধ্যম যাই হোক, অবসাদের ক্ষেত্রে কথা বলাটা, বিশেশজ্ঞের সাহায্য চাওয়াটা প্রয়োজন সে বিষয়ে জোর দিয়েছেন তিনি। একই কথা বলেছেন, ড. সরকার।

প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সৌভিক মণ্ডল এ বিষয়ে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেন, অনেক সেলেব্রিটিরাই সমাজ মাধ্যমে বা সংবাদমাধ্যমের কাছে এই বিষয়ে কথা বলছেন, এটা প্রমাণ করে তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলার বিষয়ে ট্যাবুটা একটু হলেও কমেছে। যেমন দীপিকা পাডুকোন খুব সাবলীলভাবেই তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন।

মানসিক অবসাদ বা আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সামাজিক অবস্থানের কথাও বলেছেন অধ্যাপক মণ্ডল।

উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, ‘হয়তো এটার মধ্যে একটা ক্লাস ডায়নামিক্স আছে।’ একইসাথে তিনি লিঙ্গভিত্তিক দিকের কথারও উল্লেখ করেন তিনি।

‘একজন নারীর পক্ষে তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা একজন পুরুষের চাইতে কথা বলাটা কতটা সহজ বা কঠিন এটা কিন্তু দেখার বিষয়। সমাজে অন্য যে ধরনের স্টিরিওটাইপ বা ট্যাবু আছে, এক্ষেত্রেও কিন্তু সেটা প্রযোজ্য।’

সাহায্যের হাত
মনোবিদদের পাশাপাশি মা-বাবা, পরিবার এবং পরিচিতদের সান্নিধ্য এবং সাহায্যের হাত যে মানসিক অবসাদের সাথে লড়াইকে কিছুটা হলেও সহজ করে দেয় সে বিষয়ে জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এআর রহমান বা দীপিকা পাডুকোন নিজেদের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়েও একই কথা বলেছেন।

সে বিষয়ে ড. শর্মিলা সরকার বলেছেন, বাবা-মায়ের ভুমিকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লেখাপড়ার ছাড়াও যদি জীবনে কেউ যদি অন্য পথ বেছে নিয়ে এগিয়ে যেতে চান, তাহলেও বাবা-মায়ের উচিৎ পাশে থাকা। তারা যদি সন্তানকে এটুকু বুঝিয়ে বলতে পারেন, যাই হোক আমরা পাশে আছি, তা হলেই সমস্যা অনেকটা কমে যায়।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement