২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নানা সঙ্কটে মানবেতর জীবন রাঙ্গাবালীর রাখাইনদের

-

দুই থেকে আড়াইশ’ বছর আগে মিয়ানমারের আরাকান থেকে এসে পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার বনাঞ্চল কেটে বসতি গড়ে তোলে রাখাইন সম্প প্রদায়। সাগর উপকূলীয় এই নির্জন বনভূমিকে বাসযোগ্য করার কারিগর রাখাইনরাই। তৎকালীন সময় থেকে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি সামাজিকভাবে তাদের বংশ বিস্তার ঘটে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীদের দম্ভ, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকা এবং মৌলিক চাহিদা না মেটাতে পারায় আজ বিলুপ্তির পথে এই সম্প্রদায়। কগজপত্রে রাখাইন জনগোষ্ঠী নিয়ে নানা কর্মযজ্ঞ দেখা গেলেও বাস্তবে তাদের জন্য কিছু ঘটতে দেখা যায়নি।
জানা গেছে, ১৭৮৪ সালে নানা সঙ্কট ও জানমাল নিরাপত্তার জন্য মিয়ানমার থেকে নৌপথে রাখাইনদের আগমন ঘটে পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকায়। তৎকালীন সময়ে এখানকার উপকূলীয় নির্জন বনাঞ্চল কেটে বাসযোগ্য করে এবং অনাবাদি জমিকে আবাদযোগ্য করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ শুরু করে তারা। পাশাপাশি সাগরে মাছ ও বন্য পশুপাখি শিকার করাই ছিল তাদের মুখ্য পেশা। তৎকালীন সময়ে ওই সব এলাকায় রাখাইন জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বদেশ ত্যাগ করলেও তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা ছিল সচেষ্ট।
এখন রাঙ্গাবালীতে শতাধিক রাখাইন পরিবার বসবাস করছে। কিন্তু শত শতকের ৯০ দশকেও ছিল কয়েক গুণ বেশি। যারা আছে তারাও মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাদ্য সঙ্কটের পাশাপাশি নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এমন কি মাতৃভাষা প্রসারের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের জবরদখল। গত দুই দশকে মিথ্যা মামলা ও জবর দখলে দুই সহস্রাধিক রাখানই পরিবার ভিটে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। ভিটে-মাটি রক্ষা করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যথেষ্ট উদাসীনতা রয়েছে বলে দাবি করেন রাখাইনরা। এ কারণে কেউ কেউ পারি দিয়েছেন আপন দেশ আরাকানে। যারা আছে তারাও রয়েছে নানা শঙ্কায়। রাখাইনদের নামানুসারে রাঙ্গাবালী উপজেলার গংগিপাড়া, মনিপাড়া, ছাতিয়ানপাড়া, পুলাউপাড়া, মিদুপাড়াসহ অনেক এলাকার নাম রয়েছে। কিন্তু সেসব এলাকা থেকে প্রভাবশালীদের দম্ভে অনেক আগেই তারা চলে গেছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, রাঙ্গাবালীর উপজেলার উত্তরীপাড়া, গঙ্গীপাড়া এলাকায় দলনেতা পোঅং, উঃ গুনগ্রী, অক্যে চৌধুরী গঙ্গীসহ কয়েকজন রাখাইনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রাঙ্গাবালীর অরণ্য ভূমি আবাদি জমিতে পরিণত হয়। পর্যায়ক্রমে রাখাইন পরিবারে লোকসংখ্যা বেড়ে গেলে তারা নতুন জায়গার সন্ধানে বের হয়। উপজেলার দারচিরা নদীর পশ্চিম পাড়ে বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের তুলাতলী, কাটাখালী, ফেলাবুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকাকে তারা আবাসযোগ্য হিসেবে পছন্দ করে সেখানে বসতি স্থাপন করে, যা এখনো রাখাইন পাড়া হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী প্রজন্মে অলাউ হাং, ধনঞ্জয় হাং, পুলাউ হাং, মচালা মাদবর, লাফ্রু চানসহ অনেক প্রভাবশালী রাখাইন এলাকায় জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতি ছিল তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। হারিয়ে যাওয়া রাখাইনদের সাথে হারিয়ে গেছে, রাখাইন সাংস্কৃতি পেগু নাচ, রঙ্গিন ফানুস উরানোসহ নানা উৎসব।
১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বার বার ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে অনেক পাড়া ধ্বংস হয়েছে। বহু রাখাইনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন হারিয়েছে। ধন সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্য শিক্ষার হার কম থাকায় স্বার্থলোভী ভূমিদস্যু মহল তাদের জমিজমা অন্যায়ভাবে দখল করে নিয়েছে। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অনেক নিরীহ রাখাইনকে ভিটেবাড়ি ছেড়ে যেতেও বাধ্য করা হয়েছে। যারা রয়েছে তারা কুঁচে আর কাঁকড়া ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। তারাও যেকোনো সময় ভিটে ছাড়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার তুলাতলী রাখাইনপাড়ার বাসিন্দা মাতেন, মাচান, উচামং রাখাইনের সাথে কথা হয়। স্পষ্ট বাংলা বলতে না পারলেও বাংলা জানেন তারা। কেমন আছেন জানতে চাইলে চোহামং রাখাইন বললেন, ‘ভাল নেই। কুচে কাকড়া ধরে সংসার চালাইসে, পোলা মাইয়া স্কুলে জাইসে কলেজে জাইসে, খরচা চালাইতে পারে না কি করিবে।’ ৯৫ বছর বয়সী মংথাছি রাখাইন বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা আমাদের পাড়ার জমি রেকত (রেকর্ড) করিসে, আমাগো লোরাইতে চাইসে, আমরা কি আলের (হালের) গরু পিরাইয়া মারিসে নাকি এ্যা।’

 


আরো সংবাদ



premium cement