পাবনায় সওজের জায়গায় অবৈধ বহুতল ভবন ও মার্কেট

আবারো দখল হয়ে যাচ্ছে পাবনা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের আওতাধীন মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে বেড়া সিঅ্যান্ডবি স্ট্যাক ইয়ার্ড, বাঁধেরহাট, আমিনপুর বাজার বাসস্ট্যান্ড, কাশিনাথপুর মোড়সহ নগরবাড়ির অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব জায়গা আবারো দখল করে বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করছেন। এই অবৈধ দখলের সাথে সওজের কাশিনাথপুর সেকশনাল অফিসের কিছু অসাধু প্রকৌশলী ও কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ গত বছরের শেষের দিকে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশের অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। সেই অভিযানে বেড়া স্ট্যাক ইয়ার্ড, কাশিনাথপুর, নগরবাড়ি ও বাঁধেরহাটের ছয় শতাধিক আধাপাকা-কাঁচা দোকান ঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এখন উচ্ছেদকৃত কিছু কিছু এলাকায় আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আরসিসি পিলারের ভিত্তিস্থাপন করে বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
পাবনা-২ আসনের সাবেক এমপি খন্দকার আজিজুর রহমান আরজু তিন বছর আগে এক সময়ের উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার ও জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র নগরবাড়ির নলখোলা-মথুরাপুরে পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং সরকারের বিপুল খাস জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে বালু-মাটি ভরাট করে দুই পাশে ১৬১টি দোকানের বিশাল মার্কেট নির্মাণ করেন। প্রতিটি দোকানের পজিশন বাবদ এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি মাসে দোকানগুলো থেকে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। পজিশন হস্তান্তর ও ভাড়ার টাকা কোনো খাতে জমা বা ব্যয় হচ্ছে তা স্থানীয় প্রশাসন জানে না। সাবেক এমপি খন্দকার আজিজুর রহমান আরজু সরকারি জায়গায় মার্কেট নির্মাণের অভিযোগ স্বীকার করে বলেছেন, তৎকালীন প্রশাসনের কাছ থেকে মৌখিক অনুমোদন নিয়ে তিনি মার্কেট নির্মাণ করেছেন। পজিশন হস্তান্তর ও ভাড়ার টাকা মার্কেট নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হয়েছে।
বেড়া উপজেলার কাশিনাথপুর-কাজিরহাট আঞ্চলিক মহাসড়কের বাঁধেরহাট বাজার ঘুরে দেখার সময় কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় গোলাপবার, কাঠমিস্ত্রি রবি, আমিরুলসহ কেউ কেউ সওজের জায়গা দখল করে বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অলিখিতভাবে পজিশন হস্তান্তর করেছেন। এলাকার প্রভাবশালী শামসুল মোল্লা, দিলবর মণ্ডল, লুৎফর রহমান মোল্লা, বারেক মণ্ডল, বকুল ফকির, নাদের মোল্লা, জলিল প্রামাণিক, মজিদ মোল্লা, আরিফ মৃধা, রশিদ মোল্লা, রশিদ মাস্টার, হান্নাসহ অনেকেই সড়ক ও জনপথ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অবৈধভাবে দখল করে আরসিসি পিলারের ভিত্তিস্থাপন করে বহুতল ভবন ও মার্কেটের নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, বাঁধেরহাটে যেসব বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে তার সাথে সওজের কাশিনাথপুর সেকশনাল অফিসের উপসহকারী প্রকৌশলী আহসানুল কবির ও কার্যসহকারী আবদুল বাসেদের পরোক্ষ সহযোগিতা রয়েছে। সম্প্রতি পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে মহাসড়কের দুই পাশ থেকে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার জন্য দখলদারদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু উল্লেখিত দখলদারদের কোনো নোটিশ দেয়া হয়নি। সওজের পাবনা অফিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, কাশিনাথপুর সেকশনাল অফিস থেকে অবৈধ দখলদারদের যে তালিকা পাঠানো হয়েছে, শুধু তাদেরই নোটিশ দেয়া হয়েছে।
এ দিকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আমিনপুর ও কাশিনাথপুর মোড় এলাকায় সওজের উদ্ধারকৃত জায়গা পুনঃদখল করে পাকাবাড়ি ও দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। বেড়া স্ট্যাক ইয়ার্ডের প্রায় ১৫ বিঘা জায়গার প্রায় পুরোটাই আবারো অবৈধ দখলে চলে গেছে। সেখানে প্রতিদিন সকাল-বিকেল বাজার বসে। এ ছাড়া সপ্তাহের দুই দিন শনি ও মঙ্গলবার স্ট্যাক ইয়ার্ডের ভেতরে হাট বসে। প্রতি হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে খাজনা আদায় করা হয়। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, হাটবাজার থেকে আদায় করা খাজনার টাকা প্রভাবশালী মহল এবং সওজের কাশিনাথপুর সেকশনাল অফিসের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছেন।
আমিনপুরের সেলিম মিয়া জানান, গত বছরের প্রথম দিকে আমিনপুর বাজার বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপাশে মীর আসমাৎ দৌলা জাহাঙ্গীর মিয়া নামে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। কাজ চলাকালীন সময়ে তারা বাধা দিলে জাহাঙ্গীর বিভিন্নভাবে হামলাÑমামলার হুমকি দেন। কাশিনাথপুর সেকশনাল অফিসে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি। কাশিনাথপুর সেকশনাল অফিস থেকে যাদের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছিল, গত বছরের শেষ দিকে শুধু তাদের দোকান ও বসতঘর উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ওই সময় ব্যাপক অভিযোগ ওঠে যে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আমিনপুর, নগরবাড়ী ও বাঁধেরহাটের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর নাম সুকৌশলে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। তাই তাদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আওতায় আসেনি।
রূপপুর ইউনিয়নের অনেকেই জানিয়েছেন, বাঁধেরহাটে সপ্তাহে তিনটা বড় হাট বসে। আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে হাট বসায় সৃষ্ট প্রচণ্ড যানযটে যাত্রী সাধারণ ও পথচারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। গত বছরের শেষ দিকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের ফলে হাটের জায়গা বৃদ্ধি পাওয়ায় সড়কে যানজট সমস্যার সমাধান হয়। আবারো সেসব জায়গা অবৈধ দখলে চলে যাওয়ায় হাটবারে প্রচণ্ড যানজটে নাকাল হতে হচ্ছে যাত্রী ও পথচারীদের। অবৈধ দখলদাররা স্থানীয় প্রভাবশালী হওয়ায় সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা টুঁ শব্দ করার সাহস পায় না।
বেড়া উপজেলার রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসেম উজ্জ্বল বলেন, বাঁধেরহাট আমার ইউনিয়নে অবস্থিত। গত বছরের শেষ দিকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযানে পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগকে জনবল দিয়ে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি আমাদের সরকারদলীয় নামধারী কিছু নেতা ক্ষমতার অপব্যবহার করে উচ্ছেদকৃত জায়গা আবার দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করছেন। এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবহিত করেছি। আশা করছি তিনি যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ আনাম সিদ্দিকী বলেন, নগরবাড়ির নলখোলা-মথুরাপুরে সরকারি জায়গায় সাবেক এমপি খন্দকার আজিজুর রহমান আরজুর মার্কেট নির্মাণের বিষয়ে পাবনা জেলা আইনশৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সভায় বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সভায় এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পাবনা সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বলা হয়েছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য পাবনা সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দেয়া হবে। প্রযোজনে তাদের আইনি সহায়তা দেয়া হবে।
পাবনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম শামসুজ্জোহা জানান, তিনি এ বিষয়ে জানার পর আমিনপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কাশিনাথপুর সেকশনাল অফিস থেকে পাঠানো তালিকায় যাদের নাম আছে শুধু তাদেরকেই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। করোনাকালীন সঙ্কটকে পুঁজি করে বিভিন্ন এলাকায় উদ্ধারকৃত জায়গা কেউ কেউ আবারো দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করছে। পাশের জেলা মানিকগঞ্জে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। এখানেও খুব দ্রুত অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে বলে তিনি জানান।