০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অপ্রয়োজনীয় সিজারে সন্তান জন্মদান

হাসপাতালগুলোর অর্থলিপ্সার বিষফল

-

দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে মোট শিশু জন্মদানের ২৩ শতাংশ সিজারিয়ানে হয়ে থাকে। কিন্তু বেসরকারি ক্লিনিকের ৮০ শতাংশ শিশুর জন্মদান হয় অস্ত্রোপচারে। অবশ্য মা ও সন্তানের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসব সিজারিয়ানে করানোর সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভিমত, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করলে মা ও সন্তান দু’জনই ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁঁকিতে পড়তে পারে। এ সময় বিভিন্ন ধরনের চেতনা এবং ব্যথানাশক দেয়া হয় মাকে। এর প্রভাব পড়ে মা এবং নবজাতকের ওপর। মায়ের বুকের দুধ শুরু করাতেও সমস্যা হয়। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের সাথে অপরিণত শিশু জন্মেরও সম্পর্ক রয়েছে। ফলে শিশু প্রতিবন্ধী ও মেধাশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। এত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দেশে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বেড়েছে। যদিও করোনাকালে সিজারিয়ানের হার অনেক কমেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভীতি কেটে গেলে সিজারিয়ান বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, কিছু চিকিৎসক ইচ্ছা করেই অর্থের লোভে সিজারিয়ান করেন।
তবে সিজারে সন্তান জন্মদানে ক্লিনিকের মালিকদের কাছে অনেকসময় চিকিৎসকরাও অসহায় হয়ে পড়েন। প্রসূতি অথবা অভিভাবককে সিজার করাতে উদ্বুদ্ধ করাতে না পারলে ওই চিকিৎসককে ক্লিনিকেও বসতে দেয়া হয় না। এটা ঠিক যে, অপ্রয়োজনীয় সিজার করতে অনাগ্রহী চিকিৎসকের সংখ্যা হাতেগোনা। অবস অ্যান্ড গাইনোকলজির বেশির ভাগ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় সিজার করানোর অভিযোগ রয়েছে। নানা কারণ দেখিয়ে প্রসূতি অথবা অভিভাবককে সিজারিয়ানে সন্তান জন্মদানে বাধ্য করা হয়। বিনিময়ে অল্প সময়ে প্রতিটি সিজারিয়ান থেকে অর্থ আয় করেন চিকিৎসক ও ক্লিনিক মালিক উভয়ে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের বেশি সিজারিয়ন বেবি। উন্নত দেশে এই হার ৫ শতাংশের কম। সেখানে সন্তান জন্মগ্রহণের সময় এমন গণহারে সিজার করানোর নজির নেই। খুব প্রয়োজন হলে এবং বিকল্প না থাকলে শুধু তখনই সেসব দেশের চিকিৎসকরা সিজার করার সিদ্ধান্ত নেন। সব চিকিৎসকের মত হলোÑ স্বাভাবিক প্রসবে মা যেমন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন, সিজার করলে সেটি সম্ভব হয় না। দ্বিতীয়বার গর্ভধারণে ঝুঁকি বাড়ে। কষ্ট তো বাড়েই। এত কিছুর পরেও দেশে বেশির ভাগ সিজার-বেবি হচ্ছে কেন? আমরা কথায় কথায় উন্নত দেশের বরাত দিই, তাহলে সিজারের ক্ষেত্রে এমন আচরণের কারণ কী? যা স্বাভাবিক নিয়মে ঘটে, যেটি উপকারী; তা বাদ দিয়ে বিপরীত এবং ক্ষতিকর কাজটি কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করছি? সিজার করাতে পারলে ডাক্তারদের কমিশন থাকে জেনে এবং মেনে নিয়েই সিজার করাই। ক্লিনিক মালিকদের মুনাফা থাকে, জেনে এবং মেনেই আমরা সিজার করাই। কিন্তু আমাদের প্রসূতিদের শারীরিক ক্ষতি হবে; জেনে এবং মেনে কেন সিজার করাই! এটা তো ফ্যাশন নয়।
কিছু চিকিৎসক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে প্রসূতিকে সিজারের দিকেই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিজেদেরও একটা সিদ্ধান্ত থাকে। তাই এ বিষয়ে যাবতীয় দোষ চিকিৎসক-ক্লিনিক মালিকের ওপর চাপিয়ে দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? বরং অর্ধেক দোষ প্রসূতির পরিবারে বর্তায় বৈকি। ভালো চিকিৎসক সবসময় স্বাভাবিক প্রসবের পরামর্শই দিয়ে থাকেন। সন্তানসম্ভবা নারী যখন একজন ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন থাকেন, তখন ওই চিকিৎসক প্রথম থেকেই স্বাভাবিক প্রসবে উৎসাহিত করেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে সেই প্রসূতিরও সিজারিয়ান ডেলিভারি হয়। এর জন্য দায়ী কে? এমন তো নয়, স্বাভাবিকভাবে সন্তান জন্ম দেয়ায় বাংলাদেশের নারীরা শারীরিকভাবে অনুপোযুক্ত। আমেরিকা বা ইউরোপে আমাদের দেশের নারীরা ঠিকই স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্মদানে সক্ষম! শুধু স্থান পরিবর্তনে ব্যতিক্রম কিভাবে ঘটছে?
সমস্যাটা মূলত আমাদের মানসিকতায়। সাথে জড়িত অন্য ব্যবসায়ীদের মতো ‘ক্লিনিক-ব্যবসা’য় নামা কিছু অর্থলোভী ব্যবসায়ী। এর সাথে জড়িত ওষুধ কোম্পানি এবং সার্বিকভাবে চলে আসা একটি বাজে সিস্টেম। দেশের পরিবেশই এমন, পুরো চক্রের সবাই কমবেশি জড়িত। সব কিছুর পরও বলতে হয়, বেসরকারি হাসপাতালের মালিকপক্ষের অতিরিক্ত মুনাফার মানসিকতায় সিজারিয়ান বেবি জন্মদানের বিষফল দেশকে বহন করতে হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement